রীতিমতো গোলকধাঁধাঁয় পড়ে গিয়েছিলাম। প্যাকেনহাম থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেকের পথ। রিচমন্ড মেট্রো স্টেশনে নেমে ৬ মিনিটের হাঁটা দূরত্ব। তারপর যে রাজ্যে পা রাখলাম-সেখানটা এতোটাই বিশাল যে বারবারই হারিয়ে যাচ্ছিলাম, খুঁজে পাচ্ছিলাম না কিছুই। রেল স্টেশনের সীমানা পার হতেই সামনে অবারিত সবুজের দেখা মিলল। সেই পার্ক পার হতেই উঁচু সিঁড়ি। যার একটা একটা ধাপ পেরিয়ে চূড়ায় উঠতেই এমন একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেল যার জায়গাটা সত্যিকারের চূড়াতেই!

গ্রেট সাউদার্ন স্ট্যান্ড দিয়েই যখন প্রবেশ তখন প্রথমেই সামনে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। পাথুরে সেই স্ট্যাচু যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে। নীচে ছোট্ট করে স্যার ডনের ঈর্ষনীয় ক্যারিয়ারের কয়েকটা লাইনও তুলে ধরা হয়েছে। এটা তো ক্রিকেটপ্রেমী মাত্রই জানেন ৫২ টেস্টের ক্যারিয়ারে অস্ট্রেলিয়ান এই কিংবদন্তি ১৯২৮ থেকে ১৯৪৮ সালে করেছেন ৬৯৯৪ রান। যার গড় ৯৯.৯৪! এই রেকর্ড আর ভাঙা হবে না কারো!

তাকে এমন করে মনে রাখার কারণটাও সংগত, যে মাঠের গল্প বলতে যাচ্ছি সেই মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ক্যারিয়ারের ১১৭ প্রথম শ্রেণির শতরানের ১৯টি করেছেন। মেলবোর্নের এই জগত বিখ্যাত মাঠে পা রাখলে স্যার ডনের সেই স্ট্যাচুর সঙ্গে ছবি তোলাটা প্রথম কর্তব্য। সেই কাজটা সেরে এমসিজি মানে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডকে বুঝতে গিয়ে বৃষ্টি ভেজা দিনেও কেমন যেন ঘেমে উঠলাম। এতোটাই বিশাল যে-কূল কিনারা পাওয়ার উপায় যেন নেই!

স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রবেশের একটা ফটকই খোলা ছিল সেদিন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল ১৩ নভেম্বর, তার তিন দিন আগে ভ্রমণ। আমি মিডিয়া সেন্টারটাই খোঁজ করছিলাম। সেই খোঁজাখুজি বাদ দিয়ে একটা দলের সঙ্গে যোগ হয়ে গেলাম। যারা এই মাঠটা দেখতে এসেছেন। তাদের পুরো মাঠের ইতিহাস এটা সেটা বর্ণনা করছিলেন বয়সী এক গাইড। কথাগুলো যেভাবে বলছিলেন মনে হচ্ছিল চোখের সামনে সব ভাসছে। উঠে আসল ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপের ফাইনালের প্রসঙ্গটাও। যেখানে এই মাঠে মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তান-ইংল্যান্ড! তিনি ফিরে যাচ্ছিলেন সেই ব্র্যাডম্যানের যুগেও!

তারপর মাঠের কাছাকাছি যেতেই সেই গাইড জানিয়ে দিচ্ছিলেন এমসিজি শুধু একটা ক্রিকেট মাঠ নয়, এটি অস্ট্রেলিয়ার ঐতিহ্যের প্রতীকও। এখানে শুধু ক্রিকেট কিংবা অন্য খেলা নয়-হয় কনসার্টও। তবে ক্রিকেট মাঠ হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন অজিরা। 

নানা কারণে আলোচিত এই মাঠ। শুধু গৌরবোজ্জল ইতিহাস আর ঐতিহ্য নয়, এই স্টেডিয়ামটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে ইতিহাসের প্রথম টেস্ট আর ওয়ানডে ম্যাচ। ভিক্টোরিয়া রাজ্যের মেলবোর্নের বিখ্যাত ইয়ারা নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই স্টেডিয়ামটিতে ১৯৯২’র ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনাল ছাড়াও ১৯৫৬ অলিম্পিকস আর ২০০৬’র কমনওয়েলথ গেমসের সাক্ষী এই গ্রাউন্ড। 

আরও একটা কারণে ইতিহাসবিদেরা এগিয়ে রাখেন এই মাঠটিকে। এটি যে ইতিহাসে লক্ষাধিক দর্শক ধারণক্ষমতার একমাত্র স্টেডিয়াম। আর প্রতি মৌসুমে প্রায় ৩৫ লাখ দর্শক খেলা দেখেন এই মাঠে। দীর্ঘ সিড়ির ধাপ পেরিয়ে মাঠে পা রাখতে গিয়ে নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবানই মনে হলো। একটা ইতিহাসেরও স্বাক্ষী মনে হলো নিজেকে।

এই মাঠের গল্পটাতো অনেক অনেক পুরোনো আর বনেদি। ইয়ারা পার্কে এমসিজির পথচলা শুরু সেই ১৮৫৩ সালে। মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব প্রথম থেকেই ক্রিকেটের জন্য ব্যবহার করে আসছে মাঠটি। অবশ্য শুধু ক্রিকেট নয়-অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল লিগ, রাগবি ইউনিয়ন, রাগবি লিগ, ফিফা বিশ্বকাপ বাছাই-পর্বসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ ও অ্যাথলেটিক্স, এমনকি কনসার্টও হয়ে আসছে এখানে। 

