ছবি : সংগৃহীত

যেন নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ আর মেরিন ড্রাইভকে সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপদ করে গেলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের একটি চেকপোস্টে পুলিশ খুন করে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে। তার মৃত্যুর পর থেকে এই লেখা পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়কে বন্দুক যুদ্ধের আর কোনো খবর আসেনি।

২০১৭ সালের ৬ মে উদ্বোধনের পর থেকেই দেশি-বিদেশি পর্যটকের কাছে কক্সবাজারের বিনোদন মানেই ছিল এই মেরিন ড্রাইভ রোড। শুরুতে মানুষের উচ্ছ্বাস থাকলেও এই সড়ক ধীরে ধীরে পরিণত হয় এক আতঙ্কের নামে। ২০১৮ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করলে বাড়তে থাকে বন্দুকযুদ্ধ; নানন্দিক মেরিন ড্রাইভ পরিণত হয় মৃত্যুর জনপদে। 

আত্মরক্ষার জন্য পুলিশের গুলি চালানোর অধিকার একেবারেই আইনসিদ্ধ। আর সেই গল্পটাই আমরা ‘ক্রসফায়ার’ নামের এক বিশেষ বিষয়ে শুনে আসছি বহু বছর ধরে যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা দেশে বিদেশে।

২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের জুলাই, এই দুই বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সাথে মাদক ব্যবসায়ীদের ‘কথিত বন্দুক যুদ্ধের’ ঘটনাস্থল হিসেবে গণমাধ্যমের শিরোনামে ছিল বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা কক্সবাজারের কলাতলী থেকে টেকনাফের সাবরাং জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত বিস্তৃত পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ সড়ক। .

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে ৫১জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। তবে এর আগের বছর ২০২০ সালে প্রাণ হারানো ১৮৮ জনের অধিকাংশই মারা যান ৩০ জুলাইয়ের আগে।

একের পর এক 'বন্দুক যুদ্ধের' খবরে সন্ধ্যার পর মেরিন ড্রাইভে চলাচলই কিছুটা সীমিত হয়ে পড়ে। আতঙ্ক আর অজানা ভয়ে পর্যটক ও স্থানীয় মানুষজন সন্ধ্যার পর এই রোডে তেমন একটা যাতায়াত করতেন না। তারপর সেই ভয়ংকর ঘটনা।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের একটি চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। সিনহার মৃত্যুর পর থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়কে আর কোনো কথিত বন্দুকযুদ্ধ হয়নি। 

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে ৫১জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। তবে এর আগের বছর ২০২০ সালে প্রাণ হারানো ১৮৮ জনের অধিকাংশই মারা যান ৩০ জুলাইয়ের আগে।

সম্প্রতি এই হত্যার বিচার হয়েছে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। এই হত্যা হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও এসআই মো. লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। 

আত্মরক্ষার জন্য পুলিশের গুলি চালানোর অধিকার আছে। কিন্তু এসব বন্ধুকযুদ্ধের বেশিরভাগ কাহিনিই মানুষ বিশ্বাস করেনি। তাই বলা হচ্ছে, আইনের শাসনের জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই।

সিনহা একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর না হয়ে অতি সাধারণ নাগরিক হলে সুপরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা মাথার এই খুনকেও ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে বাহবা কুড়াতেন লিয়াকত ও প্রদীপ।

দেশের আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাই হয়ে উঠবে বিচারক? এই ব্যবস্থা কি অপরাধীদের শাস্তিদানের ক্ষেত্রে নিদর্শন হয়ে উঠবে, না কি আমরা ভরসা রাখব বিচারব্যবস্থার উপর?

‘বিচারের বাইরে গিয়ে বিচার’ আমাদের সংবিধান প্রদত্ত বিচারব্যবস্থার উপর চরম অনাস্থার নিদর্শন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসবের তদন্ত হয় না। এভাবে দেশের বিচারব্যবস্থাকে ড্রেসিংরুমে বসিয়ে রেখে কোনো অপরাধই দমন করা যায় না। 

সিনহা হত্যার আগে অসংখ্য হত্যার ঘটনায় প্রচারের আলোকপ্রাপ্তি ঘটেনি, তাই আমাদের বিবেকও এখানে থেকে গিয়েছে নিষ্প্রভ এবং স্বাভাবিকভাবেই মোমবাতির শিখাও জ্বলেনি পথে পথে। এখন তাই বড় প্রশ্ন এসেছে যে, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে সংশ্লিষ্ট সবাই সক্রিয় হবেন কি না।

দেশের আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাই হয়ে উঠবে বিচারক? এই ব্যবস্থা কি অপরাধীদের শাস্তিদানের ক্ষেত্রে নিদর্শন হয়ে উঠবে, না কি আমরা ভরসা রাখব বিচারব্যবস্থার উপর?

নিশ্চয়ই বিচারব্যবস্থার উপরই বিশ্বাস আর আস্থা রাখতে হবে আমাদের। তবে একথাও ঠিক, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতায় বড় বড় অপরাধের বিচার বিলম্বে মানুষ এই বন্দুকযুদ্ধকে কখনো কখনো উল্লাস প্রকাশ করে সমর্থনও করেছে। ঘটনার ভয়াবহতা যখন মানুষকে নাড়িয়ে দেয়, তখন হয়তো সে বিচারিক প্রক্রিয়াকে ভুলতে বসে যেটা আমাদের কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। 

সরকার অপরাধীর বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীল। পুলিশকে কোনোভাবেই দুর্বল হতে দেওয়া হবে না। এগুলো মেনে নিয়েও আমাদের মনে রাখতে হবে কোনো অপরাধই বন্দুকের নলে সমাধান করা যায় না এবং সেখানে সুযোগ সৃষ্টি হয় নিরীহ মানুষের ভিকটিম হওয়ার। এখানে ভূমিকা প্রয়োজন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের যারা অনুসন্ধান করে দেখবেন প্রতিটি ঘটনার। 

পুলিশকে গুলি করলে পাল্টা গুলি খাবেই। কিন্তু এই বিধানের কারণে পুলিশ গুলি করার ক্ষেত্রে অসংবেদনশীল হয়ে উঠছে কি না সেই বিবেচনা প্রয়োজন। ভাবনা প্রয়োজন কেন বিচার প্রক্রিয়া দ্রুততর করা যায় না? কেন বন্দুকের নলে সমাধান ভাবনার সুযোগ আসে? ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে শৃঙ্খলা স্থাপন করার পন্থাটি প্রাচীন। এই আধুনিক যুগে এটা চলে না। সমস্যা করলেই গুলি—অপরাধীদের প্রতি এই বার্তা দিয়ে দারুণ সফল হওয়া সম্ভব না। গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে এরকম ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হলে তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া কখনো কখনো যে প্রবল ও তীব্র হয় তার প্রমাণ সিনহা হত্যার ঘটনা। সর্বক্ষেত্রে অপরাধ দমনের পথটি নীতিসম্মত হতেই হবে। 

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি