সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী হিসেবে মাঝে মাঝে জাতীয় দৈনিকে সর্বজনীন সমস্যাগুলো নিয়ে লেখালেখি করতে হয়। সমকালীন বেশকিছু বিষয়ে লেখার আগ্রহ থাকলেও সবসময় হয়ে ওঠে না। তবে, সাংবাদিকতার আজন্ম শিক্ষার্থী, পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের সুবাদে এ পেশার সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয় হয়েছে। সেই সুবাদে দেশের রাজধানী এবং রাজধানীর বাইরে থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক গণমাধ্যমের সংবাদ-মতামতের উপস্থাপন সম্পর্কে খেয়ালও রাখতে হয়। গণমাধ্যম-গবেষক হিসেবে সেসব বিষয়ে আধেয় বিশ্লেষণও করা হয়।

২০২১ সালের মার্চ মাস। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য-বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তখন জাতীয় ইস্যু। বিশেষ করে তৎকালীন উপাচার্যের অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির বিষয়টি ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ ছিল। এটি নিয়েই মূলত ঢাকা পোস্টে আমার লেখা শুরু। যদিও বর্তমান বছরে এসে নিয়মিত লেখায় ছন্দপতন ঘটেছে ব্যস্ততা অনেক বেড়ে যাওয়ায়।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে মুদ্রিত সংবাদ-মাধ্যমের চাহিদায় অনেকাংশে ভাটা পড়েছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২০ সালে এসে মুদ্রিত সংবাদ-মাধ্যমের রোববারের (ছুটির দিন) প্রচার সংখ্যা ২০১৯-এর তুলনায় ৬ শতাংশ কমেছে।

শুধু তথ্য দেওয়া বা বিনোদিত করা; প্রভৃতির মধ্যেই গণমাধ্যমের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ নয়। সমাজের প্রহরী হিসেবে সাধারণ সমস্যাবলী সঠিক ও নির্ভুলভাবে পাঠক-দর্শকের সামনে উপস্থাপন করাটাও বড় চ্যালেঞ্জ। তথ্যের মহাপ্লাবনের যুগে প্রশ্ন উঠেছে, প্রচার-মাধ্যম কি সত্যি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছে?

নিউ ইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্টের মতো স্বনামধন্য পত্রিকার রাজস্বও বেশ কমেছে। Poynter-এর তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারির কঠিন মুহূর্তে মার্কিন মুলুকে ৮৫টি স্থানীয় পত্রিকা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। ২০০৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে এক হাজার ৮০০টি পত্রিকা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৭০০টি ছিল সাপ্তাহিক এবং ছোট ছোট শহর থেকে প্রকাশিত। টিকে থাকার স্বার্থে মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলো অনলাইন ভার্সনে প্রকাশে বাধ্য হচ্ছে। সেই সাথে এ সময়ে সংবাদ পোর্টালের সংখ্যা ও চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া আমাদের চেয়ে অনেক আগেই শুরু হয়েছে। ১৯৯০-এর শুরুতে ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সংযোগ নিতে ব্যর্থ হওয়ার পর ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মেলাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের প্রায় শেষের দিকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংবাদ-মাধ্যমে এর ছোঁয়া লাগে। বিশ্বব্যাপী তরুণ সমাজ তাদের প্রত্যাশিত তথ্য ও সংবাদ পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমসহ অনলাইন নির্ভর সংবাদ পোর্টালের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

২০২১ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৯৭ শতাংশ তরুণ স্মার্টফোন, কম্পিউটার বা ট্যাবলেটের মাধ্যমে প্রতিদিন অনলাইন সংবাদ পোর্টাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যানটা মার্কিন পরিসংখ্যানের সাথে তাল মেলাতে না পারলেও বাংলাদেশি তরুণরা তথ্য পাওয়ার উৎস হিসেবে সংবাদ পোর্টালের দিকে ঝুঁকছে— এটা অস্বীকারের উপায় নেই। এ কারণে ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদপত্রগুলো মুদ্রণের পাশাপাশি অনলাইন সংস্করণের দিকে ঝুঁকেছে।

সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সরকার ৯২টি দৈনিক সংবাদপত্রের অনলাইন ভার্সন এবং ৮২টি সংবাদ পোর্টালকে নিবন্ধনের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। পরবর্তীতে আরও কয়েকটি সংবাদ পোর্টালকে নিবন্ধনের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী আরও কিছু পাইপ-লাইনে আছে।

একদিকে অনলাইন সংবাদ-মাধ্যম, অন্যদিকে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে তথ্যের মহাপ্লাবনে সঠিক তথ্য বেছে নেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়েছে। অপতথ্য ও ভুয়া তথ্যের ছড়াছড়িতে গণমাধ্যম ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের দায় আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তথ্য দেওয়া বা বিনোদিত করা; প্রভৃতির মধ্যেই গণমাধ্যমের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ নয়। সমাজের প্রহরী হিসেবে সাধারণ সমস্যাবলী সঠিক ও নির্ভুলভাবে পাঠক-দর্শকের সামনে উপস্থাপন করাটাও বড় চ্যালেঞ্জ। তথ্যের মহাপ্লাবনের যুগে প্রশ্ন উঠেছে, প্রচার-মাধ্যম কি সত্যি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছে?