৪৬ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করে বানানো মাঠটি আলাদা করে পরিচিত। কারণ এখান থেকেই যে পথচলা শুরু টেস্ট ক্রিকেটের। সেই ১৮৭৭ সালে ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় এমসিজিতে। যেখানে ইংল্যান্ডকে ৪৫ রানে হারিয়েছিল অজিরা। তারপর আরেকটা ‘প্রথম’ কীর্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই মাঠের নাম। ১৯৭১ সালে এখানে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ।

এই মাঠটিকে অবশ্য গোটা বিশ্ব মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড কিংবা এমসিজি নামে জানলেও স্থানীয় বাসিন্দারা ‘জি’ নামেই ডাকে। যে বয়সী গাইড মাঠটি নিয়ে নানা কথা বলছিলেন-তার মুখেও এই নামটা শুনলাম। তিনি মুখস্ত বিদ্যার মতো এ নিঃশ্বাসে এই মাঠের গল্পটা শোনালেন এভাবে- ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত হয় মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড। উইলিয়াম হেইন্স ছিলেন এই ট্রাস্টের প্রথম সভাপতি। ১৮৫৩ সালে মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব কর্তৃপক্ষ এলাকাটিকে ক্রিকেট খেলার জন্য ব্যবহার করতে শুরু করে। তখন অবশ্য ইয়ারা নদীর উছলে উঠা জল বেশ ভোগাতে তাদের। ক্লাবের পুরোনো মাঠটি প্রায়শ ইয়ারা নদীর বন্যার জলে প্লাবিত হতো!

সেই সব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে এমসিজি এখন পৃথিবীর ১৩তম আর অস্ট্রেলিয়ার সর্ববৃহৎ স্টেডিয়াম। যে মাঠের আরও একটা অহংকার নিশ্চয়ই স্পোর্টস মিউজিয়াম। সেই ক্রীড়া জাদুঘর দেখতে ভিড় লেগেই থাকে। বৃহস্পতিবারও দেখা মিলল অসংখ্য ক্ষুদে পড়ুয়া তাদের স্কুল পোশাকেই এসেছেন সেই জাদুঘর দেখতে।

এই মাঠ অসংখ্য ক্রিকেট কিংবদন্তির সঙ্গে জন্ম দিয়েছে অন্য খেলার খেলার কিংবদন্তিদেরও। তাদেরও সম্মানিত করা হয়েছে। মাঠের পাশেই দেখা মিলল স্যার ডন ছাড়াও ক্রিকেটার ডেনিস লিলি, বিলস পন্সফোর্ড, কিথ মিলার, ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের ব্যাথি কুর্টব্রেট, অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবলের রন বারাসি, ডিক রেনল্ডসসহ আরও কয়েক জনের স্ট্যাচু।

ভিক্টোরিয়া রাজ্য জন্ম দিয়েছে শেন ওয়ার্ন, কিথ মিলার ও নেইল হার্ভের মতো ক্রিকেট কিংবদন্তির। তাদের প্রায় সবাইকেই সম্মানিত করা হয়েছে এমসিজিতে। তাদের স্ট্যাচু যেন আরও সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বিখ্যাত মাঠটির। সেই ঐতিহ্য আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে এবার। এখানেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে রোববার লড়ছে পাকিস্তান-ইংল্যান্ড!

এমসিজির শুরুটা হয়েছে স্যার ডন দর্শনে, স্টেডিয়ামের অন্য পাশে আরেক কিংবদন্তি শেন ওয়ার্নের স্ট্যাচু। এই লিজেন্ড তার সেই বিখ্যাত বোলিং অ্যাকশনে দাঁড়িয়ে। এমসিজিতে পা রাখলে এখানেও ছবি তোলা অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু কি আশ্চর্য, ওয়ার্নির সঙ্গে যখন ছবি তুলতে যাবো তখনই শুরু মিহি দানার মতো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। কান্নার মতো ঝরছে যেন অবিরত! সকালে রোদ দেখে বেরিয়ে ছিলাম, এখন দেখি ছাতা সঙ্গে না এনে ভুলই হয়েছে। 

এই যখন ভাবছিলাম তখনই ওয়ার্ন নামটার সঙ্গে একরাশ বিষণ্ণতাও সঙ্গী করে এলো। যে মানুষটি এই মার্চে আচমকা এভাবে কাউকে কোন ইঙ্গিত না দিয়ে ৫২-তেই চলে গেলেন তার সঙ্গে তো এমন বৃষ্টি ভেজা বিষণ্ণতাই বেশি যায়। আহারে জীবন, ছোট্ট কিন্তু কী দাপুটে প্রাণবন্ত!

এই ভাবতে ভাবতেই দেখা দেখা হয়ে গেল আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সঙ্গে। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান এখন আইসিসি’র গেম ডেভেলমেন্ট ম্যানেজার। এসেছিলেন এখানে একটা সভায় যোগ দিতে। সেটি শেষ করে বেরোতেই মুখোমুখি। মেলবোর্নে দু’জনের ঠিকানাটাও কাছাকাছি। তারপর বৃষ্টি ভেজা এমন দিনে এই কিংবদন্তির গাড়িতে করেই ঘরে ফেরা। ভাগ্যবানই মনে হচ্ছে নিজেকে। অভিজাত আঙিনায় কিংবদন্তির সঙ্গেই কেটে গেল একটা দিন।

এটি/এনইউ