নিউইয়র্কের ওজনপার্ক : বাংলাদেশিদের রক্তে রঞ্জিত
ওজনপার্কে অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত মোদাচ্ছের খন্দকার
নিউইয়র্ক সহে না আর খুনোখুনিতে নিহত লাশের ওজন। বাংলাদেশি অভিবাসীর রক্তে রঞ্জিত ওজনপার্ক। একে একে বাড়ছে বাংলাদেশি অভিবাসী মানুষ খুনের সংখ্যা। নির্মম খুনের ভার ধারণের সহ্যশক্তি এখন কারো নেই। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় শোকে স্তব্ধ পরিবার। প্রতিবেশী-স্বজন-শুভাকাঙ্ক্ষীরা সহ্য সীমা হারিয়ে বোবা কান্নার আর্তনাদে মাতম বিলাপ করছেন। শোকের মাতমে ভারী হচ্ছে এই নগর।
গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত পৌনে ১টায় ওজনপার্কে অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন মোদাচ্ছের খন্দকার (৩৬) নামের এক বাংলাদেশি। এরপর সমগ্র বাংলাদেশি কমিউনিটি নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন উৎকণ্ঠিত। অভিবাসীদের স্বর্গরাজ্য নিউইয়র্ক এখন অনেকটা ভয়ঙ্কর অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য! সিটির পাতাল রেল (সাবওয়ে) স্টেশনগুলোতে মানবরূপী যমদূত কখন যে কার ওপর হামলে পড়ে কারো জানা নেই।
বিজ্ঞাপন
গত ২২ জানুয়ারি সিটির প্রাণকেন্দ্রে নিউইয়র্ক পুলিশের দুই কর্মকর্তা অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন। এই ঘটনার পর নিউইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক অ্যাডাম বলেছেন, এই নগরীতে অগ্নেয়াস্ত্র তৈরি হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য রাজ্যগুলো থেকে এখানে অস্ত্র আসে। অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিউইয়র্ক হারতে পারে না।
ঘাতক-গুপ্তঘাতকের হাতে বছরের পর বছর ঝরছে একের পর এক তাজা প্রাণ। ঘাতকদের হাতে নির্মম খুনের ঘটনায় শোকের কষ্টে পাথর স্বজন-শুভাকাঙ্ক্ষীরা। নগরের এই মানবউদ্যান এখন লাশের পার্ক। এখানে দিনদুপুরে মানুষ খুন হয়। পালিয়ে যায় দুর্বৃত্ত। এই এলাকার বাসিন্দাদের ওপর দিন-দুপুরে হামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন-নিগৃহীত করা নিত্যদিনের মামুলি ব্যাপার! দুষ্ট ঘাতকদের জ্বালাতনে দিনে দিনে অতিষ্ঠ-অস্থির হয়ে ওঠেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন। দানবগুলোর একের পর এক ভয়ংকর ঘটনা, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন করে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও কেড়ে নিচ্ছে। সর্বত্র অজানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর শঙ্কা নিয়ে মানুষের দৈনন্দিন যাত্রা শুরু হয়। ঘরে ফেরার আগ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবেন কি ঘটবে বা কি ঘটতে যাচ্ছে। এমনই এক অদ্ভুত ঘুটঘুটে অন্ধকার অবস্থা বিরাজ করছে। এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতোটুকু ভালো খুব বেশি বলতে পারব না। তবে অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে যে কেউ স্বীকার করবেন। অভিবাসীদের স্বর্গরাজ্য নিউইয়র্কে নরকের তীব্র চিৎকার আকাশে বাতাসে বইছে! এ কেমন নির্মমতা, কেমন হিংস্রতা। এই বর্বরতার শেষ কোথায়?
