জীবনটাই তিনি বিনোয়োগ করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে। কখনো কোচ, কখনো সংগঠক অথবা অন্য কোনো দায়িত্ব; যখন যেভাবে পেরেছেন, নাজমুল আবেদীন ফাহিম থেকেছেন ক্রিকেটের সঙ্গে। ক্রিকেটারদের খারাপ সময়ের ভরসা হয়েছেন। কাজ করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডেও। ‘অভিমানে’ ওই দায়িত্বও ছেড়েছেন স্বেচ্ছায়।

এরপর ফিরে গেছেন নিজের ‘শেকড়’ বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি)। বিসিবি নির্বাচনের কাউন্সিলরও হয়েছেন বিকেএসপি থেকে। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরিচালক পদে লড়ার। ক্যাটাগরি-৩-এ প্রতিদ্বন্দ্বীও শক্ত বেশ, বোর্ডের অন্যতম দাপুটে পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজন।

কেন হঠাৎ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত? এতদিন তো ক্রিকেটের সঙ্গেই ছিলেন, তাহলে বোর্ডে এসে আলাদা কী করবেন? দেশের ক্রিকেটে সমস্যাটা কোথায়? আগের বোর্ডকে কি ব্যর্থ মনে করেন? এমন বিভিন্ন বিষয়ে নাজমুল আবেদীন ফাহিম দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে।
  
ঢাকা পোস্ট : নির্বাচনের নিয়ে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

যারা ভোটার আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, তারা তো ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে আমাকে। যতটুকু দেখলাম, মনে হচ্ছে আমার নির্বাচন করাটাকে তারা ভালোভাবে দেখছে। আশা করছি যে তাদের সমর্থনটা পাবো। যদিও সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। দুয়েকদিনের মধ্যে হয়তো পারবো। আশা করছি সমর্থন পাবো।

ঢাকা পোস্ট : নির্বাচন কি একেবারেই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত?

কারো সঙ্গে আলাপ হয়নি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে। আমার ধারণা যে ক্রিকেট বোর্ডে গেলে হয়তো আমার কিছু করার আছে। যেটা এখন করলে ক্রিকেটের জন্য ভালো হবে। আমি যেহেতু কাউন্সিলর ছিলাম না আগে। তাই আমার কাউন্সিলরশিপটা দরকার ছিল। সেটা যখন পেয়েছি, তারপরই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি নির্বাচনে আসবো। একদমই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত এটা।

অনেকদিন ধরে রান নেই মুশফিকের ব্যাটে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে তিনি দ্বারস্থ হয়েছিলেন নাজমুল আবেদীন ফাহিমের। ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা পোস্ট : হুট করে নির্বাচনে কেন?

হুট করে না। সবার জন্য চমক হতে পারে। কিন্তু আমি তো কোনো না কোনোভাবে ক্রিকেটের সঙ্গেই ছিলাম। অনেকেই খেলাটাকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, আমি আমার মতে করে করছি। আমি এখন যে জায়গায় আছি, আমার জন্য মনে হয়েছে ভালো হয় যদি পলিসি লেভেলে থাকতে পারি। 

আমার অনেক কিছু দেওয়ার আছে ওই জায়গাটায়। সে জন্যই আসলে নির্বাচনে আসা, নয়তো হয়তো এখনো আগ্রহ হতো না। আমি মনে করি পলিসি লেভেলে আমার থাকাটা বাংলাদেশ ক্রিকেটকে কোনো না কোনোভাবে বেনিফিট দিবে। এটা আমি বিশ্বাস করি দেখেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। 

ঢাকা পোস্ট : আপনি তো ক্রিকেটের সঙ্গেই আছেন। দায়িত্ব নিলে এমন আলাদা কী করবেন?

কিছু কিছু কারণে আমাদের ক্রিকেটটা বাধাগ্রস্ত হয়ে আছে। আঞ্চলিক পর্যায়ে খেলাটাকে ছড়িয়ে দেওয়া। সেটা একটা বড় ব্যাপার। এছাড়া আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটটাকে ভালোভাবে সাজানো। এই জায়গাটায় কিন্তু আমাদের অনেক হা-হুতাশ আছে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকে আমরা গুরুত্ব দেই না ঠিক মতো। কেন সেটা এরকম হয়, এই জায়গায় অনেক কাজ করার আছে। 

খেলার স্বচ্ছতা নিয়ে অনেক ধরনের কথা শুনি। আম্পায়ার নিয়ে ঝামেলা হয়। আমরা এখনো বিদেশি কোচের ওপর বেশি নির্ভরশীল। আমাদের দেশের কোচ বলি, আম্পায়ার, ট্রেনার, ফিজিও, অ্যানালিস্ট। কোনো সহযোগী দেশেও কিন্তু আমাদের কেউ যায় না। তার মানে এই জায়গায় আমরা কিছুই উন্নতি করতে পারিনি। এভাবে তো হতে পারে না। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা।

ঢাকা পোস্ট : এখন যারা দায়িত্বে আছে। তারা কি সবাই জাতীয় দল কেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনা করে?

আমার মনে হয় ওই জায়গাটায় সবার চিন্তা বেশি। এটার মধ্যে দোষের কিছু নাই। জাতীয় দল ভালো করা জরুরি। কিন্তু জাতীয় দলের সত্যিকারার্থে ভালো করার জন্য আমাদের অন্যান্য জায়গাগুলোতে হাত দিতে হবে। ওই জায়গাগুলো যদি ভালো না করতে পারে, তাহলে জাতীয় দল এত ভালো করতে পারবে না। এখন যেমন আছে এর বেশি কিছু করতে পারবে না, এই পর্যন্তই থাকবে। 

এর বাইরে একটা সময় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার চল ছিল। সত্যিকারার্থে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট হতো। যেগুলো এখন নাই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি সত্যিকারের ক্রিকেট হয়, তাহলে কী হবে- আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেক ক্রিকেটার থাকবে। এই যে শিক্ষিত ক্রিকেটার বের হবে, এটা কিন্তু খুব জরুরি। আমরা সবাই জানি যেসব ক্রিকেটার উঠে আসছে, তাদের শিক্ষার মানটা অনেক নিচে। এটাতে একটা সীমাবদ্ধতা রাখতে হবে। 

এটা যদি আমরা বদলাতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খেলোয়াড়দের জন্য কোটা হয়, স্কলারশিপের ব্যবস্থা থাকে। হয়তো সবাই জাতীয় দলে খেলবে না। কেউ হয়তো বিজ্ঞানী হবে, আম্পায়ার হবে, কেউ হয়তো সংগঠক হবে। তাদের মান অন্য লেভেলের হবে। তাই এটা খুব জরুরি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পর্যায়ে সত্যিকারার্থে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট হওয়া।

সাকিব হোন কিংবা সৌম্য সরকার, সবার জন্যই ভরসা তিনি। ফাইল ছবি

ঢাকা পোস্ট : আমাদের এখন খেলোয়াড় তুলে আনার যে প্রক্রিয়া। এটা কি ঠিক আছে?

এখন একটা স্ট্রাকচার আছে। কিন্তু এটা খুব সীমিত। এখান থেকে খুব সীমাবদ্ধ কিছু মানুষের সুযোগ হয়। এটাকে আরও অনেক বড় করতে হবে। এর ভিত্তিটা আরও শক্ত করতে হবে। যেন অনেকে ওই সুযোগটা পায়। এবং ওই লেভেলে খেলার সংখ্যাটা এত কম! গ্রাস-রুড লেভেলে পরিকল্পিত ক্রিকেটের সংখ্যা এত কম! ওগুলো অনেক বাড়াতে হবে। ওখানে অনেক বিনিয়োগ করতে হবে। সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রাস-রুড লেভেলে তো ফ্যাসিলিটিই নেই!

ঢাকা পোস্ট : ঘরোয়া লিগ কি যথেষ্ট প্রতিযোগিতামূলক, আপনি কী মনে করেন?

ঘরোয়া লিগ প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক হলেই তো জাতীয় দলটাও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। আমাদের খেলোয়াড়রা যদি ঘরোয়া প্রতিযোগিতামূলক লিগে গড়ে ওঠে, তারা তো ওই ধরনের খেলোয়াড় হবে। এখন যেহেতু ওই মানের ক্রিকেটটা নেই। তাই খেলোয়াড়দের মানও ওই রকম হয় না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গিয়ে এজন্যই ওরা বিপদে পড়ে। ভারতে ঘরোয়া লিগ এত প্রতিযোগিতামূলক, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেললে তারা টেরই পায় না। 

ঢাকা পোস্ট : ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে এত সমালোচনা কেন?

বোর্ডের ব্যর্থতার চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে এর গুরুত্বগুলো কেউ অনুভব করে না। এগুলো সুন্দর করে সাজানোর মধ্যে দিয়ে ক্রিকেট কতটা লাভবান হবে, সেটা কেউ উপলব্ধি করে না। যদি করতো তাহলে আমার মনে হয় আরও সুন্দর করে সাজাতো। কারণ ওখান থেকে খেলোয়াড়রা গড়ে উঠবে।

আমি জানি না কেন এটা দেখে নাই। ওটা যদি ভালো মতো দেখে। আমরা যদি পরিবেশটা আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তাহলে আরও ভালো ক্রিকেট হবে। এটা নিয়ে আসলে কোনো সন্দেহ নেই।

ঢাকা পোস্ট : নির্বাচনে এলেন, আগের বোর্ডদের ব্যর্থ মনে করেই আসা?

তাদের ব্যর্থ বলব কেন? আমাদের ক্রিকেট তো অবশ্যই এগিয়েছে। ক্রিকেট তো সত্যিই একটা জায়গায় আছে। দেশের কিছু নিয়ে যদি গর্ব করি, সেটা ক্রিকেটেরই। সেটার কৃতিত্ব তো এতদিন যারা বোর্ড চালিয়েছে বা এর আগে ছিল, তাদেরই। 

আমি যেটা বুঝি, বিভিন্ন লেভেলে কাজ করার আমার যে অভিজ্ঞতা। একেবারে নিচে থেকে উপরে পর্যন্ত। আমি যেসব জিনিসের মুখোমুখি হয়েছি, আমি খুব ভালোভাবে জানি কোথায় কী হচ্ছে। আমাদের প্রেক্ষাপটটা কেমন। সেগুলো আমি ব্যবহার করতে পারবো। যদি আমাকে সুযোগ দেওয়া হয় কী দরকার আমাদের সেটা বুঝতে পারবো। 

সেটাই আমার মূল উদ্দেশ্যে। আমার যে অভিজ্ঞতাটা সেটা অনেকের নেই। আমি যেটা যেভাবে দেখতে পাই, সেটা হয়তো অনেকেই দেখতে পায় না। সেটা তাদের দোষ না। কারণ তারা আমার মতো এভাবে কাজ করেনি। সবাই চেষ্টা করে। কেউ যে চেষ্টা করছে না, এমন না। কিন্তু হয়তো কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে হয়তো অনেকের চোখে পড়ে না। যেগুলো চোখে পড়া উচিত।

ইতি টেনেছিলেন বিসিবির সঙ্গে সম্পর্কেরও। ফাইল ছবি

ঢাকা পোস্ট : সভাপতি বলেছেন নতুন মুখ দেখতে চান, তবুও নির্বাচন নিয়ে কি কোনো উৎকণ্ঠা আছে?

সভাপতি নতুনদের কথা বলেছেন। হয়তো উনি ভেবেছেন নতুন মুখ আসলে ফ্রেশ আইডিয়া আসবে। নিশ্চয়ই এটা একটা ভালো চিন্তা উনার। নির্বাচনে যেটা হলো অনেক কাউন্সিলর আছেন, যারা বোর্ডের বেতনভুক্ত কর্মচারী। আমি জানি না তাদের মানসিকতা কী হবে এই নির্বাচনে।

তবে আমি বিশ্বাস করতে চাই এখানে স্বচ্ছ নির্বাচন হবে। যারাই কাউন্সিলর আছে, ভোট দেবে। তারা সব ভেবে চিন্তেই দেবে। তারা সবাই নিশ্চয়ই ক্রিকেটের ভালো চায়। আর সেটার জন্য যা ভালো হবে, তারা সেটাই করবে। আমি সেটাকে অবশ্যই সম্মান করব। 

ঢাকা পোস্ট : খালেদ মাহমুদ সুজনকে প্রতিপক্ষ হিসেবে কীভাবে দেখেন?

সুজন তো অনেক দিন ধরে কাজ করছে। যথেষ্ট ভালো কাজ করেছে, কোনো সন্দেহ নেই। অনেক ব্যাপারেই আমরা তার প্রশংসা করি।  তবে যেটা হয়, অনেকদিন কাজ করতে করতে অনেক জিনিস কাছ থেকে দেখা যায় না। সেটা দূর থেকে দেখা যায়। 

আমি যেহেতু অনেকদিন ধরে দূরে আছি। সেজন্য আমি দূর থেকে হয়তো অনেক কিছু দেখি। যেটা হয়তো যারা খুব কাছে থাকে তারা দেখতে পায় না। আমি এটুকু বলি, সুজন অনেক ভালো কাজ করেছে। তার জন্য আমার শুভ কামনা থাকলো।

ঢাকা পোস্ট : কিন্তু তাকে নিয়ে সমালোচনা কেন হয়?

এটার জবাব বোধ হয় সুজনই ভালো বলতে পারবে। আমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলতে চাই না। কেউ যদি বলে থাকে, তারা কেন বলেছে, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে। আমি শুধু তার জন্য শুভ কামনা জানাতে পারি। 

এমএইচ/এটি