ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইট ওয়াশ করেই বাংলাদেশ থেমেছে। ছবি : বিসিবি

প্রত্যাশার সঙ্গে যেন প্রাপ্তির দেখা। ঠিক তাই, মাঠের লড়াইয়ে হিসাবের ছক উল্টে যায়নি। চিত্রনাট্য সেদিনই তো লেখা হয়েছিল, যেদিন করোনা শঙ্কায় বাংলাদেশ সফর থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিলেন সিনিয়র দশ উইন্ডিজ ক্রিকেটার। তারপর অনেকটা ‘বি’ দল নিয়ে ক্যারিবীয়ানরা যখন ঢাকায় তখনই বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, ওয়ানডে লড়াই হবে একপেশে- তিনে তিন।

সোমবার তারই দৃশ্যায়ন হয়েছে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে। ১২০ রানের জয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ হোয়াইট ওয়াশ। ঢাকায় প্রথম ওয়ানডেতে ১০০ বল হাতে রেখে ৭ উইকেটে জয়। পরেরটিতেও উড়ে যায় উইন্ডিজ। এবার দল জেতে ৬ উইকেটে, ৯৭ বল বাকি রেখেই। বিশ্বকাপ সুপার লিগে দারুণ শুরু, তিন ম্যাচে বাংলাদেশ তুলে নিল ৩০ পয়েন্ট। এরচেয়ে ভাল আর কীই বা হতে পারতো।

করোনার দুঃসহ সময় পেরিয়ে ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক আঙিনায় ফেরা। ভাঙাচোরা দল হোক তবুও এই সিরিজ তাই বাংলাদেশের চাওয়ার ছিল অনেক কিছু। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ শেষে ঢাকা পোস্টের পাঠকদের জন্য তাই সেই চাওয়া ও পাওয়ার হিসাব মেলানোর চেষ্টা।

অধিনায়ক তামিমের স্বস্তির সিরিজ

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা সেই ২০০৭ সালে। এরপর দলে জায়গাটা পাকা হতেই নেতৃত্ব বারবারই হাতছানি দিয়েছে তাকে। কিন্তু কলার উঁচু করে মাঠে সবাইকে নির্দেশনা দেওয়ার ব্যাপারটা কখনোই সেভাবে টানেনি এই ওপেনারকে। বারবারই নিজের ব্যাটিং নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চেয়েছেন তামিম। তারপরও মাঝে মূল অধিনায়কের অনুপস্থিতিতে সাময়িক দায়িত্ব নিতে হয়েছে তাকে। তবে সে যাত্রায় সাফল্য থেকেছে সোনার হরিণ হয়ে। 

ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা সরে যেতেই দায়িত্বটা নিতেই হলো তাকে। উইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ দিয়েই দীর্ঘমেয়াদী দায়িত্বটা বুঝে পেলেন তামিম। নেতৃত্ব শুরুর আগের দিনটাতে আত্মবিশ্বাস উপচে পড়েছিল।জানিয়েছিলেন, গড়ে তুলতে চান বাংলাদেশি ‘ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট’। তার কতোটা কী হয়েছে সেই মূল্যায়ন এখনই করাটা যৌক্তিক হবে না। সাকিব আল হাসান যেমনটা বলেছেন, তামিমের ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে বলার আগে দিতে হবে অন্তত এক বছর সময়।

তবে এখন এটুকু নিশ্চিত করেই বলা যায়, অধিনায়কত্বের প্রথম সিরিজটা বেশ উপভোগ করলেন তামিম। দল সাফল্য পেয়েছে। কথা বলেছে তার ব্যাটও। প্রথম ওয়ানডের লো স্কোরিং ম্যাচে ৪৪ দিয়ে শুরু। উইন্ডিজের ব্যাটসম্যানরা যে পিচে আসা-যাওয়ার মিছিলে ছিলেন সেখানেই তিনি অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে খেলেছেন ৬৯ বল, ৯২ মিনিট। 

ঢাকায় সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে আরও সাবলীল তামিম। এবারও স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ালেন এই ওপেনার। উইকেটে থাকলেন ঠিক ১০০ মিনিট। হাঁকালেন ফিফটি। তার নেতৃত্বে দলও পেলো হেসে-খেলে জয়। সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে ফের নিজেকে ছাড়িয়ে গেলেন। এবার ৩১ বছর বয়সী এই বাঁ হাতি থামলেন ৬৪ রানে। ৮০ বলে দেখে-শুনে খেলা ইনিংসে ১ ছক্কার সঙ্গে তিন ৩ চার। সব মিলিয়ে তামিমের জন্য স্বস্তির এক সিরিজ।

জেসন মোহাম্মদের সঙ্গে টস করতে নামছেন তামিম ইকবাল

চ্যাম্পিয়নের মতোই ফিরলেন সাকিব

একজন পেশাদার ক্রিকেটারকে যখন বলা হয়, তুমি খেলতে পারবে না। মাঠের দরজা বন্ধ তোমার জন্য। এরপর সেই ক্রিকেটারটির মনে কী বয়ে যায় তা কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়। দুঃস্বপ্নের মতো একটা বছর পার করেছেন সাকিব আল হাসান। জুয়াড়িদের অনৈতিক প্রস্তাব গোপন রাখার মাশুল গুণে নিষিদ্ধ ছিলেন এক বছর। 

ফেরার পরের প্রথম ম্যাচের স্ক্রিপ্ট যেন নিজের হাতে লেখেন সাকিব। উইন্ডিজের বিপক্ষে হোম অব ক্রিকেটে শুরুতেই ঘূর্ণি বলের মায়াজাল। বোলিং ফিগারটা দেখুন ৭.২-২-৮-৪! তারপর ব্যাট হাতে ১৯। ম্যাচসেরা তিনি ছাড়া আবার কে? দ্বিতীয়টিতেও কম যাননি। এবার ১০ ওভারে ৩০ রানে ২ উইকেট। ব্যাট হাতে ৪৩ রানে অপরাজিত থেকে ফেরেন দলকে জিতিয়ে।

শেষটাতে হাফসেঞ্চুরিতেই থামেন সাকিব। চট্টগ্রামের মাঠে ৮১ বলে ৫১। তারপর বল হাতে কোটা পূরণের আগেই চোট পেয়ে মাঠের বাইরে। বিশ্বকাপে ৬০৬ রান আর ১১ উইকেটের রেশ যেন মিলিয়ে যেতে দিলেন না সাকিব। যেখানে শেষ, সেখান থেকেই শুরু তার। তবে সোমবার চোট নিয়ে অবশ্য ফিরতে হলো তাকে। যদিও কুঁচকির আঘাত সামলে উঠতে হাতে সময়ও আছে কিছুটা। টেস্ট সিরিজ শুরু তিন ফেব্রুয়ারি।

সাকিব ফিরেছেন তার মতোই। 

পেস বিভাগে নতুনের ছোঁয়া 

২০২১ -এর শুরুতেই চোখ ২০২৩ বিশ্বকাপে। এই ভাবনা থেকেই ওয়ানডে দলে নতুনের ছোঁয়া। দলে জায়গা পান নতুন তিন মুখ শরিফুল ইসলাম ও হাসান মাহমুদ ও শেখ মেহেদি হাসান। এরমধ্যে অবশ্য খেলার সুযোগ পেলেন শুধুই পেসার হাসান মাহমুদ। অভিষেক ম্যাচে ৩ উইকেট। তার পরের ম্যাচে শিকার এক উইকেট। 

পেস জুটিতে মুস্তাফিজুর রহমানকেও দেখা গেল বেশ সাবলীল। সফল তিনিও। প্রথম ম্যাচে ৬ ওভারে ২০ রানে ২ উইকেট। পরের ম্যাচে ৮ ওভারে ১৫ রানে ২ উইকেট। শেষ ম্যাচে সুযোগ পেয়ে কাজে লাগালেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। সামনেই নিউজিল্যান্ড সফর। সন্দেহ নেই পেস অ্যাটাকে এমন নতুনের ছোঁয়া তাসমানের পাড়ের দেশটিতে বেশ কাজে দেবে। কিউইদের বিপক্ষে সামনে চার পেসার নিয়ে খেলার চ্যালেঞ্জটা তো নিতেই পারে টাইগাররা।

হাসান মাহমুদ, কতটা নজর কাড়লেন?

রিজার্ভ বেঞ্চে অনেক অপশন

একটা দল তখনই এগিয়ে যায় যখন তার রিজার্ভ বেঞ্চ শক্তিশালী। কথাটির যৌক্তিকতা খুঁজতে বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সদ্য শেষ হওয়া বর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে চোখ রাখলেই চলবে। ইনজুরির মিছিলে ভারতীয় দলটা রীতিমতো বিধ্বস্ত হলেও সিরিজ শেষে ঠিকই তাদের মুখে হাসি। রিজার্ভ বেঞ্চের ক্রিকেটারদের হাত ধরেই দলটি টেস্ট সিরিজ জিতে ফিরেছে দেশে। এবার উইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশ দলটাকেও দেখে মনে হয়েছে  রিজার্ভ বেঞ্চ শক্তিশালী। নির্বাচকদের হাতে অপশনও অনেক।

চাইলেই তো টিম ম্যানেজম্যান্ট সিরিজ জয় নিশ্চিতের পর শেষ ম্যাচে পরখ করে নিতে পারতেন পেসার শরিফুল ইসলাম কিংবা অলরাউন্ডার শেখ মেহেদি হাসানকে। মোহাম্মদ মিঠুন, আফিফ হোসেন আর তাইজুল ইসলাম তো সুযোগই পেলেন না! টিম ম্যানেজম্যান্টও ছিল মধুর সমস্যায়। কাকে রেখে কাকে নেবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। 

তবে ভাবনা যেহেতু ২০২৩ বিশ্বকাপ, তাহলে শেষ ম্যাচে এসে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাই যেতো। কিন্তু দেশের মাঠে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষের বিপক্ষেই সেই সাহস দেখাতে পারল না টিম ম্যানেজম্যান্ট। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে নিজেদের দেখা নেওয়ার এই পরীক্ষাটা কোথায় করবে তারা?

শান্ত কেন তিনে, সৌম্য সাতে?

কথায় আছে রাজনীতিতে নাকি শেষ কথা বলে কিছু নেই। কিন্তু ক্রিকেটেও যেন একই কথা বেশ মানিয়ে যায়। সাকিব যখন ফিরেছেন তখন তিন নম্বর জায়গাটা তো তারই হওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি। গত বিশ্বকাপে তার প্রিয় পজিশনে আট ম্যাচে ৮৬.৫৭ গড়ে ৯৩.০৩ স্ট্রাইক নিয়ে করেন ৬০৬ রান। সেই তাকে কিনা টিম ম্যানেজম্যান্ট নামিয়ে দিল চারে। নাজমুল হোসেন শান্ত খেললেন তার জায়গায়।

তবে প্রথম দফায় সিদ্ধান্তটাকে যৌক্তিক করে তুলতে পারেননি শান্ত। প্রথম ম্যাচে ফিরলেন মাত্র ১ রানে। পরেরটিতে ১৭। তারপর কিছুটা সম্ভাবনা জাগিয়ে ২০ রানে আউট। চট্টগ্রামে শুরুতেই জীবন পেয়েও কাজে লাগানো হলো না। যেখানে ব্যাটিং অর্ডারে তিন নম্বরে সাকিবের পরীক্ষিত একজন ছিলেন, সেখানে শান্তকে দিয়ে কেন এই চেষ্টা? সাকিব যদিও চারে নেমেও সফল তারপরও শান্তকে আর কতোভাবে বোর্ড কর্তারা ‘স্পন্সর’ করবেন সে প্রশ্ন তো তোলাই যায়!

একইভাবে সৌম্য সরকার কেন সাত নম্বরে, সে প্রশ্নের যুতসই উত্তরও নেই। কারণ তিনি স্পেশালিষ্ট ওপেনার। পাওয়ার প্লেকে কাজে লাগিয়ে ওভার দ্য টপ খেলাতেই স্বাচ্ছন্দ্য, সফলতাও এভাবেই এসেছে যেটুকু আসার। লিটন দাস-তামিম ইকবাল ওপেনিংয়ে মানিয়ে যাওয়ায় অন্তত টপ অর্ডারে জায়গা হতে পারতো সৌম্যর। হয়তো শেষের ঝড়ের জন্য তাকে নিচে নামানো হয়েছে। কিন্তু ব্যাটিং অর্ডারের এমন উলটপালট করে টপ অর্ডারের ব্যাটসম্যানকে জোর করে স্লগার বানিয়ে দেওয়ার এই চেষ্টা আদৌ ভাল কিছু হচ্ছে কিনা সেটা এখনই ভাবার চূড়ান্ত সময়। 

শান্ত কেন তিনে, প্রশ্ন উঠতেই পারে...

জৈব সুরক্ষা বলয়ে বন্দী ক্রিকেট, এবং...

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে যাপিত জীবনের অনেক কিছুই। ক্রিকেট মাঠও তার ব্যতিক্রম নয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরতেই নতুন এক টার্ম যোগ হয়েছে-বায়ো বাবল। মানে জৈব সুরক্ষা বলয়। যেখানে সুরক্ষা দেয়ালে বন্দি ক্রিকেটার, আম্পায়ার থেকে শুরু করে ম্যাচ সংশ্লিষ্ট সবাই। করোনার কারণে এবারই প্রথম মাঠের দুই আম্পায়ারই থাকলেন বাংলাদেশের। এমন কী ম্যাচ রেফারিও স্বাগতিক দেশের। নিয়ামুর রশিদ রাহুল এই ম্যাচেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ম্যাচ রেফারি হিসেবে শুরু করলেন পথচলা।

তবে কোথায় যেন আক্ষেপের অন্য নাম হয়ে থাকলেন গ্যালারির দর্শকরা। দর্শক শূন্য গ্যালারি। অথচ বাংলাদেশে রঙিন পোশাকের ক্রিকেট মানেই গ্যালারিতে বাঘের গর্জন। কিন্তু করোনার কারণে গ্যালারির গেট বন্ধ। দর্শকদের প্রবেশাধিকার নেই। ফাঁকা স্টেডিয়াম। অস্ট্রেলিয়া সাহস করে গ্যালারি খুলে দিলেও বাংলাদেশ পারছে না। 

দর্শক শূন্য গ্যালারি নিয়ে অবশ্য সমালোচনায় মেতে উঠারও সুযোগ কোথায়? ভ্যাকসিন সবে এসেছে। একদিন ঠিকই শান্ত হবে পৃথিবী। তার আগে চলুন ক্রিকেট যে অন্তত মাঠে ফিরেছে তাতেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলে চোখ রাখি টেলিভিশনের পর্দায়! ওয়ানডেতে হাসিমুখ, টেস্টও হোক ইচ্ছে পূরণের এক সিরিজ!

জৈব সুরক্ষা বলয়ের ভেতরে হলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরেছে বাংলাদেশে..

এটি/এমএইচ