সেই অবিস্মরণীয় এশিয়া কাপ জয়ের পর/ছবি: এসিসি

বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে নারীদের পথচলা খুব বেশিদিনের নয়। যদিও ১৯৮২ সালে একদল উৎসাহী মেয়েকে নিয়ে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে নারী ক্রিকেটে পথচলা। তবে মূলধারার ক্রিকেটে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতের ব্যাপারে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড নড়েচড়ে বসে ২০০৬ সালে। সে বছরের এপ্রিল মাসে উইম্যান্স উইং গঠন করে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প শুরু করে বিসিবি। ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে ওদের সরাসরি নামিয়ে দেয়া হলো ওপেন টুর্নামেন্টে। তাতেই স্বপ্ন দেখা শুরু।

হাঁটি-হাঁটি, পা-পা করে শুরু করা নারী ক্রিকেটে আরও গতি দিতে ফুটবল, ভলিবল, কাবাডি, ব্যাডমিন্টন থেকে নারী খেলোয়াড়রা এসে বাইশ গজের লড়াইয়ে নাম লেখালেন। ফল হিসবে ২০১০ সালে এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ করেই মেয়েরা জিতল রৌপ্য পদক। ২০১১ সালে মিললো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মর্যাদা। এরপর ২০১২ সাল থেকে বিসিবি’র কেন্দ্রীয় চুক্তির আওতায় আসে নারী দলের ক্রিকেটাররা।

নারী ক্রিকেটারদের ভাগ্যোন্নয়ন এবং নারী ক্রিকেটের এই রেনেসাঁর পেছনে ২০১১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নারী বিশ্বকাপ বাছাইপর্বটা টার্নিং পয়েন্ট হয়ে আছে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম শিরোপা আসে নারীদের হাত ধরেই। ২০১৮ সালে শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে এশিয়া কাপের শিরোপা উঁচিয়ে ধরেন সালমা খাতুন, জাহানারা আলমরা। এরপর নারী ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনার ক্ষেত্রে খানিক মাত্রা যোগ হয়েছে।

তবে এক গবেষণায় উঠে এসেছে জাতীয় পর্যায়ে খেলাধুলায় অংশ নেওয়া নারীদের ৮৩ শতাংশই আসেন মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। যেখানে নারীদের খেলাধুলায় আসাটা ভালো চোখে দেখা হয় না। বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান মানেন সেটি। তবে যারা জাতীয় পর্যায়ে আছেন, তাদেরকে আরও ভালো করার তাগিদ আকরামের। এতে অনেক পরিবার উদ্বুদ্ধ হয়ে নারীদের সেই অধিকার দেবে বলে মনে করেন আকরাম।

আকরাম খান বলেন,  ‘নারীদের সম্ভাবনা বাংলাদেশে বেশ ভালো। ওরা এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন হলো। এশিয়া কাপে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো দল আছে, এটি অনেকটা বিশ্বকাপের মতো। ওখানে যখন আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারছি, অবশ্যই আমাদের মান বা সম্ভাবনা অনেক ভালো। আমরা যতো বেশি ওদের সুযোগ দিতে পারি, তাহলে ইনশাআল্লাহ ছেলেরা যেভাবে নাম করছে, ওভাবে মেয়েরাও করবে।’

সীমাবদ্ধতা অবশ্যই কিছু আছে। আমরা অবশ্য যতটুকু পারি, চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু হ্যাঁ, অন্যান্য দেশে নারীরা যেভাবে এগিয়ে আসে, তাদের পরিবার যেভাবে এগিয়ে আসে, সেভাবে তুলনা করলে আসলে এখানে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। কিন্তু আমরাও আস্তে আস্তে সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসছি। এ থেকে বের হতে হবে আমাদের। এজন্য মেয়ে ক্রিকেটাররা যখন ভালো করবে, তখন অনেকেই এগিয়ে আসবে। এখন মেয়েদের পারফরম্যান্স কিছুটা ভালো হয়েছে, এটি আরও ভালো হলে মনে করি সীমাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

আকরাম খান, সাবেক অধিনায়ক, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল

বর্তমানে সময়ে দাঁড়িয়ে নারী ক্রিকেটের অগ্রগতি নিয়ে আশাবাদী বিসিবির উইমেন্স উইংয়ের ইনচার্জ তৌহিদ মাহমুদ। জানালেন, ক্রিকেটে আসতে আগের থেকে অনেক বেশি আগ্রহী নারীরা। ক্রিকেটে নারী-পুরুষের বেতন-বোনাস বা আনুষাঙ্গিক সুবিধার যে ফারাক সেটিও ধীরে ধীরে কমে আসছে বলে জানালেন তিনি।

আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে নারী ক্রিকেট নিয়ে আমরা অনেক বেশি আশাবাদী। আমাদের কিন্তু জাতীয় দলের পাশাপাশি পাইপলাইনটাও বেশ শক্ত। এখন আমাদের একটি ইমার্জিং দল আছে, একটি অনূর্ধ্ব-১৯ দল আছে, আগামী মার্চে আমরা একটি অনূর্ধ্ব-১৭ দলও পেয়ে যাব।

তৌহিদ মাহমুদ, ইনচার্জ, বিসিবি উইমেন্স উইং

তৌহিদ মাহমুদ আরও জানান, ‘নারীরা ক্রিকেটে এগিয়ে আসছে এটা অবশ্যই ইতিবাচক একটি দিক। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে নারী ক্রিকেটারদের পর্যাপ্ত সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তেমনভাবেই আমরা এটা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের পথচলা খুব বেশি দিনেরও না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাকালে দেখবেন, নারী-পুরুষের একটা ফারাক কিন্তু এখনো আছে। আমরা আস্তে আস্তে সেটি ঠিক করছি। ভবিষ্যতে ছেলেদের ক্রিকেটের সঙ্গে মেয়েদের ক্রিকেটের ফারাক খুব বেশি থাকবে না।’

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ নারী দলের পথচলা এক দশক পাড়ি দিলেও এখনো তাদের কোনও স্বীকৃত সংগঠন নেই। ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) এর বর্তমান যে কার্যক্রম তার সবই ছেলেদের ক্রিকেট নিয়ে। তবে কোয়াবের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পাল শোনালেন আশার কথা। নারীদের অংশগ্রহণ না থাকলেও তাদের সমস্যা নিরসনে কাজ করে কোয়াব। সেটি কাগজকলম রূপ পাবে কোয়াবের আগামী এজিএম-এ।

এটা সত্যি যে আমাদের দেশে নারী ক্রিকেটারদের নিয়ে এখনও তেমনভাবে কোন সংগঠন গড়ে ওঠেনি। আমাদের কোয়াবেও নারীদের অংশগ্রহণ এখন নেই। তবে সর্বদা আমরা তাদের সমস্যা সমাধান চেষ্টা করি। গত প্রিমিয়ার লিগে দুইটি দল পেমেন্ট নিয়ে সমস্যা করার পর আমরা সমঝোতার চেষ্টা করেছি।

দেবব্রত পাল, সাধারণ সম্পাদক, ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব)

দেবব্রত আরও জানান, ‘আমরা আশাবাদী আমাদের সামনে এজিএম হবে। এখানে পুরুষ ক্রিকেটারদের মতোই নারী ক্রিকেটারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে। নারী ক্রিকেটারও এখানে সদস্য হবেন। এক্সিকিউট কমিটিতেও নারী নেতৃত্ব আসবে। সবকিছুই সমান ভাবে চলবে। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ের আমাদের এজিএম। এরপরই নারী ক্রিকেটাররা কোয়াবের সঙ্গে যুক্ত হবে।’

টিআইএস/এটি/এনইউ