ছবি : সংগৃহীত

প্রখ্যাত বাংলা থিয়েটার ব্যক্তিত্ব ও অভিনেত্রী শাঁওলী মিত্রের মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই শোক প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে মমতা বলেন, শাঁওলী মিত্র তার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ‘সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়, তিনি আমাদের সাথে ছিলেন। আমি যখন রেলমন্ত্রী ছিলাম, তখন তিনি আমার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন। তিনি বঙ্গবিভূষণ এবং দীনবন্ধু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। শাঁওলীদির অভিনয়ের একটি স্বতন্ত্র শৈলী ছিল এবং “নাথবতী অনাথবৎ” -এ অভিনয়ের একটি নতুন শৈলী দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তার স্পষ্ট উচ্চারণ ও অভিব্যক্তি সর্বদা দর্শকদের আকৃষ্ট করেছিল।’

আসলে শুধু পশ্চিমবাংলারই নয়, দুই বাংলার অসংখ্য থিয়েটার ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। বাংলা থিয়েটার আইকন শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্রের কন্যা, শাঁওলী মিত্র ১৬ জানুয়ারি বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে ৭৩ বছর বয়সে মারা যান।

শাঁওলী মিত্র বিভিন্ন রোগে ভুগলেও হাসপাতালে ভর্তি হতে রাজি হননি। আবার তার শেষ ইচ্ছে হিসেবে, তিনি চাননি যে লোকেরা তার মৃতদেহের উপর পুষ্পস্তবক অর্পণ করুক বা তার শবদেহ এমন কোনো জায়গায় নিয়ে রাখা হোক যেখানে লোকেরা তাদের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য যাবে। এটি যাতে ঠিকমতো মানা হয় সেজন্য তিনি ২০২০ সালে এই বিষয়ে একটি উইল করেছিলেন এবং এখানে তিনি তার বাবা শম্ভু মিত্রকেই অনুসরণ করেছিলেন, যাকে কাউকে না জানিয়ে দাহ করা হয়েছিল। তাই তিনি প্রয়াত হওয়ার পর তার শেষ ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়েই কাউকে খবর দেওয়া হয়নি।

শাঁওলী মিত্র সম্পর্কে কবি জয় গোস্বামী বলছেন, এক সময়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিনয় করার শারীরিক শক্তি চলে গেল শাঁওলী মিত্রের। অথচ বালিকা বয়স থেকেই শাঁওলী মিত্র স্টেজে অভিনয় করতে করতে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ যখন বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীর দ্বারা প্রথম মঞ্চস্থ হয়, তখন বালিকা শাঁওলী করেছিলেন ‘অমল’-এর চরিত্র। আমি সে অভিনয় দেখিনি। কিন্তু বহুরূপীর প্রবীণ অভিনেতা দেবতোষ ঘোষ, যিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালে প্রয়াত হয়েছেন, তার মুখে শুনেছি গোটা নাটক জুড়ে ‘অমল’ চরিত্রের দীর্ঘ সব সংলাপ, কেমন মর্মগ্রাহী নিপুণতায় ফুটিয়ে তুলতেন শাঁওলী, তার ওই অতটুকু বয়সে। অর্থাৎ বাল্যকাল থেকেই শাঁওলী মিত্রের অভিনয় প্রতিভা সকলকেই মুগ্ধ করে এসেছে। তাই তো তিনি সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত।

'হযবরল' এবং 'ডাকঘর' নাটকে তার ভূমিকা তাকে বাংলা থিয়েটারে অমর করে তোলে। তিনি ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত 'যুক্তি তক্কো গল্প'-এ অভিনয় করেছিলেন। শাঁওলী সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নেন। দিনের পর দিন তিনি সিঙ্গুরে গিয়েছিলেন সেই কৃষকদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন যাদের জমি জোর করে একটি অটোমোবাইল কারখানা স্থাপনের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। তিনি কৃষকদের বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং সিপিআই (এম)-এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে তাদের সংগঠিত করেছিলেন। নন্দীগ্রামে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সূচিত আন্দোলনে যোগ দেন। যুগল মহলেও তিনি তৃণমূলের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত শাঁওলী মিত্র ছিলেন একজন প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা, পরিচালক, নাট্যকার এবং লেখক। তিনি বাংলা থিয়েটারের ওপর বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ‘ফাইভ লর্ডস’, ‘লক্ষ্মী যখন আসবে’, এবং ‘গণনাট্য নবনাট্য সৎনাট্য অ শম্ভু মিত্র’।

কিংবদন্তি থিয়েটার শিল্পী দম্পতির ঘরে জন্ম নেওয়ায় তিনি তার বাবা-মায়ের নির্দেশনায় কলকাতার বহুরূপী প্রোডাকশনের মাধ্যমে তার অভিনয় জীবন শুরু করেছিলেন। শর্ট ফিল্ম ‘সুভা’-এর পরিচালক, শাঁওলী মিত্র তার অভিনয় জীবন শুরু করেছিলেন পাঁচ বছর বয়স থেকেই।

