বাংলাদেশ ভালো খেললে তৃপ্তি পাই: হোয়াটমোর
মার্চ শেষ হতে চললেও কাঠমান্ডুতে এখনো শীতের আবহ। বেলা এগারোটা নাগাদও হিম বাতাস বইতে থাকে। সপ্তাহ দুই আগে ৬৭ স্পর্শ করা কোচ ডেভ হোয়াটমোর নেপালি ক্রিকেটারদের সঙ্গে নিজেও এক রাউন্ড দৌঁড়ালেন। এরপর নেটে বল ছুঁড়লেন। অনুশীলন করানোর এক ফাঁকে ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের-এর সঙ্গে কথা বলেছেন ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয়, বাংলাদেশ অধ্যায়, নেপাল চ্যালেঞ্জসহ ক্রিকেটের অনেক বাঁক বদল নিয়ে।
প্রশ্ন: কোচ হিসেবে আপনি কিংবদন্তি। কোচিং নিয়ে পরে আলোচনা করছি। আগে আপনার ব্যক্তিগত জীবন দিয়ে শুরু করি। কলম্বোতে জন্ম আপনার। পরবর্তীতে চলে গেলেন অস্ট্রেলিয়া।
বিজ্ঞাপন
ডেভ: আমার বাবা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন তিনি সপরিবারে অস্ট্রেলিয়া যান। তখন আমার বয়স মাত্র ৮ বছর। কলম্বোতে আমি কিছুদিন বেড়ে উঠার পরই অস্ট্রেলিয়ায় যেতে হয়।
প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়া স্পোর্টিং নেশন। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ক্রিকেটের প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে নাকি শ্রীলঙ্কা থেকেই জন্মেছিল।
বিজ্ঞাপন
ডেভ: শ্রীলঙ্কা ছাড়ার আগেই ক্রিকেট আমার পছন্দ। অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ায় উন্নত প্রশিক্ষণ, ব্যবস্থাপনার মধ্যে বেড়ে উঠায় সেটা আরো শাণিত হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনি কোচ হিসেবে যতটা সমাদৃত, খেলোয়াড় হিসেবে ততটা নন। অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে সেভাবে খেলতে পারেননি। খুবই স্বল্প মেয়াদের ক্যারিয়ার। শ্রীলঙ্কার হয়ে খেললে সেটা আরো বেশি হতো পারতো কিনা?
ডেভ: খুব জটিল প্রশ্ন। শ্রীলঙ্কার হয়ে খেললে এক রকম হতে পারতো আর অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলায় আরেক রকম হয়েছে। এটা সত্যি অস্ট্রেলিয়ায় তখন আমার সময়ে অনেক অনেক মেধাবী ও তারকা খেলোয়াড় ছিল। সেই সময়টায় আমি অস্ট্রেলিয়াতে কাটানোয় শ্রীলঙ্কার বিষয়টি সেভাবে ভাবতে পারিনি।
প্রশ্ন: ক্রিকেটার হিসেবে না দিলেও কোচিংটা হয়তো অস্ট্রেলিয়া আপনাকে ভালোই দিয়েছে।
ডেভ: হ্যাঁ এটা বলতে পারেন। ক্রিকেটার হিসেবে যখন দেখলাম পথটা দীর্ঘায়িত করা কঠিন তখন কোচের দিকে আগ্রহ বাড়ে। কোচিংয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়া অবশ্যই ভালো জায়গা।
প্রশ্ন: আপনি তো কোচ হিসেবে নিজেকে ক্রিকেট বিশ্বে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। কোচ হিসেবে আপনার দর্শন কি?
ডেভ: খুব সাধারণ দর্শন। পরিবেশটা সুন্দর রাখা। খেলোয়াড়দেরকে সর্বোচ্চভাবে বুঝতে পারা। ছোটখাটো অনেক বিষয় থাকে যেগুলো কাছ থেকে কাজ করলে আর সমস্যা হয় না। আমি সেটাই করি।
প্রশ্ন: শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব নিলেন। ১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন করালেন। সেই গল্পটা সংক্ষিপ্ত করে যদি একটু বলতেন...
ডেভ: বিশ্বকাপ শুরুর আগে তারা নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ জিতেছিল। ফলে একটা জয়ের ধারাবাহিকতার মধ্যেই ছিল। লংগার ভার্সনে জিতলেও সংক্ষিপ্ত ওভারে তারা বেশি স্কোর তুলতে পারছিল না। আমি ওটা নিয়ে একটু কাজ করেছি। আসলে আমি কিছু করিনি। খেলোয়াড়রা ভালো খেলেছে, আর এতেই আমি সফল হয়েছি। ৯০ শতাংশ কৃতিত্বটা খেলোয়াড়দেরই।
প্রশ্ন: এটা তো আপনার বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সেই সময় পরিস্থিতি তো এতো সহজ ছিল না। জয়াসুরিয়াকে ওপেনিংয়ে নিয়ে আসা, রমেশ কালুভিথারানার সঙ্গে পিঞ্চ হিটিং অনেক কিছুই আপনি করেছেন। যেটা শিরোপা জয়ে ভূমিকা রেখেছে।
ডেভ: কোচ হিসেবে পর্যবেক্ষণ জরুরি। জয়াসুরিয়ার মধ্যে হিটিং পাওয়ার অনেক। ও আগে নিচে খেলত। ওকে উপরে পাঠানোর সিদ্ধান্তটা আমার। ও নিজেকে প্রমাণ করেছে। জয়াসুরিয়া ও কালুভিথারানার পিঞ্চ হিটিং কৃতিত্ব ওদেরই পুরোপুরি। এখানে আমার শুধু অনুমোদন ছিল কোচ হিসেবে। তবে জয়াসুরিয়াকে ওপরে ওঠানোর কৃতিত্বটা আমাকে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে আমি একা অবদান নিতে চাই না। ম্যানেজার দিলীপ মেন্ডিসের যথেষ্ট ভূমিকা আছে।
প্রশ্ন: অরবিন্দ ডি সিলভা বেশ ক্ষ্যাপাটে মানুষ। তাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন।
ডেভ: ওর পাগলাটে স্বভাবের কথা আমি শুনেছি। কিন্তু ও খুবই শৃঙ্খল। অতি মেধাবীরা কিছুটা ব্যতিক্রম হয়। ওর মধ্যে কিছুটা আছে সে রকম। ওকে স্বাধীনতা দিয়েছিলাম। সেই স্বাধীনতার ফল আমাকে দিয়েছে। যত রানই করুক, ওর ক্ষুধা মিটতো না। নিজে রান করতো এবং অন্যদের অনেক সহায়তা করত। আমার চেষ্টা ছিল তাকে যত সম্ভব সুযোগ করে দেয়া।
প্রশ্ন: ক্রিকেটে সাফল্যে ক্রিকেটার, বিশেষ করে অধিনায়কের কৃতিত্বই বেশি হয়। যেটা ফুটবলে আবার কোচের উপর যায়। কিন্তু ক্রিকেটে কোচ হয়েও যে তারকা হওয়া যায় সেটা কিন্তু আপনি অনেকটা সেট করেছেন।
ডেভ: আমার দৃষ্টিতে বিষয়টি পরিপূরক। খেলোয়াড় বিকশিত ও পরিশীলিত করতে কোচের ভূমিকা রয়েছে। আবার খেলোয়াড়রাই কিন্তু কোচকে সফল বানায়। আজ আমি ডেভ হোয়াটমোর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে কিন্তু জয়াসুরিয়া,রানাতুঙ্গাদের অবদান রয়েছে। আবার এটাও ঠিক ওদের পেছনেও আমার ইনপুট রয়েছে। একটা থেকে আরেকটা আলাদা করা যায় না।
প্রশ্ন: এরপরও আপনি যে দলের দায়িত্ব নেন সেই দলে অনেক ক্ষেত্রে ক্রিকেটারদের চেয়ে আপনাকে নিয়েই বেশি আলোচনা হয়।
ডেভ: এটা আমি সেভাবে ভাবিনি কখনো। হয়তো উপমহাদেশে আমি সফল বা বেশি কাজ করেছি এজন্য এ রকম হতে পারে। তবে আমি ছাড়াও তো বিশ্বে আরো অনেক কোচ রয়েছেন।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ এখন ওয়ানডে ক্রিকেটে দারুণ দল। দেশের বাইরে বড় দলগুলোকে হারাচ্ছে, লড়ছে। আর ঘরের মাটিতে তো ফেভারিটই। এর ভিত তো আপনার হাতেই গড়া।
ডেভ: বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয় ও সিরিজ আমার হাত ধরেই। বাংলাদেশ ভাল খেললে আমাকে বেশি তৃপ্তি দেয়। এছাড়া শততম ওয়ানডে জয়, ২০০৭ বিশ্বকাপে সুপার এইট। বাংলাদেশের মানুষের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা অনেক। খেলোয়াড়রা আন্তরিক ও ক্রিকেট বোর্ডের লক্ষ্য ছিল এজন্য এখন একটা অবস্থায় পৌঁছেছে। মাহবুব (মাহবুব আনাম), জামিলসহ আরও অনেক কর্মকর্তাকে আমি পেয়েছিলাম। যারা বেশ মেধাবী ও আন্তরিক।
প্রশ্ন: আপনি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন দলের কোচ। এরপর আরো বড় বড় দলের দায়িত্ব নেয়ার পরিবর্তে ক্রিকেটে উন্নয়নশীল দেশকে আপনি বেছে নিয়েছেন কোচিংয়ের জন্য..
