প্রথম টেস্ট জয় : আজ জয়ের দিনে কেঁদো না...
প্রথম টেস্ট জয়ের পরের আনন্দ। ছবি : ইন্টারনেট
‘হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা,
আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।’
কাজী নজরুল ইসলাম লিখে গিয়েছিলেন এমন, অনেক আগে। আপনি একটা শব্দ বদলে দিতে পারেন চাইলে। আপনার অনুভূতিটা হয়তো ঠিকঠাক বুঝানো যাবে তাতে। কোনটা? ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট, টেস্টের, ১০ জানুয়ারি ২০০৫ এর।
বিজ্ঞাপন
***
সিনেমার চিত্রনাট্য কখনো কখনো আমাদের নিয়ে যায় কল্পনা সীমানার গহীনে। আমরা ভাবি কিংবা আমাদের ভাবানো হয় এমন কিছু, যাতে আমরা খুঁজে ফিরি তৃপ্তি। লড়াইয়ের গল্প দেখি চোখে, হেরে যাওয়া দেখি। আমাদের দেখানো হয় ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পও। আমরা দেখি একটা ভালো শেষের আশায়। ভালো কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায়।
বিজ্ঞাপন
জীবনের সবকিছুই এমন। কিছু আশা, একটু আনন্দের কল্পনায় হয় সব। কখনো পূরণ হয়, কখনোবা হয় না। তবুও কিছু মানুষ আশা ছাড়েন না, চেষ্টা চালিয়ে যান। সে কাতারে কি বাংলাদেশকে প্রথম টেস্ট থেকে দেখা সবাই থাকবেন শুরুর দিকে? থাকবেন নিশ্চয়ই।
অন্তত একটি টেস্ট জয়ের আশায় পাঁচ বছর অপেক্ষা, ৩৪টি টেস্ট হারতে দেখা কারো ধৈর্য্য; লড়াই করার মানসিকতা কিংবা অকুণ্ঠ সমর্থনের সামর্থ্য নিয়ে সন্দীহান হওয়ার সুযোগ নেই আপনার। আপনি বাহবা দিতে পারেন তাদের। চাইলে কল্পনা করতে পারেন এক অলস দুপুরে ‘অনন্ত কালের অপেক্ষার’ অবসানের আনন্দ।
***
যারা বাংলাদেশের টেস্ট দেখতে শুরু করেছিলেন ২০০০ সালে, তারা দেখতেন কীসের আশায়..? প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া যায় চাইলে এমন। তবে সেটা অবশ্যই উত্তরের আশা না করে। কারণ, এই জবাব বলে কিংবা লিখে বুঝানোর মতো কিছু না। আদতে তারা নিজেরাও জানেন না এর ঠিকঠাক উত্তর। অথবা অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না কখনো।
তবে তারা একটা অনুভূতি টের পেয়েছেন অবশ্যই। ৩১ টেস্ট হারতে দেখার কষ্টের ফলটা পেয়েছেন। সেদিন হয়তো তার কাছে মনে হয়েছে চাইলে আরও একশটা টেস্ট তিনি হারতে দেখতে পারবেন, অপেক্ষাটা পাঁচ থেকে পঞ্চাশ বছর হলেও অসুবিধার তেমন কিছু থাকবে না।
তাদের সেই অনুভূতি এসেছিল যে কারণে, আজ তার ১৫তম বছর। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের দিন। এক অলস দুপুরে হারের অবসান ঘটিয়ে নতুন শুরুর খুঁজে বের হওয়ার দিন।
***
সেদিন কী হয়েছিল?
১০ জানুয়ারি ২০০৫। দুপুর ১২টা ৫৩।
উৎকণ্ঠায় সবাই তাকিয়ে আছেন অপলক। অথবা কান পেতে আছেন রেডিওতে। এমনভাবে, যেন দুনিয়ার সবকিছু তুচ্ছ তখন। এমন সময় প্রতিদিন, মাস কিংবা বছরেও আসে না আর। জীবন কিংবা পৃথিবীতে সৃষ্টি হয় একবারই।
প্রথম ইনিংসে ৪৮৮ রান করেছিল বাংলাদেশ। সেঞ্চুরির খুব কাছে গিয়েও ৯৪ রানে আটকে গিয়েছিলেন হাবিবুল বাশার, রাজিন সালেহ ৮৯তে। জিম্বাবুয়ে তার জবাব দিয়েছিল ৩১২ রান করে। অধিনায়ক তাতেন্দা তাইবু প্রায় সেঞ্চুরির কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন, তবে থেমেছেন ৯২ রানে।
ওই ইনিংসে বাংলাদেশের নায়ক হয়েছিলেন মোহাম্মদ রফিক, পাঁচ উইকেট নিয়ে। পরের ইনিংসে বাশারের ফিফটিতে ডিক্লেয়ার করেছিলে ২০৪ রানে। তাতে হ্যামিল্টন মাসাকাদজাদের জিততে হলে করতে হতো ৩৮১ রান।
বাংলাদেশের তখন জয়ের তেষ্টা, হারের পর হারের চক্র থেকে বের হতে পারার কামনাটা ছিল খুব কাম্য। তবে তার জন্য কেবলই একদিন হাতে ছিল। যা কিছু করার, করতে হবে এই দিনে। যেটা করতে পারবেন না, দেখা যাবে সেটাও।
আগের চারদিন খেলা হয়েছে। এককভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেননি বাংলাদেশের কেউ। হাবিবুল বাশার কিংবা মোহাম্মদ রফিক, যেকোনো একজন হতে পারতেন ম্যাচ সেরা। অন্তত চতুর্থ দিনের শেষ অবধি মনে হচ্ছিল তেমন।
সেটা কি কোনোভাবে কেউ এনামুল হক জুনিয়রের কানে তুলেছিলেন? তুলতে পারেন, নাও পারেন। তবে এনামুল নিজ কাঁধে দায়িত্বটা নিয়েছিলেন। জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে দেয়ার, ক্রিকেটের অভিজাত ফরম্যাটে প্রথম জয়ের স্বাদ দেয়ার, চক্র থেকে বের করে আনার।
স্টুয়ার্ট মাতসিকেনিয়ারিকে দিয়ে শুরু করেছিলেন, একে একে ফিরিয়েছেন মাসাকাদজা, ব্রেন্ডন টেইলর, তাতেন্দা তাইবু, গ্রেইম ক্রেমারকে। থামলেন কোথায় এসে?
জিম্বাবুয়ের তখন দরকার ২৭৭ রান। বাংলাদেশের একটা বল, মানে উইকেট। এরপর? ওই উইকেট পাওয়ার পনেরো বছর পরও খুঁজে ফেরা হবে সেই মুহূর্তে। কে জানে হয়তো শতবর্ষ পরও।
বাংলাদেশের তাড়াটা বোধ হয় বুঝতে পেরেছিলেন এমফুপু। মোহাম্মদ আশরাফুলের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন, তিনি সেটা ধরলেন। বোলারটা ছিলেন এনামুল হক জুনিয়র। তিনি উৎসবে মেতে উঠলেন, আদতে মাতালেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গকিলোমিটারের প্রতিটা কোণাকে। উল্লাসে মেতে উঠলো পথ-ঘাট, অঁজপাড়া গাঁ কিংবা ইট পাথরের কঠিন শহরও।
***
তখন কেউ হয়তো আনমনে কাঁদছেন লুকিয়ে। যিনি হাসি দিয়ে লুকিয়েছেন ৩১ টেস্ট হারের বেদনা। তিনি সেদিন আর চোখের জল লুকাতে পারলেন না। ওই লোকটা জানেন, এটাই শেষ বেদনা না।
ফের হয়তো হেরে যাবে বাংলাদেশ, অসংখ্যবার হারবে অবশ্যম্ভাবীভাবে। কিন্তু তিনি জানেন, এটা প্রথম জয়ের স্বাদ। এটা আর পাওয়া হবে না কখনো। তাই তিনি কাঁদছেন অঝোঁরে, মন খুলে।
তাকে তখন চাইলে কেউ নজরুলের কবিতার এই চারটা লাইন শুনিয়ে দিতে পারতেন কেউ, কে জানে হয়তো দিয়েছেনও। কেবল একটা শব্দ বদলে দিয়ে অথবা যোগ করে। এভাবে-
‘হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা, আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ জয়ের দিনে কেঁদো না।’
এমএইচ