গল্পটা নিশ্চয়ই অনেকের জানা, ওই যে একবার এক লোকের ঘরে আগুন লাগল। তো তার প্রতিবেশী কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে সেই আগুনেই আলু পোড়া দিতে গেলেন। আরেকজনের সর্বনাশের দিনে তিনি ভাত আর আলু ভর্তায় কতটা মজা করে খেতে পেরেছিলেন, সেটা অবশ্য জানা যায়নি। তবে এখনো ‘ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া’ প্রবাদ হয়েই আছে। আগুন নেভানোর কোনো চেষ্টা না করে সে আগুনেই আলু পোড়া দেওয়া এমন মানুষের অভাবও নেই চারপাশে। 

এই যেমন এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কর্তাদের সঙ্গে সাকিব আল হাসানের কথার যুদ্ধে অনেকেই রোমাঞ্চিত। ঝগড়া দেখতে ‘পপকর্ন’ হাতে চোখ রাখছেন অন্তর্জালে।

শুরুটা হয়েছিল সাকিবের তরফ থেকেই। গত শনিবার রাতে ফেসবুক লাইভে বেশ শক্ত কিছু কথাই বলে ফেলেন বাংলাদেশের এই তারকা ক্রিকেটার। যেখানে একাধিক বোর্ড পরিচালকের দিকেও আঙুল তোলেন তিনি। ব্যস, সেই মন্তব্যের জেরে রোববার নিজ বাসায় বৈঠক ডাকেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। যেখানে ইঙ্গিত মিলেছে, আটকে যেতে পারে সাকিবের এবারের আইপিএল মিশন। রোববারই আরেকটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সাকিব। সেখানেও বাংলাদেশ ক্রিকেট সংস্কৃতি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তিনি।

সব মিলিয়ে মাঠের বাইরের এমন সব কথার যুদ্ধে টালমাটাল দেশের ক্রিকেট। আর সেটা অগ্রজ ক্রিকেট ব্যক্তিত্বদেরও আহত করছে। কারণটাও সংগত, বিসিবির কোড অব কন্ট্রাক্টের ভেতরে থাকা একজন ক্রিকেটার কথা বলেছেন দুই বোর্ড পরিচালক আকরাম খান ও নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বিরুদ্ধে, সেটাও গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। আকরামরা পাল্টা জবাব দেবেন আবার সেই গণমাধ্যমে এসেই। তখন তো পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকার কথা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

এমনটা আসলে চায় না কেউই। প্রবীণ সাংবাদিক ও ক্রিকেট কোচ জালাল আহমেদ চৌধুরীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে আক্ষেপ নিয়ে লিখেছেন, ‘এমন ক্রিকেট চাইনি কোনোদিন। এই মুহূর্তে পারস্পরিক শ্রদ্ধাহীন আমাদের ক্রিকেটের ওপর মহল, ক্রমেই বিরোধের মেঘ ঘনিয়ে আসছে খোলা আকাশে। শুভবুদ্ধির দ্রুত উদয় না হলে নতুন প্রজন্মের তারকারা বিকশিত হবার পরিবেশ হারাবে। সংশ্লিষ্টরা যুক্তি-বুদ্ধির আওতায় নিজেদের ভাবাবেগ নিয়ন্ত্রণ করুন। তা না হলে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্রিকেটপ্রেমী আমজনতার ভালোবাসার জায়গাটা। এমনটা মোটেই কাম্য নয়। ক্রিকেট বিশ্বে অর্জিত ভাবমূর্তিটার কথাও ভাবতে হবে। ঝগড়াঝাঁটির খবর সফররত দলটাকেও খুব উজ্জীবিত করবে বলে মনে হয় না।’

ঠিক তাই। এভাবে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে কথা বলে লাভটা আসলে কী হচ্ছে। মাঠের ক্রিকেটে দল তো ছন্দ হারিয়েই আছে। দেশের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে টেস্টে হোয়াইট ওয়াশের রেশ থাকতেই নিউজিল্যান্ডে শুরুটা ভালো হয়নি। সঙ্গে এমন সব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। স্বস্তির সুবাতাস নেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে। এরমধ্যে ফেসবুকে টাইমলাইনে ভাসছে আরেকটি ট্রেলর। যেখানে আরেক কিংবদন্তি ক্রিকেটার মাশরাফিকে বলতে শোনা যাচ্ছে আরও বাজার গরম করা কিছু কথা। 