ডেভ: আমি কোচিংটা উপভোগ করি ও চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি। শ্রীলংকাকে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন করিয়েছি, সেটা যেমন চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশকে জেতার অভ্যাসে আনাটা একটা চ্যালেঞ্জ। এখন নেপালকে ৫০ ওভার বিশ্বকাপ খেলানো আরেক চ্যালেঞ্জ।
প্রশ্ন: নেপালে মাত্র তিন মাস আপনি। নেপাল ক্রিকেট নিয়ে আপনার ভাবনা কি?
ডেভ: নেপালে মেধাবী ক্রিকেটার রয়েছে। তারা ধীরে ধীরে উন্নতি করবে।
প্রশ্ন: আবার শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে ফিরে যাই। আপনি লংকান ক্রিকেটের অন্যতম সেরা প্রজন্মকে কোচিং করিয়েছেন। জয়াসুরিয়াদের একটু পরেই এসেছেন সাঙ্গাকারা-মাহেলা তাদের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?
ডেভ: সাঙ্গাকারা-মাহেলা দুই জনই দারুণ ম্যাচ উইনার। দীর্ঘদিন লঙ্কান ক্রিকেটকে সাপোর্ট দিয়েছে। এখন থেকে ক্রিকেটেই কোচিং জীবন শুরু করেছে। লঙ্কান দলে না পেলেও আইপিএলে তাদেরকে আমি কোচিং করিয়েছি। অসাধারণ ক্রিকেটার তারা।
প্রশ্ন: আইপিএল, ফ্রাঞ্চাইজির প্রসঙ্গ যখন আসলই তখন একটি বিষয় জানতে চাই। এ সব টুর্নামেন্ট বা প্রতিযোগিতায় আসলে কোচদের কাজ করার ক্ষেত্র কতটুকু ?
ডেভ: আমি আইপিএলে কোচিং করিয়েছি কিছুদিন। অল্প সময় দ্রুত খেলা হয়। এখানে তো আর বেসিক বা অন্য কিছু নিয়ে কাজের সুযোগ নেই। গেম প্ল্যানটাই আসল।
প্রশ্ন: আবার আপনার ব্যক্তিগত জীবনে ফিরে গিয়ে শেষ করছি। আপনার জন্ম শ্রীলঙ্কায়, এখন থাকছেন অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়াতেই কি থাকবেন বাকি জীবন।
ডেভ: না আমি এখন আবার কলম্বো ফিরে এসেছি। আমার স্ত্রী এখন কলম্বোতে। নেপালে দায়িত্ব নেয়ার আগেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ফেব্রুয়ারিতে আমি আবার কলম্বো স্থায়ী হয়েছি। আমার শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়া উভয় পাসপোর্ট আছে। এখন কলম্বো বেশি থাকব, মাঝে মধ্যে অস্ট্রেলিয়া যাব।
প্রশ্ন: থিলান সামারাবীরা সহ আরো অনেক লঙ্কান ক্রিকেটার অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাচ্ছেন। এর কারণটা কি ?
ডেভ: লঙ্কান ক্রিকেটে সেই রকম অর্থ, সুযোগ বা সম্মান তারা পাচ্ছেন না এজন্য যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। এছাড়া তো আমি আর অন্য কোনো ব্যাখা পাই না। তবে এটা ঠিক অস্ট্রেলিয়ায় ক্রীড়ার ক্ষেত্র অনেক বড়।
এজেড/এটি