বিজ্ঞাপন
নিউইয়র্ক সিটির বাংলাদেশি অধ্যুষিত ব্রুকলিন ও কুইন্সের সীমান্ত এলাকা ওজনপার্ক। ম্যানহাটন ডাউনটাউন ত্যাগ করে, চার দশক আগে ওজনপার্ক এলাকায় বাংলাদেশিরা বসতি গড়েন। এখন এখানে বিশাল কমিউনিটির বসবাস। অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসা-বাড়ির মালিকানা বাংলাদেশিদের। ৮/১০ মসজিদের নির্মাণ থেকে শুরু করে পরিচালনা করেন বাংলাদেশিরা। এখানে অনেক কিছুতে বাংলাদেশিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার পরও, কোথায় যেন একটা কিছুর কমতির অভাব তাড়া করে। এই দেশ আমার নয়! তারা আমার কেউ না! আমি তাদের কেউ না। আইন থাকলেও অনেক সময় আইনের লোক আমার হয় না! ন্যায়বিচারের জন্য ঘুরতে হয়। অপেক্ষা করতে হয়। অনেকেরই আক্ষেপ, জীবন যদি চলে যায় ন্যায়বিচার পেয়ে কী হবে? যে চলে যাওয়ার সে তো ফিরে আসবে না। এই সময়ের মধ্যে এই পরিবারের অভাব অনটন, কাঠখোট্টা মাড়িয়ে, অপরিমাণ চোখের জল ফেলতে হলো। এর খরব কি রাষ্ট্র জানে। অপরাধীর সাজা হলে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ করতে কেউ সাহস করবে না। আর যদি অপরাধী ধরা না পড়ে? রাষ্ট্র কি নেবে অপরাধের দ্বায় ভার।
এই ওজনপার্ক থেকেই বাঙালির অনেক কিছুর যাত্রা হয়েছে। এখান থেকে প্রবাসের অনেক আঞ্চলিক সামাজিক সাংস্কৃতিক, সংঘ, সংস্থা, সংগঠন, সমিতির জন্ম হয়েছে। ঠিক একইভাবে ৮০ দশকে এখান থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা ও যাত্রা শুরু হয়। শুরু হয় অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা ও কার্যক্রম। সংঘবদ্ধ বিশাল জনগোষ্ঠীর বসবাস, ভিনদেশের সঙ্গে সহাবস্থান তবুও অপরাধীরা বেপরোয়া। নিরাপদ সুশৃঙ্খল জীবনযাপন, জীবনের নিরাপত্তা, পারিবারিক সমৃদ্ধির জন্যই বাংলাদেশের মানুষজন, প্রিয় স্বদেশ-স্বজন, বাবা-মা, ভাই-বোন, পরিবার-পরিজনদের কথা ভুলে প্রবাস জীবনকে বেছে নেয়। প্রবাসের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনার মাঝে কখন অজ্ঞাত ঘাতক পিছু নেয়, কারোরই জানা নেই। স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রিয়জনেরা শুধু নির্বাক হন না, দিশেহারা হয়ে পড়েন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী সন্তানকে হারিয়ে পথে নামতে হয়। নেমে আসে দুর্বিসহ অভাব-অনটনের কষ্টের দিন। প্রিয়জন হারানোর বেদনায়, কতো স্বজনেরা মানসিক যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ হয়ে যান।
অনেকে মনে করেন, এই এলাকাটি দিনদিন আতঙ্কের জনপদ হয়ে ওঠেছে। মোদাচ্ছের খন্দকারকে ওজন পার্কে আল আমান মসজিদের সামনে তার নিজ বাড়ির কাছেই গুলি করে হত্যা করা হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার দিবাগত রাত পৌনে ১টার দিকে সাইপ্রেস হিলস এলাকা থেকে একজন গুলির শব্দ শুনে পুলিশে ফোন দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আহত মোদাচ্ছেরকে উদ্ধার করে। তাকে বাঁচাতে জ্যামাইকা হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে যাওয়ার পথেই মারা যান ৩৬ বছর বয়সের মোদাচ্ছের।
ব্রুকলিন ও কুইন্সের সীমান্তের ওজনপার্ক এলাকাটি বাংলাদেশিদের জন্য আতঙ্কের স্থান হয়ে উঠেছে। আর আগে প্রায় একই এলাকায় সাংবাদিক মিজানুর রহমান মিজানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালে ওজনপার্কের মসজিদে ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে এক দুর্বৃত্তরা। আওয়ামী লীগ নেতা নাজমুলও একই এলাকায় হামলার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়ে ছিলেন। একের পর এক ঘটনায় নিউইয়র্কে প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। পুলিশ ঘটনা তদন্ত করলেও প্রবাসীরা এটিকে বিদ্বেষপূর্ণ হামলা বলে মনে করছেন। নিহত মোদাচ্ছের খন্দকারের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে। তার স্ত্রী ও চার বছরের একমাত্র সন্তান লাবিব খন্দকার রয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় নিউইয়র্কে বসে যখন এই প্রতিবেদনটি লিখছি, তখনই সিটির ব্রুকলিন এলাকায় কমপক্ষে ২০ রাউন্ড এলোপাথাড়ি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। অতর্কিত এই হামলায় দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকেই। এমন খবর নিশ্চিত করেছে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো।
নিউইয়র্ক স্টেট পুলিশ বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, নিউইয়র্ক সিটিতে অপরাধ কর্মকাণ্ড আগের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। সিটি মেয়র এরিক এ্যাডাম স্বীকার করেছেন, বাইরে থেকে অবৈধ অস্ত্র আসা বন্ধ করতে হবে। এখানে যে বাংলাদেশি কমিউনিটির মানুষ যে হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন- এমন নয়। এই নগরে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও অস্ত্রধারীদের বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটছে। ডাকাতি ছিনতাই রাহাজানি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয় দাঁড়িয়েছে। পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, নিউইয়র্ক সিটিতে ভয়াবহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।
লেখক : সাংবাদিক ও সমাজ অনুশীলক। নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।