প্রতীকী ছবি

আজ (৮ মার্চ) আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রতি বছর নারী দিবসে নানা আলোচনা হয়। নারীর অধিকার, অগ্রগতি, শিক্ষা, ক্ষমতায়ন, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, বৈষম্যহীন কর্মক্ষেত্র ও আর্থিক স্বনির্ভরতা ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তর পর্যালোচনা হয়। নারী দিবসের সেসব আলোচনায় নারীর মেধা-মনন, শ্রম ও সততা এবং নারীর অপ্রাপ্তিগুলো অগ্রাধিকার পায়।

নারীর অধিকার সংরক্ষণ করার বিষয়টিকে আল্লাহ তাআলা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। যারা নারীর অধিকার খর্ব করে এবং তাদের সঙ্গে বৈরিতামূলক আচরণ করে তাদের ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। নারীর অধিকার বিষয়ে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে অনেক আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। তাতে নারীর অধিকার, মর্যাদা ও তাদের মূল্যায়ন সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। এমনকি নারী নামে একটি সুরাও অবতীর্ণ করেছেন, যার নাম ‘সুরা আন-নিসা’। পবিত্র কোরআনে ‘নিসা’ অর্থাৎ ‘নারী’ শব্দটি ৫৭ বার এসেছে। ‘ইমরাআহ’ অর্থাৎ ‘মহিলা’ শব্দটি এসেছে ২৬ বার।

মানবতার ধর্ম ইসলাম নারীকে প্রতিযোগী না ভেবে সহযোগী মনে করতে শিক্ষা দিয়েছে। ইসলামে নারীবিষয়ক বিধানগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মোদ্দাকথা, ইসলাম নারীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। দিয়েছে নারীর সবকিছুর নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ সম্মান।

নারীর সামাজিক মর্যাদা, তাদের করণীয়, নারী অধিকার, বিয়ে, ঘর-সংসার ও তালাক ইত্যাদি সুরা নিসায় স্থান পেয়েছে। কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে নারীবিষয়ক যেসব দিক-নির্দেশনা রয়েছে, ঢাকা পোস্টের পাঠকদের জন্য সেগুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরা হলো-

নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা
সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ইসলাম দিকনির্দেশক। প্রাক-ইসলামি যুগে নারীর কোনো সামাজিক অধিকার ও সম্মানবোধ ছিল না। নবজাত কন্যাশিশুকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো এবং পুরুষরা নারীকে শুধু ভোগের জন্য ব্যবহার করতÑ তখন মহানবী (সা.) সৎকর্মে নারী ও পুরুষের সমমর্যাদার কথা বলেন। তিনি জানিয়ে দেন, ‘পুরুষ অথবা নারীর মধ্যে কেউ সৎকাজ করলে ও মুমিন হলে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও জুলুম করা হবে না।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১২৪)

নারী-পুরুষের স্বকীয়তা
নারী-পুরুষের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মহান আল্লাহ কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের ওপর নারীদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের নারীদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। কিন্তু কেউ যেন কারও বৈশিষ্ট্য বা অধিকার নিয়ে বিতর্ক না করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা সেসব কিছুর আকাক্সক্ষা কোরো না, যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের একজনকে অন্যজনের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। পুরুষদের জন্য রয়েছে অংশ, তারা যা উপার্জন করে তা থেকে এবং নারীদের জন্য রয়েছে অংশ, যা তারা উপার্জন করে তা থেকে। আর তোমরা আল্লাহর কাছে তার অনুগ্রহ চাও। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।’  (সুরা নিসা, আয়াত: ৩২)

নারীর প্রতি উদারতা প্রকাশ
নারীকে কোনো প্রকার কষ্ট দেওয়া ও মোহরানা ফেরত নেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি সদয় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, জোর করে নারীদের উত্তরাধিকার হওয়া তোমাদের জন্য হালাল নয়। আর তোমরা তাদের যা দিয়েছ, তা থেকে কিছু নিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের আবদ্ধ করে রেখো না; তবে যদি তারা প্রকাশ্য অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়। আর তোমরা তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে বসবাস করো। আর যদি তোমরা তাদের অপছন্দ করো, তবে এমনও হতে পারে যে, তোমরা কোনো কিছুকে অপছন্দ করছ আর আল্লাহ তাতে অনেক কল্যাণ রাখবেন। আর যদি তোমরা এক স্ত্রীর পরিবর্তে অন্য স্ত্রীকে বদলাতে চাও, আর তাদের কাউকে তোমরা প্রচুর সম্পদ দিয়ে থাকো, তবে তোমরা তা থেকে কোনো কিছু নিয়ো না। অপবাদ এবং প্রকাশ্য গুনাহের মাধ্যমে কি তোমরা তা নেবে? আর তোমরা তা কীভাবে নেবে অথচ তোমরা একে অপরের সঙ্গে একান্তে মিলিত হয়েছ; আর তারা তোমাদের থেকে নিয়েছিল দৃঢ় অঙ্গীকার?’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৯-২১)

নারীদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা
পিতামাতা, নিকটাত্মীয় ও স্বামীর সম্পত্তিতে রয়েছে নারীর সম্মানজনক অধিকার। যেকোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীরা যে অর্থসম্পদ উপার্জন করবেন এবং উত্তরাধিকারসূত্রে যে ধন-সম্পদের অধিকারী হবেন, এতে ইসলাম নারীকে পুর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতামাতা আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, তা অল্পই হোক বা বেশিই হোক, এক নির্ধারিত অংশ।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৭)

ইবাদতের ক্ষেত্রে সমান প্রতিদান
আল্লাহ তাআলা ইবাদত-বন্দেগি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভে নারীদের পুরুষের সঙ্গী বানিয়েছেন। উভয়কে একই কাজের আদেশ দেওয়া হয়েছে। সবাইকে তাদের ইখলাস, চেষ্টা ও কর্ম অনুযায়ী সওয়াব ও বিনিময় দেওয়া হবে। কারও প্রতি বৈষম্য করা হবে না।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও নারী, মুমিন পুরুষ ও নারী, অনুগত পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, বিনয়াবনত পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, সিয়ামপালনকারী পুরুষ ও নারী, নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাযতকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারী, তাদের জন্য আল্লাহ মাগফিরাত ও মহা প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন।’ (সুরা আহজাব, আয়াত: ৩৫)

মোহরানা পরিশোধ ফরজ
নির্ধারিত মোহরানা আদায় করা ফরজ। মোহরানাতে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করাকে আল্লাহ তাআলা হারাম করেছেন। তবে স্ত্রী নিজের পক্ষ থেকে কিছু কমিয়ে দিলে বা ক্ষমা করে দিলে ভিন্ন কথা। তখন তা থেকে গ্রহণ করা স্বামীর জন্য অবশ্যই হালাল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা নারীদের সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও, অতঃপর যদি তারা তোমাদের জন্য তা থেকে খুশি হয়ে কিছু ছাড় দেয়, তাহলে তোমরা তা সানন্দে তৃপ্তি সহকারে খাও।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৪)

নারীর জন্য খরচ করার বিধান
নারীর জন্য ব্যয় করার বিষয়ে মহান আল্লাহ নিখুঁত একটি নীতি-বিধান দিয়েছেন। যখন নারীর সঙ্গে ঘর-সংসার করা হবে, তখন নারীর যাবতীয় খরচপাতি স্বামীকেই বহন করতে হবে। আর যদি ঘর-সংসার করা কোনোভাবেই সম্ভব না হয়, তখন দয়া ও অনুগ্রহের সম্পর্ক ছিন্ন করবে। এতে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি করবে না। আর সবসময় তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের কোনো অপরাধ নেই, যদি তোমরা স্ত্রীদের এমন অবস্থায় তালাক দাও যে, তোমরা তাদের স্পর্শ করোনি কিংবা তাদের জন্য কোনো মোহর নির্ধারণ করোনি। আর উত্তমভাবে তাদের ভোগ-উপকরণ দিয়ে দাও, ধনীর ওপর তার সাধ্যানুসারে এবং সংকটাপন্নের ওপর তার সাধ্যানুসারে। সুকর্মশীলদের ওপর এটি আবশ্যক। আর যদি তাদের স্পর্শ করার পূর্বে তোমরা তাদের তালাক দাও এবং তাদের জন্য কিছু মোহর নির্ধারণ করে থাকো, তাহলে যা নির্ধারণ করেছ তার অর্ধেক (দিয়ে দাও)। তবে স্ত্রীরা যদি মাফ করে দেয় কিংবা যার হাতে বিবাহের বন্ধন সে যদি মাফ করে দেয়। আর তোমাদের মাফ করে দেওয়া তাকওয়ার অধিক নিকটতর। আর তোমরা পারস্পরিক অনুগ্রহ ভুলে যেয়ো না। তোমরা যা করো, নিশ্চয় আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৩৬-২৩৭)

পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসা
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোনো ঝগড়া-বিবাদ দেখা দিলে, তা মীমাংসার জন্য আল্লাহ তাআলা কিছু নীতিমালা ঠিক করে দিয়েছেন। স্ত্রী যদি স্বামীর অবাধ্য হয়, তখন তার সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হবে, আর স্বামী যদি স্ত্রীর সঙ্গে বাড়াবাড়ি করে, তখন স্ত্রীর করণীয় কী হবে তা বলে দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি কোনো নারী তার স্বামীর পক্ষ থেকে কোনো দুর্ব্যবহার কিংবা উপেক্ষার আশঙ্কা করে, তাহলে তারা উভয়ে কোনো মীমাংসা করলে, তাদের কোনো অপরাধ নেই। আর মীমাংসা কল্যাণকর; তবে মানুষের মধ্যে কৃপণতা বিদ্যমান রয়েছে। আর যদি তোমরা সৎকর্ম করো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো তবে তোমরা যা করো, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত। (সুরা নিসা, আয়াত : ১২৮)

কন্যার প্রতি বৈষম্য নিরসন
যারা মেয়েদের অপছন্দ ও ঘৃণা করে আল্লাহ তাআলা তাদের ভর্ৎসনা ও তিরস্কার করেন। তিনি বলেন, ‘আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয়েছে, সে দুঃখে সে জাতির কাছ থেকে আত্মগোপন করে। অপমান সত্ত্বেও কি একে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে? জেনে রেখো, তারা যা সিদ্ধান্ত নেয়, তা কতই না মন্দ!’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৫৮-৫৯)

নারীদের মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার শাস্তি
সৎ ও পবিত্র নারীদের যারা অপবাদ দেয়, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যারা সচ্চরিত্র সরলমনা মুমিন নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ (সুরা নুর, আয়াত: ২৩)

পারস্পরিক ভালোবাসা আল্লাহর নিদর্শন
বিয়ে আল্লাহর মহান নিদর্শন। এর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী মাঝে প্রেম-ভালোবাসা ও পারস্পরিক অনুগ্রহ তৈরি হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে সে জাতির জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে, যারা চিন্তাভাবনা করে।’ (সুরা রুম, আয়াত : ২১)

লেখক : ফতওয়া-গবেষক ও  সাংবাদিক