সমালোচকদের তুলোধুনো করে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ওয়ানডে অধিনায়ক বলছিলেন, ‘ভাই যেই মানুষগুলো কথা বলতেছে, ওদের অবদান কী? তাদের অবদানগুলো যদি আমি তুলে ধরি তাইলে তো খারাপ হয়ে যাবে...একটা ওয়ার্ল্ডকাপে ৫০ জন যাচ্ছে মাশরাফির ১৪ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে...কেউ কি নিজের টাকায় গেছে?’ 

ট্রেলরই বলে দিচ্ছে সাকিব ঝড় না থামতেই ঈশান কোণে মেঘ জমেছে! সূর্যের দেখা তো নেই-ই। মনে হচ্ছে বিসিবিকে আরেক ঢেউ সামাল দিতে হবে। তবে এত কিছুর মধ্যে দুই পক্ষই যে ঠিক পথে নেই, সেটি অন্তত একেবারে নবীনতম ক্রিকেটপ্রেমীও বুঝতে পারছেন। 

এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই, ঠিক পথে নেই দেশের ক্রিকেট। সাকিব যে বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সেগুলোর সঠিক জবাব বোর্ড কর্তাদের কাছে আমরা চাইব না কেন?

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বেশ কয়েকজন পরিচালকের বিপক্ষে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনেছেন সাকিব। তার মতে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন আর পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজন ছাড়া কেউই ক্রিকেটের স্বার্থে কাজ করছেন না। ক্রিকেট বোর্ডের অনেক কার্যক্রম চলছে দায়সারাভাবে। জাতীয় দলের পাইপলাইন শক্ত করার দায়িত্ব যাদের, সেই হাইপারফরম্যান্স (এইচপি) ইউনিটও ক্রিকেটার তৈরির কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারছে না বলে দাবি সাকিবের। 

সাকিবের করা এই প্রশ্নগুলো তো অবান্তর নয়। দেশের ক্রিকেটের যে হাল তাতে এটা স্পষ্ট, টেস্ট স্ট্যাটাসের দুই দশক পেরিয়েও গড়ে ওঠেনি লঙ্গার ভার্সনের কোনো কাঠামো। অনেকটা দায়সারার মতো করেই চলছে সাদা পোশাকের ঘরোয়া ক্রিকেট। যে কারণে মাঠেও নেই সাফল্য। এখনো শিক্ষানবিশ হয়েই আছে টেস্ট দল। পাইপলাইনে এমন ক্রিকেটারও নেই যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। 

ওয়ানডেতেও বিচ্ছিন্নভাবে সাফল্য পেলেও এখানেও মুখ চেনা কিছু তারকা নির্ভর দল বাংলাদেশ। এক সাকিব আল হাসান না থাকলেই দল পা পিছলে যায়। তামিম ইকবাল না খেললে অধিনায়কও খুঁজে হয়রান বোর্ড। টি-টোয়েন্টিতেও একই দৃশ্যপট। তিন ফরম্যাটে আলাদা দল গড়া- কথার কথা হয়েই আছে অনেক বছর ধরে। তাছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেটও অনেক বছর শুধুই ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।

এসব নিয়ে সাকিব প্রশ্ন তোলায় তার বিরুদ্ধে বোর্ড যে অ্যাকশন নিতে যাচ্ছে সেটিও অনেকের কাছে দৃষ্টিকটুই মনে হচ্ছে। বলা হচ্ছে থমকে যেতে পারে সাকিবের আইপিএল মিশন। কারণ তাকে যে ছাড়পত্র দিয়েছিল বোর্ড, সেটি পুনর্বিবেচনা করবেন তারা। 

একইভাবে সাকিব আল হাসানের কথাতেও সব সময় সততার পরিচয় থাকছে না। তিনি স্পষ্ট বলছেন, ‘হ্যাঁ, টাকাটাও একটা ফ্যাক্টর। আমার কথাই বলি। বয়স ৩৪ হয়ে গেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে বড়জোর আর তিন-চার বছর খেলতে পারব। দুই বছরও হতে পারে। কপাল খারাপ থাকলে এক বছর। আর্থিক দিকটা ভাবা কি অন্যায়?’

