জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেলেন রংপুরের তিন বধির ক্রিকেটার
ভারতে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে জাতীয় ক্রিকেট দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছেন রংপুরের হাবিব, আরিফুল ও লিংকন। বাইশগজে লড়তে উত্তরাঞ্চলের এই তিন বধির ক্রিকেটার এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। কথা বলতে বা শুনতে না পারা এই তিন বধিরের লক্ষ্য এখন নিজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে খেলতে যাওয়া। এ জন্য নিজেদের তৈরিতে মনোযোগী ইশারা ভাষার খুদে তিন ক্রিকেটার।
হাবিব রহমান, আরিফুল ইসলাম ও লিংকন ইসলাম, এই তিন বধিরের ক্রিকেটে আসার গল্পটা অন্যরকম। এক ক্রিকেট পাগল তরুণের হাতে গড়া ক্লাব থেকে তাদের স্বপ্ন যাত্রার শুরু। অবহেলিত ও প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়ে তোলা রংপুর ইয়াং ক্রিকেট ক্লাব তাদের আতুরঘর। এখান থেকেই বধির জাতীয় ক্রিকেট দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছেন এই তিন ক্রিকেটার। এবার ক্যাম্পে ভালো করলেই ডাক পাবেন ভারতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ত্রিদেশীয় সিরিজেও।
বিজ্ঞাপন
নিজের জেদকে কাজে লাগিয়ে ২০১৮ সালে সাঈদ বিন সীমান্ত রংপুর ইয়াং ক্রিকেট ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। বধিরদের পাশাপাশি অবহেলিত ও প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের নিয়ে গঠিত হয় এই ক্লাব। অবহেলিত ও প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের খেলার সুযোগ করে দেওয়ার কারণে রংপুরের ক্রিকেটপাড়ায় ইতোমধ্যে বেশ নাম কুড়িয়েছে ক্লাবটি।
বিজ্ঞাপন
রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলেছে ক্লাবটির খুদে ক্রিকেটাররা। এবার সেই ইয়াং ক্রিকেট ক্লাবের হাত ধরেই বধিরদের জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন হাবিব, আরিফুল ও লিংকনরা। এতে খুশি তাদের পরিবার, সঙ্গে আনন্দে আত্মহারা ক্লাবটির স্বপ্নদ্রষ্টা সাঈদ বিন সীমান্ত।
ছেলে লিংকনকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে এসেছিলেন মা আলেয়া বেগম। কেমন লাগছে জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পাওয়ায় আমি অনেক খুশি। আমি দোয়া করি সে বাংলাদেশের হয়ে খেলে অনেক দূর এগিয়ে যাক। এটাই আমার চাওয়া।’ লিংকনের মায়ের মতো অন্যদের মা-বাবারাও ভীষণ খুশি জাতীয় দলের ডাক পাওয়ার খবরে।
এর আগে শুক্রবার (৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টায় জাতীয় দলের ক্যাম্পকে সামনে রেখে জিএল হোস্টেল মাঠেই রংপুর ইয়াং ক্রিকেট ক্লাবের অনুশীলন ক্যাম্পের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ জাতীয় বধির ক্রিকেট দলের হেড কোচ আনিছুল ইসলাম নিপু।
অনুশীলনে ব্যস্ত এই বধির ক্রিকেটাররা সাধারণ ক্রিকেটারদের মত কথা বলতে পারে না। ভিন্ন কৌশলে চলে তাদের কথাবার্তা। ব্যাট-বলের লড়াইয়ের প্রস্তুতি আর দলীয় বোঝাপড়া সারতে হয় ইশারায়। তাদের কেউই কথা বলতে যেমন পারে না, আবার অন্যের কথা শুনতেও পারে না। নির্বাক হলেও অন্যসব খেলোয়াড়দের মতো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখে ইশারা ভাষার এই খুদে ক্রিকেটাররা।
সেখানে ইশারাতেই কথা হয় হাবিবদের সঙ্গে। সবার চোখ তখন স্বপ্নময় আনন্দে উদ্বেলিত। নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ব্যাট-বলের লড়াইয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়া এই খুদে ক্রিকেটাররা চিৎকার করে বলছিল সুযোগ পেলে ‘জ্বলে উঠতে পারবেন’ তারা।
হাবিব রহমান তার ইশারা ভাষায় এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা বাহিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমরা ভালো করে দেশের সুনাম অর্জন করতে চাই। স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে মাঠে এসেছি। বাসায় না থেকে মাঠে এসে ঘাম ঝড়াচ্ছি। আমাদের মধ্যে প্রতিভা আছে কিন্তু আমরা সমাজে অবহেলিত। আমাদেরকে বোঝা মনে করলেও আমরা কিন্তু কারো বোঝা নই। শুধু সুযোগ এবং পৃষ্টপোষকতা পেলে আমরাও কিছু করে দেখাতে পারব ইনশাআল্লাহ।’
ব্যাট হাতে ব্যস্তু আরিফুল নেট প্রাকটিস ছেড়ে এসে জানালেন তার স্বপ্নের কথা। হাত উঁচিয়ে ও চোখের ইশারায় আরিফুল ইসলাম অমলিন হাসিতে বললেন, ‘আমি ছোটবেলায় টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখতাম। তখন আমার খুব ভালো লাগতো। ভাবতাম আমি যদি এইভাবে ক্রিকেট খেলতে পারতাম। বাসায় যখন যা হাতের কাছে পেতাম তা দিয়েই খেলতাম। আমার ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে আমাকেও যেন টিভিতে ক্রিকেটার হিসেবে খেলতে দেখা যায়। এখন মনে হচ্ছে সেই স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি এসেছি।’
অন্যদিকে লিংকন ইসলাম জানালেন, ‘খেলাধুলায় তার মা তাকে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট করে আসছে। মায়ের কারণেই ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখছেন সে। কারমাইকেল কলেজে বিনামূল্যে ক্রিকেট খেলা শেখার প্রশিক্ষণের সুযোগ কাজে লাগাতে তার মা তাকে ইয়াং ক্রিকেট ক্লাবে ভর্তি করে দিয়েছিল। এখন সেই ক্লাব থেকেই ডাক পেয়েছেন জাতীয় দলের ক্যাম্পে। লিংকনের আত্মবিশ্বাস সে দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারবে।’
আগামী এপ্রিলে ভারতের কলকাতা পশ্চিমবঙ্গে ২৮ থেকে ৬ মে পযর্ন্ত অনুষ্ঠিত হবে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে ত্রিদেশীয় সিরিজ। জাতীয় দলের ক্যাম্পে ভালো পারফরম্যান্স করলেই আগামী এপ্রিলে ভারতের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে উড়াল দেবেন রংপুরে এই তিন বধির ক্রিকেটার।
এই ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স প্রসঙ্গে রংপুর ইয়াং ক্রিকেট ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাঈদ বিন সীমান্ত ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি খুব আনন্দিত ও গর্বিত। আমার এই ক্ষুদ্র ক্লাব থেকে তারা অনেক বড় পর্যায়ে খেলতে যাচ্ছে। এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। আমার এই ক্লাবে ভর্তি হতে কোনো টাকা-পয়সা লাগে না। শুধু জার্সি আর জুতা পরে আসলেই আমরা ভর্তি করে নিয়ে খেলার সুযোগ করে দেই। কারো যদি সেটাও না থাকে আমার তার জন্য আছি। যে তিনজন জাতীয় দলে ডাক পেয়েছে, তারা ভালো খেলো। আশা করছি, মূল দলেও তাদের সুযোগ হবে।’
বাংলাদেশ বধির ক্রিকেট দলের হেড কোচও রংপুরের এই বধির ক্রিকেটরদের নিয়ে দারুণ আশাবাদী। ঢাকা পোস্টকে কোচ আনিছুল ইসলাম নিপু বলেন, ‘সীমান্ত অনেক ছোট কিন্তু তার সাহস দেখে আমি অবাক। আমি মনে করি রংপুরের ক্রিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা রয়েছে তার অবহেলিত ও প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের দিকে নজর দেবেন।’
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এফআই