১৯৭২ সালের ১ মে, বহুরূপীর পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শম্ভু মিত্র নির্দেশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজা’য় অভিনয় করেন। তৃপ্তি মিত্র করেছিলেন রানি ‘সুদর্শনা’র চরিত্র, শাঁওলী হয়েছিলেন ‘সুরঙ্গমা’। সুদর্শনা-সুরঙ্গমার এই জোট বাধা অভিনয় এবং বহুরূপী-র অনন্য টিমওয়ার্ক সেদিন প্রযোজনাটিকে এক উচ্চমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। তারপর সময়ের বিবর্তনে বাংলা, ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় নাট্যজগতে নিজের ছাপ ছেড়েছেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়।

তিনি পশ্চিমবঙ্গে বহু বছর বাংলা একাডেমির সভাপতি ছিলেন এবং শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় কাজের মধ্যেই ডুবে ছিলেন তিনি। জানা যায়, বাংলা একাডেমির কাজে, সকলকে স্নেহ করার সঙ্গে সঙ্গে বয়সে কনিষ্ঠদেরও তাদের কাজের জন্য সম্মান প্রদর্শন করতে তিনি অকুণ্ঠিত ছিলেন। তবে শাঁওলী মিত্রকে ২০১৯ সালে শেষ মঞ্চে দেখা গিয়েছিল যখন তিনি ‘সীতা কথা’-এর একক নাটক-পঠন করেছিলেন।

থিয়েটার ব্যক্তিত্ব বলেছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত-এর কথা থেকে জানা যায়, ‘শাঁওলী কিছু সময়ের জন্য অসুস্থতার কারণে জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দূরে ছিলেন কিন্তু বছরের পর বছর ধরে তিনি তার দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছিলেন, একথা আমরা কি করে ভুলে যাব।’

দর্শক ১৯৮৩ সালে প্রথম দেখলেন ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটকের মঞ্চায়ন। আমাদের এই নাটক দেখা ভাগ্যে জুটেছিল সে অনেক পরে।  ১৯৯৪ সালের দিকে কলকাতায় লেখাপড়ার পাশাপাশি ঊষা গাঙ্গুলির ‘রঙ্গকর্মী’র হয়ে নাট্যচর্চার সুযোগ আমারও হয়েছিল। সেই সুবাদে নাট্যগুরু শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রর অভিনয়ও দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই সময়েই শাঁওলী মিত্রের রচনায় ও একক অভিনয়ে বাংলা থিয়েটারে এক মাইলস্টোন ‘নাথবতী অনাথবৎ’ দেখার সুযোগ হয়েছিল।

মহাভারতের একেকটি চরিত্র, একেক রকম স্বর প্রয়োগে, একেক রকম শরীর ভঙ্গিমায়, একেক রকম পদক্ষেপে মূর্ত হয়ে উঠতে লাগল শাঁওলী মিত্রের তুলনারহিত অভিনয়-ক্ষমতায়। আগের মতো তখনো প্রত্যেক শো হাউসফুল যাচ্ছে। তারপর আমরা জেনেছি, ১৯৮৯ সালে এলো মহাভারত নিয়ে আরও এক নাটক— ‘কথা অমৃতসমান’। এই নাটকও লিখেছিলেন শাঁওলী মিত্র নিজেই। অভিনয়ও করলেন একা।

দু’টি নাটক একত্র হয়ে গ্রন্থ রূপে প্রকাশ পাওয়ার পরে এই বইয়ের জন্য আনন্দ পুরস্কার প্রদান করা হল শাঁওলী মিত্রকে। তার দলের শো বা মাঝে মধ্যেই একাডেমি অব ফাইন আর্টস, গিরিশ মঞ্চ বা অন্য কোথাও দেখা হলেই জানতে চাইতাম তার এই মনোমুগ্ধ করা অভিনয়ের গোপন কৌশল।

শাঁওলী মিত্র আমার মতো অনেক নবীন নাট্যকর্মীদের হয়তো সহজ করেই বোঝানোর চেষ্টা করতেন কিন্তু বয়স কম ছিল তাই হয়তো অনেক কিছু মাথার উপর দিয়ে চলে গেলেও তার এই চলে যাওয়াটা যে নাট্যাঙ্গনের কতবড় শূন্যতা তৈরি করল তা সহজেই অনুমেয়।  'বিতাতা বিতাংশা', 'নাথবতী অনাথবৎ', 'পুতুলখেলা', 'একটি রাজনৈতিক হত্যা', 'হযবরল', 'চণ্ডালী', 'পাগলা ঘোড়া', 'পাখি', 'গ্যালিলিও'র জীবন' ইত্যাদি বিখ্যাত নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন অগণিত দর্শককে। শাঁওলী মিত্রর মৃত্যু বাংলা থিয়েটার জগতে ইন্দ্রপতন। একটা যুগের অবসান। যে সময় আর ফিরে আসার নয়।

নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক