১৯৯০ সালের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি খণ্ডকালীন ৬ বছর ‘দৈনিক সংবাদ’-এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছি। এরপর স্থায়ীভাবে চাকরিতে যোগ দিয়েছি। সরকারের ওয়েজ বোর্ডের ঠিক করে দেয়া স্কেলে বেতন পেতে শুরু করেছি। আমার এক বন্ধু, যে সৌদি আরবে গিয়ে অড জব করছিল, তার বাবা একদিন জানতে চাইলেন কি করছি। সাংবাদিকতার কথা বললাম। তিনি বললেন, ‘তুমি সাংবাদিক তা তো জানি, কিন্তু ইনকাম করার মতো কি করো?’

এটা একটা উদাহরণ মাত্র। আমার মনে হয় সহকর্মীদের আরও অনেককে এ রকম প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এর অর্থ-অনেকেরই ধারণা সাংবাদিকতা একটা শখের কাজ, এইখানে কোনও আয়-রোজগার নেই, সাংবাদিকরা অন্য চাকরির পাশাপাশি এটা করে থাকেন।

এ ধারণা এমনি এমনি তৈরি হয়নি। পাকিস্তান আমলে কিংবা স্বাধীনতার পরে আমাদের পূর্ব পুরুষরা খেয়ে না খেয়েই সাংবাদিকতা করেছেন। অনেকে রাতে অফিসে নিউজপ্রিন্ট বিছিয়ে তার উপর রাত কাটাতেন। এটা আর দশটা চাকরির মত ছিল না, সাংবাদিকতা ছিল প্যাশন, একটা নেশা। মালিকরা যা দিতেন তাতেই তারা সন্তুষ্ট থাকতেন।

তুমি সাংবাদিক তা তো জানি, কিন্তু ইনকাম করার মতো কি করো?

পরবর্তীতে গণমাধ্যমে আর্থিক শৃঙ্খলা অনেকখানি ফিরেছিল। সরকার ওয়েজ বোর্ড গঠন করে সংবাদপত্র সেবীদের ন্যূনতম বেতন-ভাতা ঠিক করে দেয়। আমি ১৯৮৩ সালের শেষের দিকে দৈনিক সংবাদে কাজ শুরু করি এবং তখন থেকে এ বিষয়টি ভেতর থেকে দেখতে-জানতে পারি। ওই সময় মূলধারার গণমাধ্যমে বেতন-ভাতা কমবেশি নিয়মিত ছিল। সমস্যা দেখা দেয় এরশাদের পতনের পর। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরে আসার সুযোগে সংবাদপত্র, পরবর্তীতে বেসরকারি টেলিভিশন, আরও পরে অনলাইন পত্রিকার সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে।

মিডিয়ার সংখ্যা যখন বেড়ে যায়, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আয় কমে যায়, আর্থিক সংকট এবং নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। গত কয়েক বছর ধরে অনেকগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় অন্যান্য মিডিয়া আরও চাপে পড়েছে।

করোনা মহামারির শুরুর দিনগুলোতে জীবন-যাত্রা যখন স্থবির, চলাচল থেমে গেছে, হকাররা বের হতে পারেননি, আবার অনেকেই করোনা ছড়ানোর আতঙ্কে বাড়িতে পত্রিকা রাখতে চাননি, তখন ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছিল ঘর বন্দী মানুষের কাছে সরাসরি তথ্য পৌঁছানোর প্রধান মাধ্যম। জীবন বাঁচাতে মানুষ যখন আশ্রয় নিয়েছে ঘরে, তখন জনগণকে তথ্য সেবা দেয়ার প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মিডিয়ার কর্মীদের থাকতে হয়েছে বাইরে।

করোনার মধ্যে মিডিয়ার নিউজ রুমগুলোর প্রস্তুতি একেক জায়গায় ছিল একেক রকম। কোথাও কর্মীদের প্রতি কর্তৃপক্ষ অনেক যত্নশীল। আবার কোথাও উদাসীন। যেখানে বেতন-ভাতা ঠিকমতো দেয়া হয়না সেখানে সঠিক সুরক্ষার ব্যবস্থা আশা করাও যায় না। এ রকম পরিস্থিতিতে সংবাদকর্মীরা নিজেরা যতটুকু পেরেছে তা দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছে। মিডিয়ার প্রায় চারশো কর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। কয়েকজন জীবনও দিয়েছেন। সেকারণে অনেক বাড়িওয়ালা সংবাদকর্মীদের বাড়িতে থাকতে দিতে চাননি।

একটি টেলিভিশনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন এক নারী সাংবাদিক। তিনি তার স্বামী, সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে নিজে চার মাস একা ঢাকায় থেকে কাজ করেছেন। এটা তো তার পেশার জন্য বড় ত্যাগ। এই ধরনের অনেক ঘটনা আছে।

টিভি সাংবাদিকদের প্রধান সংগঠন ব্রডকাষ্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি) বছর দুই আগে দেশে সম্প্রচারে থাকা ৩০টি টেলিভিশনের হাল হকিকত নিয়ে জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা যায় প্রায় অর্ধেক টেলিভিশনে বেতন অনিয়মিত, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট-বোনাস হয় না ২০টির মতো টেলিভিশনে, খরচ কমাতে ১০টিতে কর্মী ছাটাই শুরু হয়েছে, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্রাচুইটি সুবিধা আছে মাত্র দুটি চ্যানেলে।

করোনার প্রথমদিকে একজনের টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ এলে তার কাছাকাছি যারা ছিলেন তাদের সকলকে কোয়ারেন্টিনে পাঠাতে হয়েছে। একটা নিউজ চ্যানেলের ৪০ জনকে একসঙ্গে অফ রাখতে হয়েছিল। কখনও কখনও মনে হচ্ছিল, চ্যানেল হয়তো বন্ধ রাখতে হতে পারে। শেষ পর্যন্ত সেটা করতে না হলেও একটি চ্যানেলের বার্তা বিভাগ দুই সপ্তাহ বন্ধ ছিল।

সাংবাদিকতা আর দশটা চাকরির মত নয়, এটি তথ্য জানানোর মাধ্যমে জনসেবা করার একটি মিশন। স্বাস্থ্য সেবা যাদের দায়িত্ব এবং শপথ গ্রহণ করে যারা এ পেশায় এসেছেন সেই স্বাস্থ্যকর্মীদের হাসপাতালে রাখতে যখন সরকারকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়েছে তখন ঠিকমত বেতন না পেয়েও সাংবাদিকরা মাঠে থেকেছেন, আক্রান্ত হয়েছেন, জীবনও দিয়েছেন, কিন্তু এজন্য প্রণোদনা দূরে থাক, কাজের স্বীকৃতিটুকুও সেভাবে মেলেনি।

টিভি সাংবাদিকদের প্রধান সংগঠন ব্রডকাষ্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি) বছর দুই আগে দেশে সম্প্রচারে থাকা ৩০টি টেলিভিশনের হাল হকিকত নিয়ে জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা যায় প্রায় অর্ধেক টেলিভিশনে বেতন অনিয়মিত, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট-বোনাস হয় না ২০টির মতো টেলিভিশনে, খরচ কমাতে ১০টিতে কর্মী ছাটাই শুরু হয়েছে, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্রাচুইটি সুবিধা আছে মাত্র দুটি চ্যানেলে।

আগের সমস্যাগুলোর সঙ্গে করোনার ধাক্কা মিলিয়ে এখন এ পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। করোনার আগে থেকেই গণমাধ্যম আর্থিক সংকটে ভুগছিল। বিজ্ঞাপন হচ্ছে সংবাদপত্রের আয়ের বড় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আয়ের একমাত্র উৎস। সেটা কমে যাচ্ছে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মসহ নানা দিকে ভাগ হচ্ছে। এর উপর করোনা ভাইরাসের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। এর প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। খরচ কমাতে কর্মী ছাটাই, বেতন-ভাতা কমানোর মত ব্যবস্থা নিচ্ছে বেশ কিছু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান। বাড়ছে এই পেশার অনিশ্চয়তা।

দীর্ঘদিনের ব্যবসা সফল কয়েকটি মিডিয়া হাউস সম্প্রতি বড় সংখ্যায় কর্মী ছাটাই করেছে। বহু বছর ধরে শক্ত আর্থিক ভিত্তির এরকম প্রতিষ্ঠানের চাকরিও এখন ঝুঁকির মুখে। এ থেকেই বোঝা যায় গণমাধ্যমের অবস্থা এখন কতটা নাজুক এবং সাংবাদিকরা কতটা আর্থিক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছেন। সম্ভবত: এখন আমরা আবার সেই পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছি যে, সাংবাদিকতা হচ্ছে স্বেচ্ছাশ্রম কিংবা শখের বিষয়।

এ পরিস্থিতির জন্য কয়েকটি কারণের কথা আগেই বলেছি। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলও মিডিয়ার অনুমতি দেয়ার সময় আদৌ এর চাহিদা বা প্রয়োজন আছে কিনা, মিডিয়ার আয়ের মূল উৎস বিজ্ঞাপনের বাজার কেমন, উদ্যোক্তার মোটিভ-ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা না করে রাজনৈতিক বা অন্য কোনও প্রভাবে ছাড়পত্র দেয়ার অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত।

রেজোয়ান হক ।। হেড অব নিউজ, মাছরাঙা টিভি

rejoan@gmail.com