ব্যয়বহুল ইন্টারনেট, উপযুক্ত আইনের অভাব, দক্ষ মানবসম্পদ, সর্বজনীন ইন্টারনেটের সুবিধা না থাকা, কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন, ভালো উদ্যোক্তার অভাবও অনলাইন নিউজ পোর্টালের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এত সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আত্মপ্রকাশের এক বছরে দেশের অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নিয়েছে ঢাকা পোস্ট

জনগণের মনোযোগকে সুনির্দিষ্ট দিকে না নেওয়া এবং চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করতে না পারলে ক্ষমতা-কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতাও গণমাধ্যমের থাকে বলে মনে হয় না।

সম্প্রতি বেশিরভাগ গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার অভিযোগ পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমের কল্যাণে সেগুলো ফলাও করে প্রচারিতও হয়। দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমের মালিকানা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে বন্দি। এসব গণমাধ্যম তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুগত থাকতে গিয়ে চতুর্থ স্তম্ভের দায়দায়িত্ব পালন করার সক্ষমতা হারাচ্ছে। গণমাধ্যমে ব্যবসায়িক ও খবরযোগ্য নয়— এমন সংবাদগুলোও এতটাই গুরুত্ব পাচ্ছে যে, সমাজের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সংবাদ প্রকাশের হার ক্রমশই কমছে। অন্যদিকে, সংবাদ-মাধ্যমের প্রধানরাও নানামুখী চাপের কথা স্বীকার করছেন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে সংবাদকর্মীদের দ্বারা সংবাদ হত্যায় বাধ্য হওয়ার বিষয়টিও উঠে এসেছে।

এছাড়া, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে সবার আগে তথ্য দিতে গিয়ে ভুল তথ্য প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে, যা সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপনের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এমনকি সংবাদে ভুল তথ্য থাকায় পাঠকও বিভ্রান্ত হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো যে তাদের ওপর ন্যস্ত চতুর্থ স্তম্ভের দায়িত্ব পালন সঠিকভাবে করতে পারছে না, এটি সহজেই অনুমেয়।

অন্যদিকে, ব্যয়বহুল ইন্টারনেট, উপযুক্ত আইনের অভাব, দক্ষ মানবসম্পদ, সর্বজনীন ইন্টারনেটের সুবিধা না থাকা, কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন, ভালো উদ্যোক্তার অভাবও অনলাইন নিউজ পোর্টালের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এত সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আত্মপ্রকাশের এক বছরে দেশের অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নিয়েছে ঢাকা পোস্ট। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে ভিজিট করা শীর্ষ দশটি ওয়েবসাইটের মধ্যে ষষ্ঠ, স্থানীয় ওয়েবসাইটের মধ্যে তৃতীয় অবস্থান করে নেয় অনলাইন এ প্রচার-মাধ্যম। অর্থাৎ এ কথা সহজেই বলা যায় যে, কম সময়ে পাঠকের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে ঢাকা পোস্ট।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় মোবাইল অপারেটরের টাওয়ার স্থাপন করে তথ্য চুরি, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ, মানব ও ইয়াবাপাচার নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে। মানবিক সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন সমস্যা, সম্ভাবনা, উদ্ভাবন, তারুণ্য— এসব বিষয়েও গুরুত্ব দিয়েছে ঢাকা পোস্ট

অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা পোস্টের বেশকিছু সংবাদ পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। বিশেষত, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় মোবাইল অপারেটরের টাওয়ার স্থাপন করে তথ্য চুরি, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ, মানব ও ইয়াবাপাচার নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে। মানবিক সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন সমস্যা, সম্ভাবনা, উদ্ভাবন, তারুণ্য— এসব বিষয়েও গুরুত্ব দিয়েছে ঢাকা পোস্ট।

তবে, একজন একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে ঢাকা পোস্টের কাছে দাবির জায়গাটা আরও বেশি। পাঠক ধরতে গিয়ে ওয়াচ-ডগ হওয়ার জায়গাটা কিছুটা নড়বড়ে হয়েছে বলে মনে হয়েছে। খবরের পেছনের খবর, যা কেউ প্রকাশে বাধার সৃষ্টি করে বা ধামাচাপা দিতে চায়— এমন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কম হয়েছে।

পক্ষ-বিপক্ষ জড়িত থাকে— এমন সংবাদ পত্রিকা হাউজে যাওয়ার পর এবং আগে খবরের তথ্যতত্ত্ব, নৈতিক বিষয়াদি, আইনি খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিবেদক ও সহ-সম্পাদকের মধ্যে আলোচনা করে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া জরুরি। সংবাদ তৈরি ও প্রকাশের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিলে প্রচার-মাধ্যম হিসেবে ঢাকা পোস্ট সত্যিকারের চতুর্থ স্তম্ভের দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে বলে বিশ্বাস করি।

ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রশাসক, জনসংযোগ দপ্তর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়