প্রতিকূলতা পেরিয়ে শরিফুল এখন আভিজাত্যের টেস্ট দলে
তার জীবনের গল্প যেন সিনেমাকেও হার মানায়। বাবা ভূমিহীন কৃষক। মা গৃহিনী। অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। এই পরিবারে বড় হয়ে জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখা নিছকই ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা’র মতো ব্যাপার।
তিনবেলা খেয়ে পরে বেঁচে থাকতেই শরিফুল ইসলামের বাবা পঞ্চগড়ের মৌমারী গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন ঢাকার সাভারে। কৃষিকাজ ছেড়ে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতে শুরু করেন। আর শরিফুলকে ভর্তি করে দেন সাভারের একটি স্কুলে। কিন্তু কে জানত এই ছেলেই একদিন হয়ে যাবে বিশ্বসেরা দলের সদস্য?
বিজ্ঞাপন
২০২০ সালে বাংলাদেশ যে যুব বিশ্বকাপ জিতেছিল সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন শরিফুল। বাঁহাতি এই পেসার নিজেকে চিনিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সেই আসরে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি! মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো জায়গা করে নিলেন বাংলাদেশ টেস্ট দলে।
অথচ তার এই উঠে আসার পথটা ফুলে ফুলে সাজানো ছিল না। পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দণ্ডপাল ইউনিয়নের মৌমারী গ্রামের দুলাল ইসলামের ছেলেটির জাতীয় দলে উঠে আসতে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক বন্ধুর পথ। এমনও দিন গেছে, দুই বেলা খাবারও জোটেনি ঠিকঠাক। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বড়শি হাতে নিজেই বসে পড়তেন পুকুরপাড়ে- মাছ যদি পাওয়া যায় তবেই জুটবে একদিনের খাবার!
বিজ্ঞাপন
সেই শরিফুলের ক্রিকেটার হওয়ার ভাবনা কখনোই ছিল না। ভাবনার বাঁক বদলে যায় ২০১৬ সালে। স্থানীয় এক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে টেপ টেনিস বলে এই পেসারের বোলিং দেখে মুগ্ধ হন রাজশাহীর নামী কোচ আলমগীর কবির। তিনিই পথ দেখান শরিফুলকে। দিনাজপুর থেকে রাজশাহীতে পা রাখেন শরিফুল।
প্রতিভার যত্ন নিয়েছেন আলমগীর কবির। শরিফুল বিশ্ব জয়ের পর বারবার তার গুরুর কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে যান। জানান, ‘খেলার কোনো সরঞ্জাম ছিল না আমার। তিনিই ভারত থেকে আনা একজোড়া নতুন বুট তুলে দেন আমার হাতে। সকালে শুধু আমাকে নিয়েই আলাদা অনুশীলন সেশন করতেন। আর বিকেলে নিজ সন্তানের মতো যত্ন নিতেন।’
২০০১ সালের ৩ জুন জন্ম নেওয়া শরিফুল লম্বায় ৬ ফুট তিন ইঞ্চি। আলাদা করেই চোখে পড়ে তাকে। তবে তার চোখ পড়েছিল মুস্তাফিজুর রহমানের ওপর। ২০১৫ সিরিজে কাটার মাস্টারে মুগ্ধ হয়েই পেস বোলিং আর ক্রিকেটে প্রেম। তারপর যখন আলমগীর কবিরের মতো গুরু মিলল, তখন তাকে আর আটকায় কে?
শরিফুলের জীবনে আরেকজনের ভূমিকার কথা না বললেই নয়। তিনি বড় ভাই আশরাফুল ইসলাম। যিনি ছোট ভাইয়ের চলার পথের কাঁটা একটি একটি করে তুলে এনেছেন। চলার পথটা করে দিয়েছেন মসৃণ। না খেয়ে খেলতে গিয়ে অনেক সময়ই কাবু হয়ে পড়তেন শরিফুল। পান্তাভাতের সঙ্গে লবণ-পেঁয়াজ মাখিয়ে খেয়ে কতক্ষণ আর অনুশীলন করা যায়? তখন ভাইয়ের কাছে টাকা চাইলে ‘না’ শুনতেন না।
ছোট ভাই যখন রাজশাহীতে অনুশীলন ক্লাবে কোর্স করতে গেল তখন আশরাফুল ইসলাম ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি করে টাকা পাঠাতেন। এভাবেই ক্রিকেটের সঙ্গে চলত পড়াশোনাও। এসএসসি পাসের পরই ঢাকায় তৃতীয় বিভাগে খেলার সুযোগ মেলে। ২০১৭ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ৮ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হন। এরপর তো বিপিএল ও বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়েও খেলার সুযোগ এসে যায়।
তারপর তো স্বপ্নের সেই বিশ্বকাপ। গেল বছর বিশ্বজয়ী দলের হয়ে ৬ ম্যাচে তুলে নেন ৯ উইকেট। ইকোনমি ৩.৬৪। এই সাফল্যের পথ ধরেই এরইমধ্যে বাংলাদেশের হয়ে টি-টোয়েন্টি অভিষেকও হয়েছে ১৯ বছর বয়সী শরিফুলের। তিন ম্যাচে শিকার ২ উইকেট। ছিলেন ওয়ানডে দলেও। এবার মিলল টেস্ট দলের পাসওয়ার্ড।
তবে তার সংগ্রামের গল্পটা কিন্তু থেকেই গেছে। ক্ষুধার যন্ত্রণার সেই দিনগুলো ভুলতে পারেন না। তাইতো ক্রিকেট খেলে যেটুকু অর্থ জমিয়েছেন, তাই দিয়ে মৌমারী গ্রামে তুলেছেন টিনশেড পাকা বাড়ি। গার্মেন্টস কারখানা থেকে নিয়ে এসেছেন বড় ভাইকে। তার জন্য গড়েছেন গরুর খামার। বাবাও এখন রিকশা চালান না। ছেলে জাতীয় দলের হয়ে খেলছে। দুলাল ইসলামের চেয়ে সুখী আর কজন আছে!
কে বলে ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা’ যায় না? টাইগার পেসার শরিফুলের ১৯ বছরের জীবনটাই দেখুন!
এটি/এমএইচ/জেএস