ছবি : সংগৃহীত

মর্তলোকে চলে গেলেন মকবুল ফিদা হুসেনের সরস্বতী, যিনি দেবী কি ঈশ্বরী নন, জীবন্ত শরীরী এবং এক অনন্ত বিরহিণী রাধা। যিনি কণ্ঠে ধারণ করেছেন জীবনের গান। তা না হলে কি এত প্রেম, এত বিরহ, এত পূর্বরাগ, এত অভিসার অবলীলায় বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি হৃদয়ে সঞ্চারিত করতে পারতেন।

লক্ষ কোটি শ্রোতার মতো আমার বাবাও তার গানের ভক্ত ছিল। তার প্রথম মাসের মাইনের টাকায় ষাটের দশকে কেনা রেডিওটি যেন সারাক্ষণ লতা বা মোহাম্মদ রাফির গানই শোনাতো। আমি ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে চুপ করে বসে সেই রাধারানীর ‘এ নদীর দুই কিনারে’ কখনো ‘আ যা রে পরদেসি’, ‘না মন লাগে না’, ‘কেন কিছু কথা বলো না’, গান শুনতাম। হয়তো কিছু বুঝতে পারতাম না কিন্তু ভালো যে লাগতো তা সময়ের সাথে সাথে বুঝে গিয়েছিলাম।

আমার মতো কয়েক প্রজন্মের কাছে অসংখ্য গানের মায়া যিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার সামনে মৃত্যুও বড় বিব্রত, অবিন্যস্ত হয়ে তার পায়ের কাছে শোকে মুহ্যমান। আজ সেই মহানদীর পাড়ে বিসর্জনের সানাই বাজছে। অথচ মৃত্যু সে কি নিশ্চিন্ত। চপলা হরিণীর মতো কিংবা এক অনন্ত মুগ্ধতার মাঝে আঁচল বিছিয়ে দিয়েছেন ঈশ্বর। প্রতিটা বিসর্জনই তো একটা নতুন যাত্রা। এ যাত্রা মহাকালের। এ যাত্রা না শেষ হওয়া মুগ্ধতার। তবুও মন মানে না। রজনী সত্যিই এখনো বাকি...।

প্রায় চার সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। সম্প্রতি অবস্থার উন্নতিও হচ্ছিল। কিন্তু শনিবার আচমকা তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। দিতে হয় ভেন্টিলেশনে। সেখান থেকে আর ফেরানো যায়নি লতাকে। ৬ ফেব্রুয়ারি সকালে তিনি ৯২ বছর বয়সে প্রয়াত হন।

১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর লতার জন্ম এক মারাঠি পরিবারে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারান। তার আগে অবশ্য বাবার হাত ধরেই অভিনয় এবং গান শিখতে শুরু করেছেন। ১৩-১৪ বছর বয়সেই প্রথমবার সিনেমায় গান মরাঠি ছবিতে। মুম্বাই যাওয়ার পর ১৯৪৮ সালে প্রথম হিন্দি ছবিতে গান। তারপর যেন চারদিকে শুধুই আলো। সরস্বতীর আলো! স্বয়ং দেবীর মৃত্যুকে সহ্য হবে কেন তার? নাহ, শুধুই সরস্বতী নয়। লতা জন্মানোর পর থেকেই মঙ্গেশকর পরিবারে সে যেন লক্ষ্মী অচঞ্চলা। তার বাবা তো তাকে লক্ষ্মী বলেই ডাকতেন। বাবার নাম দীননাথ মঙ্গেশকর। নাট্য অভিনেতা ও গায়ক ছিলেন।

কাজটাকেই নিজের ধ্যানজ্ঞান রেখেছিলেন। যে কাজ গান গাওয়া। তার প্রথম হিন্দি ছবি ‘মহল’-এর ‘আয়েগা আনেওয়ালার’ও তো সত্তর বছর পেরিয়ে গেল। গানের বাইরে কোনো কিছুতে জড়াননি তিনি। ছোটবেলা থেকেই জীবন যুদ্ধ। অর্থের তাগিদেই ছবিতে অভিনয় করতে হয়েছিল।

ফিল্মে অভিনয় তেরো বছর বয়সে। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে অভিনয় প্রসঙ্গ এলে এ কথাই বলেছেন লতা মঙ্গেশকর, ‘ওই মেকআপ, আলো লোকজন গ্ল্যামার একদম ভালো লাগেনি আমার! তাই আর অভিনয় করার কথা ভাবিনি। তারপর গানই যেন জীবন আর জীবন মানেই গান।’

১৯৪২ সালে, লতার বয়স যখন ১৩, তার বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরে নবযুগ চিত্রপট সিনেমা কোম্পানির মালিক মাস্টার বিনায়ক (বিনায়ক দামোদর কর্ণাটকি) এবং মঙ্গেশকর পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাদের দেখাশোনা করতেন। তিনি লতাকে গায়ক ও অভিনেত্রী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করতে সাহায্য করেছিলেন।

সদাশিব রাও নেভরেকর রচিত এবং বসন্ত জোগলেকারের মারাঠি সিনেমা ‘কিতি হসাল’ (১৯৪২) [Kiti Hasal] এর জন্য লতা ‘নাচু ইয়া গাদে, খেলু সারি মানি হাউস ভরি’ গানটি গেয়েছিলেন কিন্তু গানটি শেষ পর্যন্ত সিনেমা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। প্রচণ্ড মন খারাপের মধ্যেই বিনায়ক নামের একজন পরিচিত তাকে নবযুগ চিত্রপটের মারাঠি সিনেমা ‘পাহিলি মঙ্গলাগৌর (১৯৪২)’ [Pahili Mangalagaur] একটি ছোট ভূমিকা দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি ‘নাটালি চৈত্রাচি নাভালাই’ গেয়েছিলেন যেটি দাদা চান্দেকর লিখেছিলেন।

মারাঠি ছবি ‘গজাভাউ (১৯৪৩)’ [Gajaabhaau] এর জন্য তার প্রথম হিন্দি গান ছিল ‘মাতা এক সপুত কি দুনিয়া বাদল দে তু’। ১৯৪৫  সালে মাস্টার বিনায়কের কোম্পানির সদর দফতর মুম্বাইয়ে স্থানান্তরিত হলে লতা সেখানে চলে আসেন। তিনি ভিন্দিবাজার ঘরানার ওস্তাদ আমান আলী খানের কাছ থেকে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাঠ নিতে শুরু করেন।

তিনি বসন্ত জোগলেকারের হিন্দি-ভাষা চলচ্চিত্র ‘আপ কি সেবা মে (১৯৪৬)’ [Aap Ki Seva Mein] এর জন্য ‘পা লাগুন কার জোরি’ গেয়েছিলেন, যেটির সুর করেছিলেন দত্ত দাভজেকর। লতা এবং তার বোন আশা পরিচালক বিনায়কের প্রথম হিন্দি সিনেমা ‘বাড়ি মা (১৯৪৫)’ [Badi Maa]-এ ছোট ভূমিকায় অভিনয়ও করেন। সেই সিনেমায় লতা ‘মাতা তেরে চারন মে’ কথার একটি ভজনও গেয়েছিলেন। বিনায়কের দ্বিতীয় হিন্দি সিনেমা ‘সুভদ্রা (১৯৪৬)’ [Subhadra]-এর রেকর্ডিংয়ের সময় সঙ্গীত পরিচালক বসন্ত দেশাইয়ের সাথে তার পরিচয় হয়।

১৯৪৮ সালে বিনায়কের মৃত্যুর পর, সঙ্গীত পরিচালক গোলাম হায়দার লতাকে প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি তখন ‘শহীদ (১৯৪৮)’ [Shaheed] চলচ্চিত্রে কাজ করছিলেন, কিন্তু বাঙালি সেই পরিচালক লতার কণ্ঠকে ‘খুব পাতলা’ বলে বাদ দিয়ে দেন। এতে হায়দার সাহেব খুব রাগান্বিত হয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, ‘আপনারা জেনে রাখুন আগামী দিনে এই আপনাদের মতো প্রযোজক এবং পরিচালকরা প্রয়োজনে লতার পায়ে পড়ে যাবেন এবং তাদের চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার জন্য ভিক্ষা প্রার্থনা  করবেন।’

