সবার মধ্যেই কেমন যেন একটা তাড়াহুড়ো। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে জানে না কেউ। হাঁটছে তো হাঁটছেই, প্রশস্ত আর ঝা-চকচকে ফুটপাত ধরে হেঁটে কোথায় গিয়ে থামবে কে জানে! আগের দিন রাতেই পাকিস্তানি ট্যাক্সি ড্রাইভার আলি জাফর বলছিলেন, ‘এখানে সবাই ব্যস্ত, দম ফেলার সুযোগ নেই। কাজ আর ঘুম- আর কিছুই নেই আমাদের জীবনে।’

কথাটা অবশ্য মিথ্যে নয়। তবে কাজ-ঘুমের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে ক্রিকেট। সংযুক্ত আরব আমিরাতে থাকা প্রবাসী, বিশেষ করে বাংলাদেশিদের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে ক্রিকেট রোমাঞ্চ। বিশ্বকাপ বলে কথা। আর বাংলাদেশ দল যখন সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে আমিরাতে চলেই এসেছে তখন কি আর সাকিব-মুশফিকদের নিয়ে না মেতে উঠলে হয়?

আজ রোববার থেকেই সেই উন্মাদনার শুরু। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচটা দেখতে টিকিট কোথায় পাওয়া যায় বলুন তো? অনলাইনে বিক্রি চলছে আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচের টিকিট। সেখানে বুকিংও দিয়েছেন। কিন্তু তর সইছিল না মুন্সীগঞ্জের বাদল মিয়ার। শারজায় একটি দোকানে কাজ করেন। গলায় বিশ্বকাপের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ঝুলতে দেখে আমাকেই মনে করলেন আইসিসির কেউ। আগ বাড়িয়ে এসে বলে উঠলেন, ‘বাংলাদেশের খেলা দেখব, টিকিট কোথায় পাওয়া যাবে জানেন? অনলাইনে বুকিং দিয়েছি, কিন্তু টিকিট তো পাইনি!’

শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে ঢাকা পোস্টের পেজে ফেসবুক লাইভ করা শেষ হতেই আরেকজন চিৎকার করে উঠলেন, ‘ভাই আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?’ পারলে এই প্রবাসী যেন জড়িয়ে ধরেন। করোনার কারণে অনেক দিন দেশে যাওয়া হয়নি আব্দুল মান্নানের। তিনিও ক্রিকেটের টানে, সাকিবদের খেলা দেখবেন বলে ছুটে এসেছেন শারজাহ স্টেডিয়ামের সামনে। মুখের মাস্ক সরিয়ে রেখে বলছিলেন, ‘ভাই আপনাদের দেখে যে কী ভালো লাগছে। এই মরুভূমির দেশে শুধু রুটি-রুজির জন্য পড়ে আছি। দেশের জন্য মন কাঁদে।’

আন্তরিকতার শেষ এখানেই নয়। কাজ শেষে হোটেলে ফিরব, জানতেই দৌড়ে গিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে এলেন আব্দুল মান্নান। চট্টগ্রামের এই যুবক জানাচ্ছিলেন, ৭ বছর হলো তিনি দুবাইয়ে আছেন। শারজায় ট্যাক্সি চালান। আর বন্ধুরা মিলে একটা কফিশপ দিয়েছেন। দিন শেষে সেখানেও কিছুটা সময় দেন। আবদার করলেন- তার সেই শপে গিয়ে এক কাপ কফি খেতেই হবে।

শুধু মান্নানই নন, আমিরাতের দুবাই-শারজার যেখানেই পা রাখছি প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই আন্তরিকতা ছুঁয়ে যাচ্ছে। যার সঙ্গেই পরিচয় হচ্ছে, ফোন নম্বর রাখছেন, যোগাযোগ করছেন। আবার সারাদিনের কাজ শেষে কেউ হাজির হয়ে যাচ্ছেন হোটেলেও। অকৃত্রিম ভালোবাসা যাকে বলে।

দেশে বসে আমরা প্রায়ই প্রবাসীদের সুখ-দুঃখের গল্প শুনি। সেই গল্প শোনার আগ্রহ থেকেই ঢাকা পোস্টের সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রতিনিধি মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুনের সহযোগিতা চাইছিলাম। তিনি তার চট্টগ্রামের উচ্চারণে যা বললেন, তা অনেকটা এমন, ‘মনে শত যন্ত্রণা-দুঃখ পুষে রাখলেও কেউ কথা বলবে না। কেউ তার চাপা কষ্ট আপনার কাছে, একজন সাংবাদিকের কাছে কিংবা কারও কাছে প্রকাশ করবে না। কারণ এই যন্ত্রণার কথা, এই কষ্টের কথা যদি দেশে বসে স্বজন-প্রিয়জনরা জেনে যায় তবে আরও বেশি কষ্ট পাবে!’

বুঝতে বাকি থাকল না কাজ আর ঘুমের শহরে দুঃখটাও ভাগ করেন না কেউ। দূর আকাশের ওই তারার কাছে কষ্টের কষ্টের কথা বললেও, ছোট্ট ১০০ স্কয়ারফিটের রুমে গাদাগাদি করে ৬ জনের থাকার এই জীবনের গল্প বলে লাভ কী! কী করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে একেকটা দিরহাম হাতে আসে সেই কথাটা নিজের কাছেই থাকুক! 

চাপা কষ্ট চাপাই পড়ে থাকছে প্রবাসীদের। কথায় তো আছেই সুখ ভাগাভাগি করে নেওয়া যায় দুঃখ সেটা একান্ত নিজের, মরুর দেশে যাযাবরের চোখ দিয়ে দিন দুয়েকে এটাও বুঝে গেলাম! 

তবে সেই দুঃখটা এই সময়ে এসে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়াটাও বেশ শিখে গেছেন প্রবাসীরা। তাইতো সাকিব-মুশফিকরা যখন ক্রিকেটের পসরা নিয়ে হাজির তখন দুবাইয়ের দেইরা সিটি সেন্টারের পাশে এক বাংলাদেশি বলছিলেন, ‘বিশ্বকাপে বাংলাদেশের খেলা যতদিন থাকবে ততদিন ছুটি নিয়েছি মালিকের কাছে। ওই চার ঘণ্টা কোনো কাজ করব না! এত কষ্ট করে দিরহাম কামাই তো একটু মনের শান্তির জন্যই!’ 

ঠিক তাই, মনের শান্তিটাই শেষ কথা। এখানে প্রবাসীরা তো আবেগের পসরা সাজিয়ে বসেই আছেন, মাঠে এখন সাকিব আল হাসান-মুস্তাফিজুর রহমানরা ঠিকঠাক ঝড় তুলতে পারলেই হয়। তাহলে এই প্রবাসীদের এমন ঘাম-রক্তের কষ্টের পয়সাও কিছুটা উসুল হয়ে যাবে!

এটি/এমএইচ/জেএস