অবশ্যই টাকাও একটা বড় ব্যাপার। কিন্তু যে ক্রিকেটারটি বছর দুয়েক আগেই ক্রিকেটার পরিচয়ে ৩৬ মিলিয়ন ডলারের মালিক বনেছেন, তার নিখাদ দেশপ্রেমটাও তো থাকা চাই। দল যে এখন বড় বিপদে। একটা দেশ ২১ বছরে মাত্র ১৩টা টেস্ট জিতেছে। তাদের হয়ে খেলে নাম কামানো ক্রিকেটারের জন্য প্রতিটা জয় তো আর টাকার মূল্যে বিবেচনা করা যাবে না। দেশের হয়ে সবার আগে লড়তে হবে।

একইসঙ্গে সাকিব বলেছেন, ভারতে আসছে মাসে শুরু আইপিএলে খেললে নাকি বিশ্বকাপ প্রস্তুতিটা ভালো হবে। জানতে ইচ্ছে হয় পারিশ্রমিক ৩ কোটির জায়গা মাত্র ৩ লাখ হলে বিশ্বকাপের প্রস্তুতির কথা এভাবে বলতেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার? 

তিনি চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার। বোর্ড থেকে ছুটি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলেন। ঠিক এমন সময়ে যে প্রতিষ্ঠানের চাকুরে সেই প্রতিষ্ঠানেরই পরিচালকদের নিয়ে সমালোচনায় মুখর হলেন। তার আগে চুক্তি থেকে সরে গিয়ে কথাগুলো বললে বরং সততার পরিচয় দিতেন তিনি। 

বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজন ছাড়া বোর্ডের অন্যদের যোগ্য মনে করছেন না সাকিব। প্রশ্ন হলো বিসিবিতে যদি এতই অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা থাকে, তাহলে সেটির দায় সবচেয়ে বেশি কার? নাজমুল হাসান পাপন নাকি আকরাম খানের?

একটা প্রতিষ্ঠান যখন প্রশ্নবিদ্ধ তখন তার দায়টা সবার আগে শীর্ষকর্তার ওপরই বর্তায়। তাছাড়া বোর্ড কর্তার একচ্ছত্র আধিপত্যের কথা তো সবারই জানা। যিনি টস, একাদশ থেকে ব্যাটিং অর্ডার সবকিছুতেই রাখতে চান নিজের মতামত।

ক্রিকেটার, টিম ম্যানেজমেন্ট আর বোর্ড কর্মকর্তা সব মিলিয়েই তো একটা পরিবার। সেই পরিবারে যখন অশান্তি তখন আশপাশ থেকেও আগুনে ঘি দেওয়াটা বন্ধ হওয়া দরকার। ‘ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া’ না দিয়ে বোর্ড কর্তা, ক্রিকেটার এমনকি সমর্থকদেরও এখন অনেক দায়িত্ব। বড় দুঃসময় দেশের ক্রিকেটের। কেউ সাকিব আল হাসান কেউ আবার আকরাম কিংবা বিসিবির পক্ষে দাঁড়ানোতে সমাধান হবে না। পক্ষ-বিপক্ষের বাতাস বরং পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। 

ব্যক্তিত্বের এই লড়াইয়ে কে জিতবে, সাকিব আল হাসান নাকি বিসিবি? এই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে সমীকরণ মেলাচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু উত্তরটা তো জলের মতোই স্বচ্ছ। হারবে শুধুই ক্রিকেট। সংবাদ সম্মেলন, ফেসবুক লাইভ আর চটকদার শিরোনাম এক সময় হয়ে যাবে অতীত। কিন্তু যা কিছু ক্ষতি তার পুরোটাই হবে বাংলাদেশের। 

এটি/এমএইচ/এমএমজে