কুয়েতে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত শহিদ ইসলাম পাপুল ও দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আশিকুজ্জামান

মানবপাচারের মামলায় কুয়েতে বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন দেশটির একটি আদালত।

এ বিষয়ে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশিকুজ্জামান বলেছেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবসময় জিরো টলারেন্স অবস্থান বাংলাদেশ সরকারের। উনি (শহিদ ইসলাম পাপুল) এখানে কোনো সরকারি কাজে আসেননি, উনি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে কুয়েতে এসেছিলেন। বাংলাদেশি হিসেবে উনি বা তার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে আগে এবং এখনও কোন ধরনের সহযোগিতা চাওয়া হয়নি। পাপুলের মামলার বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই।’

তিনি বলেন, ‘পাপুলের কারাদণ্ডের বিষয়ে আমাদের কাছে দাপ্তরিকভাবে কাগজপত্র আসেনি, যতটুকু জেনেছি, স্থানীয় পত্রিকার মাধ্যমে।’

কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের এ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও মানবপাচরের আরও দুটি মামলা চলমান রয়েছে কুয়েতের আদালতে। এসব মামলার কী রায় হয় বা হবে সেই বিষয়ে আমাদের কিছুই করার নেই। এটা সম্পূর্ণ কুয়েত প্রশাসনের বিষয়।’

এদিকে, বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) কুয়েতের ফৌজদারি আদালতের বিচারক আবদুল্লাহ আল-ওসমান পাপুলের বিরুদ্ধে মানবপাচার মামলায় চার বছরের সাজা ঘোষণা করেন বলে দেশটির আরবি ভাষার দৈনিক আল-কাবাসের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, মানবপাচারের এই মামলায় পাপুলকে সহায়তাকারী কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মাজেন আল-জাররাহ এবং একজন মধ্যস্থতাকারী ও এক দালালকেও চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের আলোচিত সংসদ সদস্য পাপুল ও অন্য অভিযুক্তদের প্রত্যেককে ১৯ লাখ (৫৩ কোটি ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকা) করে কুয়েতি দিনার জরিমানা করা হয়েছে।

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল, ঘুষের বিনিময়ে দেশটিতে নাগরিকত্ব, পাসপোর্ট ও রেসিডেন্ট পারমিট বা বসবাসের অনুমতিসহ বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কাজে পাপুলকে সহায়তা করতেন মেজর জেনারেল মাজেন আল-জাররাহ।

কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকে গত বছরের ৬ জুন কুয়েতের মুশরিফ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেই সময় অন্তত পাঁচ বাংলাদেশি প্রবাসী এমপি পাপুলের মাধ্যমে পাচার হয়েছেন দাবি করে অভিযোগ করেন। কুয়েতের আদালতের বিচারক এই অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন।

পরে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর কুয়েতি কর্তৃপক্ষ অভিযোগ গঠন করে তার বিরুদ্ধে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার কাজ শুরু করে। এর দশদিন পর ২৮ সেপ্টেম্বর এই মামলার শুনানি শেষে রায় আনুষ্ঠানিকভাবে ২৮ জানুয়ারি ঘোষণা করা হবে বলে জানান আদালত।

পাপুলসহ পরিবারের সদস্যদের ৬১৩ ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ

গত ২৩ ডিসেম্বর কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল, তার স্ত্রী সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি সেলিনা ইসলাম, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান ও মেয়ে ওয়াফা ইসলামের নামে থাকা ৬১৩ ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ বা অবরুদ্ধে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

আদালতের অনুমতি নিয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে তদন্ত কর্মকর্তা কমিশনের উপ-পরিচালক সালাহউদ্দিন সই করা চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর পাঠানো হয়েছে। এদিকে তাদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানের মোট ৩০.২৭ একর জমি ও গুলশানের ফ্ল্যাট এটাচমেন্টের সিদ্ধান্তও নেয় দুদক।

পাপুলের আয়হীন শ্যালিকাই পাচার করেন ১৪৮ কোটি টাকা

১১ নভেম্বর কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল এবং স্ত্রী সেলিনা ইসলাম, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং মেয়ে ওয়াফা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দুই কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ১৪৮ কোটি টাকার লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে।

এজাহার সূত্রে জানা যায়, আসামিদের বিরুদ্ধে দুই কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ ও ১৪৮ কোটি টাকার লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের আড়ালে জেসমিন প্রধানের পাঁচ হিসাবের মাধ্যমে ২০১২ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত লন্ডারিং হয় ১৪৮ কোটি টাকা। অথচ ২৩ বছর বয়সী জেসমিনে নিজের কোনো আয়ের উৎস নেই।

অন্যদিকে, এফডিআর হিসাবের দুই কোটি ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৮ টাকার কোনো উৎস শ্যালিকা জেসমিন দাখিল করতে পারেননি। যে কারণে অবৈধ সম্পদের অভিযোগে কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল এবং তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং মেয়ে ওয়াফা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে তা ভোগ দখলে রাখার অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারায় অভিযোগ এবং প্রায় ১৪৮ কোটি টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২০১২ এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয় এজাহারে।

ঝামেলায় পাপুলের স্ত্রী-কন্যাও

অর্থপাচার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক আরেফিন আহসান মিঞা স্বাক্ষরিত নথিও জালিয়াতি করেছেন কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও তাদের মেয়ে ওয়াফা ইসলাম।

ওই উপপরিচালকের ‘স্বাক্ষর’ ও মন্তব্য জালিয়াতির মাধ্যম নিজেদের দায়মুক্তি দিয়ে হাইকোর্টে নথি জমা দেন পাপুলের স্ত্রী-কন্যা। নথি জালিয়াতির বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে এলে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি তলব করেন আদালত। নথি তলবে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়লে এ ঘটনায় রায়ের জন্য আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন হাইকোর্ট।

এদিকে, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে দুদকের করা মামলায় গত ২২ ডিসেম্বর বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ তাদের জামিন নামঞ্জুর করে ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। ২৭ ডিসেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পান তারা।

সংসদ সদস্য পদ হারাতে পারেন পাপুল

কুয়েতের আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় বাংলাদেশে সংসদ সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি পাবেন পাপুল। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুপারিশ পেলে সংসদ সচিবালয় লক্ষ্মীপুর-২ আসনের বহুল আলোচিত এই সংসদ সদস্যের পদ শূন্য ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেবে। তবে পাপুলের সংসদ সদস্য বাতিল ঘিরে কোনও জটিলতা দেখা দিলে সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন (ইসি) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ বলছে, কোনও সংসদ সদস্য নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবেন না।

সাদেক রিপন/এফআর