হায়দার লতাকে ‘মজবুর (১৯৪৮)’ [Majboor] চলচ্চিত্রে নাজিম পানিপতির লেখা ‘দিল মেরা থোরা, মুঝে কাহিন কা না ছোরা’ গানটির মাধ্যমে লতা তার প্রথম বড় সফল চলচ্চিত্র হাতে পেয়ে যান যা তাকে ভারতীয় উপমহাদেশে লতা মঙ্গেশকর করে তুলে।

২০১৩ সালে লতা তার ৮৪তম জন্মদিনে একটি সাক্ষাৎকারে নিজেই ঘোষণা করেছিলেন, ‘গোলাম হায়দার সত্যিই আমার গডফাদার। তিনিই প্রথম সঙ্গীত পরিচালক যিনি আমার প্রতিভার প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস দেখিয়েছিলেন।’

ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, প্রাথমিকভাবে লতা প্রশংসিত গায়িকা নুর জাহানকে অনুকরণ করতেন বলে কথিত আছে, কিন্তু পরে তিনি তার নিজের একটি ভিন্ন গাওয়ার শৈলী গড়ে তোলেন যাকে গায়কি বা ঢং বলা হয়ে থাকে। তিনি ‘আধুনিক’ এবং ‘ঐতিহ্যগত’ উভয় মহিলা চরিত্রের সাথে মানানসই মাহফিল-শৈলীর পরিবেশনা থেকে দূরে সরে গিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র সঙ্গীতে গাওয়ার একটি নতুন স্বকীয় শৈলী নিয়ে আসেন।

যদিও তার কর্মজীবনের প্রথম দিকে তার সীমিত দক্ষতা দিয়েই শুরু করতে হয়েছিল তবুও বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতীয় চলচ্চিত্রের গানের সুরকে নির্দিষ্ট আকার দেওয়ার জন্য তার কণ্ঠে যথেষ্ট উপাদান মজুত ছিল এবং সেটাকেই তিনি প্রশস্ততাসহ একটি নির্ধারিত ভয়েস রেঞ্জের মাধ্যমে তিনি তার প্লেব্যাক ক্যারিয়ারে অগ্রসর হন।

সাথে সাথে তিনি আরও ভাল সুর এবং পিচের বিকাশ ও ব্যবহার ঘটিয়ে সামনের দিকে প্রভূত জনপ্রিয়তার আসন দখল করেছিলেন। দেখা যায়, হিন্দি চলচ্চিত্রের গানের কথাগুলো মূলত উর্দু কবিদের দ্বারা রচিত এবং এতে সংলাপসহ উর্দু শব্দের উচ্চতর অনুপাত ব্যবহারের রীতি রয়েছে। তাই কিছু সময়ের জন্য, লতা শফি নামে একজন উর্দু শিক্ষকের কাছ থেকে উর্দুতে পাঠ নিয়ে তার দক্ষতাকে শানিয়ে নিয়েছিলেন। এর ঠিক পরেই অভিনেত্রী মধুবালা দ্বারা পর্দায় লিপ-সিঙ্ক করা এবং সঙ্গীত পরিচালক খেমচাঁদ প্রকাশের ‘মহল (১৯৪৯)’ [Mahal] চলচ্চিত্রের ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি তুমুল হিট করেছিল যার জন্য লতাকে আর কোনোদিন পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

তাইতো গুণী মানুষেরা বলেন, এক অখণ্ডধার রাগের আলাপ ধুন— এ সবের দেশ নেই। ভাষা নেই। তা বয়ে চলে কালের যাত্রায়। এই যাত্রার নাম লতা মঙ্গেশকর। নীরব আত্মার বিপ্লব।

বিশ্ব সঙ্গীতের সব জাতি তার কাছে ঋণী। তিনিই পারেন শিল্প, দর্শন, চিত্রকলা, সিনেমা, নাটক, কবিতাকে তার সুরে জাগিয়ে দিতে। এই ঋণ চুকিয়ে দেওয়ার নয়। যে সময়ে তিনি এসেছিলেন সেই সময়ের সমগ্র মানব সভ্যতা তার ঋণ নত হয়ে স্বীকার করছে! লতা মঙ্গেশকর। এক নীরব আত্মা। সরস্বতী।

নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক