আরও একটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলে গেছে, যেখানে একরাশ ব্যর্থতাই কেবল পেয়েছে বাংলাদেশ। আরও একটা বিশ্বকাপ চলে গেছে আইসিসির শীর্ষসারির কোনো দলের বিপক্ষে জয় ছাড়াই। তবে এবার দলের দেহভাষ্য, আর মাঠের বাইরে বিশেষ করে সংবাদ সম্মেলনে দলের আচরণ নিয়েও আলোচনা হচ্ছে বেশ।

এমন এক ব্যর্থতায় ভরা বিশ্বকাপ শেষে বাংলাদেশ দলের পরবর্তী নিয়তি কী? আর সবার কাছে বিষয়টা ধোঁয়াশায় থাকলেও বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার কাছে ভবিষ্যৎটা জলবৎ তরলং। সেটা ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটা স্ট্যাটাসের মাধ্যমে বন্ধুদেরকে জানিয়েও দিলেন তিনি। 

মাশরাফি স্ট্যাটাসের শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশ যে ঢংয়ে হেরেছে, তাতে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দলের দায় এড়ানোর উপায় নেই। এমন অবস্থায় দলের পাশে দাঁড়ানোর কাজটাও বেশ কঠিন। 

‘নড়াইল এক্সপ্রেসের’ ভাষ্য, ‘আরও একটি বিশ্বকাপ শেষ হলো। ৮ ম্যাচ খেলেছি, ২টি জয়, ৬টি হার...। প্রথমেই বলে নেই, ক্রিকেটারদের দায় কোনোভাবেই এড়ানোর উপায় নেই। বিশেষ করে, যেভাবে আমরা হেরেছি।’

মাশরাফি জানালেন, ধৈর্য ধরে সঠিক প্রক্রিয়াতে থাকাই এখন দলের একমাত্র কর্তব্য। দল যে শিগগিরই ঘুরে দাঁড়াবে, তা নিয়েও কোনোপ্রকারের সন্দেহ নেই বাংলাদেশি এই পেসারের। মাশরাফি লিখলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, ওরা হয়তো খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে। ঠিক এই মুহূর্তে ক্রিকেটারদের উচিত ধৈর্য ধরা ও সঠিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা। কোনো সমালোচনার জবাব দেওয়া উচিত নয়। আশা করি, তারা বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবে এবং সঠিক কাজটি করবে।’

এ তো গেল কেবল মাঠের ক্রিকেট। মাঠের খেলায় যা হয়েছে, তাতে শেষ কিছুদিনে বাইরের ঘটনাপ্রবাহেরও দায় দেখছেন মাশরাফি। আর জানিয়েও দিলেন, যদি দায়টা কেবল ক্রিকেটারদের ঘাড়েই বর্তায়, তাহলে দেশের ক্রিকেটের জন্য আরও খারাপ সময়ও অপেক্ষা করছে। বললেন, ‘কিছু ব্যাপার মেলানো প্রয়োজন। সেটা হলো, খারাপ হওয়ার প্রথম দায় অবশ্যই ক্রিকেটারদের। এরপর আর কি কারও দায় নেই? শুধু ক্রিকেটারদের ঘাড়ে চাপিয়ে যদি শেষ করেন, তাহলে মনে রাখবেন, আরও খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। প্রমাণ তো আগেও দেখা গেছে!’ 

অবস্থাদৃষ্টে, আর অতীত অভিজ্ঞতা মিলিয়ে মাশরাফির মনে হচ্ছে, সেটাই করা হবে দলের সঙ্গে। তার কথা, ‘আগের অভিজ্ঞতা থেকে এবারও বলে দেওয়া যায়, এখন সামনে কী হবে। হয়তো কাউকে বাদ দেওয়া হবে, কারও ওপর অদৃশ্য রাগ ঝাড়া হবে, রিয়াদকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হবে। সমর্থকরা যে ক্রিকেটারকে পছন্দ করছে না, তার ওপর ঝাল মিটিয়ে সমর্থকদের শান্ত করা হবে। সাংবাদিক ভাইদের নানা কিছু বোঝানোর চেষ্টা করা হবে।’

কর্তাদের এমন কিছু করার কারণটাও জানালেন মাশরাফি, ‘আগেও দেখেছি যে, এসব করে একেকটা পক্ষ দাঁড় করানো হয় এবং বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, সামনের বিশ্বকাপে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরাও ভাই আবেগী মানুষ, এসব দেখে সব ভুলে আশা নিয়ে সামনে তাকিয়ে থাকব। এরপর বিশ্বকাপ আসবে, দেখা যাবে একই ফলের পুনরাবৃত্তি!’ 

বিশ্বকাপে ভরাডুবির দায়টা কর্তাদেরও মাথাপেতে নিতে বললেন সাবেক বাংলাদেশ অধিনায়ক, ‘ক্রিকেটারদের দায় দিন, ভালো কথা। সেটা তাদের প্রাপ্য। পাশাপাশি, নিজেরাও বোঝার চেষ্টা করুন যে আপনারাও ব্যর্থ! কারণ, এই পুরো প্রক্রিয়ার অংশ আপনারাও। আপনারা অন্যান্যবারের মতো বলতেই পারেন, “অমুকের জন্য পারিনি, তমুক ব্যর্থ হয়েছে, এ জন্যই পারলাম না।” সে ক্ষেত্রে তো দায়টা আপনাদেরও, কারণ উপযুক্ত বিকল্প আপনারা তৈরি করতে পারেননি। সেই দায়িত্ব তো আপনাদের কাঁধেই ছিল আপনাদের তো আগেই বোঝা উচিত ছিল! আপনারা সেটা পারেননি। তাই দয়া করে, সত্যকে আলিঙ্গন করুন এবং নতুনভাবে কাজ শুরু করুন।’

মাশরাফি এরপর বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রক্রিয়া ঠিক করার তাগাদাও দিলেন। বললেন, ‘সামনে আরেকটি বিশ্বকাপের দোহাই দিয়ে, ক্রিকেটারদের ক্ষতি না করে প্রক্রিয়াটা ঠিক করুন। দেখবেন, তখন দল আপনাআপনি ভালো খেলবে। দলকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আপনাদেরই। তাই দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে দায়িত্ব নিয়েই কথা বলা বা কাজ আমরা আশা করি। সবচেয়ে বড় শঙ্কা আমি যা দেখছি, ক্রিকেটারদের বলির পাঠা বানিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দেওয়া হবে যে, “আমরা অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যা সামনের বিশ্বকাপে বড় ভূমিকা রাখবে।” আসলে এতে ক্রিকেটের কোনো লাভ হবে না। ক্রিকেটার তৈরি ও গড়ে তুলতে আধুনিক ক্রিকেটে প্রক্রিয়াগুলো দেখুন এবং সেগুলো দেশের ক্রিকেটে অ্যাপ্লাই করুন। তাদের যত্ন করুন, হয়তো তারা সামনের পথচলায় আমাদের দারুণ সব মুহূর্ত উপহার দেবে।’

সে প্রক্রিয়া ঠিক করলেও যে সহসাই ফল মিলবে না, সেটাও জানালেন মাশরাফি। বললেন, ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই প্রক্রিয়ায় সময় লাগবে। কারণ একজন প্রপার খেলোয়াড় তৈরি করতে অনেক সময় লাগে। সবাই না বুঝলেও, ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট লোকদের এসব বোঝা উচিত। তাই সময় লাগুক, কিন্তু প্রক্রিয়া নতুন করে সাজান। ত্বরিত সিদ্ধান্ত খুব বেশি কাজে দেবে না। দয়া করে এই কথা বলবেন না যে, “২০২২ বা ২০২৩ বিশ্বকাপে এদের দিয়ে হবে না, তাই সব নতুন সুযোগ দিতে হবে।” নতুনদের সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে, তবে তাদের তৈরি করে।’ 

সাবেক বাংলাদেশ অধিনায়ক জানালেন, দেশের ক্রিকেটের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবেই এই পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। অনুরোধ করেছেন এ লেখাকে ব্যক্তিগতভাবে না দেখারও। তিনি তার স্ট্যাটাসের শেষাংশে লিখেছেন, ‘আমরা আপনাদের সঙ্গেই আছি, কারণ আমাদের শরীরের প্রতিটি রক্ত কণিকায় শুধু ক্রিকেটই বসবাস করে। দয়া করে কেউ পারসোনালি নেবেন না আশা করি। দূরে থেকেও আমরা আপনাদের শুভাকাঙ্ক্ষী। আজীবনই তা থাকব।’

এনইউ