তখন মধ্যরাত। দুবাই ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রেসবক্স থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে দেখি রাজপথের ব্যস্ততা কমেনি। শহর থেকে অনেকটা দূরের পথ। তবে ভাগ্য ভালোই বলতে হবে, চটজলদি একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। পার্কিং জোন না থাকায় চোখের পলকে ওঠে বসতে হলো। কারণ দুবাই পুলিশের নজরে পড়লেই মোটা অঙ্কের জরিমানা হয়ে যাবে চালকের। গাড়ির সিটে না বসতেই ড্রাইভার এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকলেন, ‘কী হয়েছে বলুন, পাকিস্তান কেন এভাবে হারল? হারার তো কথা না! রানও তো অনেক তুলল। তারপরও কেন এমন হার?’

উত্তর শোনার অপেক্ষা না করে পাকিস্তানি চালক অনবরত মিনিটে পাঁচেক এভাবেই উর্দুতে বলে যেতে থাকলেন। এমন কী কোথায় যাবো, গন্তব্য কোথায় সেসবও জানতে চাইলেন না! বুঝতে পারছিলাম, ফেভারিট হিসেবে খেলতে নেমে পাকিস্তানের এমন হার তিনি মানতে পারছেন না। অস্ট্রেলিয়ার কাছে সেমিফাইনালে হেরে দল এভাবে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাবে হয়তো কল্পনাও করতে পারছেন না। 

বৃহস্পতিবার সেমিফাইনাল ম্যাচ শেষ হওয়ার পর থেকে এভাবেই বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলায় দুলছে পাকিস্তানি সমর্থকেরা। কিছুতেই সমীকরণ মেলাতে পারছে না তারা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে রেকর্ড গড়া (১০ উইকেটে) জয়ে শুরু। এরপর জয়টাকে রীতিমতো অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছিল বাবর আজমের দল। টানা ৫ জয়ে সেমিফাইনালে পা রাখে। দুবাইয়ের গ্যালারিতে উপচে ওঠা পাকিস্তানি দর্শকের সমর্থন নিয়ে মাঠে নেমে শেষ দিকে এসে সব তালগোল পাকিয়ে গেল। জিততে জিততে শেষ দিকে এসে হেরে গেল পাকিস্তান!

কেন এমন হলো? ভুলটা আসলে কোথায়? ম্যাচ শেষ হতেই দুবাই ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রেস বক্সে কথা হচ্ছিল পাকিস্তানি সাংবাদিক সৈয়দ ওয়াজির আল কাদেরির সঙ্গে। যিনি করাচির উর্দু পত্রিকা ‘জাসারাত’ এর ক্রীড়া সম্পাদক। হতাশ গলায় বলছিলেন, ‘দেখুন, কথায় তো আছেই ক্যাচ ফসকালে ম্যাচটাও ফস্কে যায়। ১৯তম ওভারে ম্যাথু ওয়েডের ক্যাচ ফেলেন হাসান আলী। এরপর তো দেখেছেনই ওয়েড ছক্কার ঝড়ে ম্যাচটা জিতে গেল। এমনটা প্রত্যাশিত ছিল না। যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখি তবে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে অস্ট্রেলিয়াকে। তারা কিন্তু কখনোই ম্যাচ থেকে ছিটকে যায়নি। শুরুতে উইকেট হারালেও রান তুলে গেছে সমান তালে। তার পথ ধরেই শেষটাতে এসে ওয়েড আর মার্কাস স্টয়নিস ম্যাচটা ছিনিয়ে নিল।’

ঠিক তাই। ম্যাচটা পাকিস্তানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে অজিরা। শেষটাতে এসে চাপে থাকা ম্যাথু ওয়েড বল তুলেছিলেন আকাশে। কিন্তু ডিপ মিডউইকেটে দাঁড়িয়ে সেই সহজ ক্যাচ জমাতে পারেননি হাসান আলী। ক্যাচ ফেলে দেন পাকিস্তানি এই ক্রিকেটার। সঙ্গে ২ রান বোনাস পেয়ে যান ওয়েড। পরের তিন বলে টানা তিন ছক্কা মেরে দলকে ফাইনালে নিয়ে গেলেন তিনি।

ম্যাচশেষে আক্ষেপে পুড়তে পুড়তে পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম বলছিলেন, ‘ব্যাট করে যত রান করার পরিকল্পনা করেছিলাম সেটাই করতে পেরেছি আমরা। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের শেষের দিকে ওদের অনেক সুযোগ দিয়েছি। বড় দলকে এ রকম সুযোগ দিলে তার মূল্য দিতেই হয়। ক্যাচ হাতছাড়া করাটাই ম্যাচের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। ম্যাথু ওয়েডের সেই ক্যাচ ফেলা ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছে। ওই সময় নতুন এক ব্যাটসম্যান এলে পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন হতে পারতো।’

ভিন্ন হয়নি, শেষ ৫ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার দরকার ছিল ৬২। এরপর ১৬তম ওভারে অজিরা নেয় ১২ রান। পরের ওভারে ১৩। ১৮তম ওভারে অস্ট্রেলিয়া পায় ১৫ রান। শেষ দুই ওভারে জিততে চাই ২২ রান। ঠিক তখনই ওয়েডের ক্যাচ ফেলেন হাসান। একইসঙ্গে ফস্কে যায় বিশ্বকাপ মিশনও। ১৭ বলে ৪১ রানে সেমি-ফাইনালের সেরা ওয়েড।

অথচ ১৭৬ রান পুঁজি নিয়ে ম্যাচটা প্রায় জিতেই ফেলেছিল পাকিস্তান। দুবাইয়ের উইকেটটা তাদের চেনা। যেখানে দারুণ বল করলেন শাদাব খান। ২৬ রানে তুলে নেন ৪ উইকেট। শাহিন শাহ আফ্রিদিও কম যাননি। শুরুতেই বেক থ্রু এনে দিয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল প্রবল দাপট ধরে রেখে আনপ্রেডিক্টেবল দলটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। কিন্তু শেষে পা পিছলে গেল!

হতাশার সঙ্গে বাস্তবতাটাও মেনে নিলেন বাবর। বলছিলেন, ‘এবারের টি-টোয়োন্ট বিশ্বকাপে আমরা খেলেছি তাতে অধিনায়ক হিসেবে আমি তৃপ্ত। আশা করছি, এই হার থেকে শিক্ষা নিয়ে পরের বিশ্বকাপে আরও শক্তিশালী হয়ে আমরা নামতে পারব। শুরু থেকে ভালো খেলতে থাকলে এ রকম ছোটখাটো ভুল হয়েই থাকে। সেসব শেষ দিকে বড় প্রভাব ফেলে।’ 

পাকিস্তানি দর্শকদের মন ভাঙলেও হতাশায় ভেঙে পড়েনি। এমন কী মাঠ ছাড়তে গিয়ে কেউ বাবরদের সমালোচনাতেও মুখর হয়নি। শুধু হাসান আলি কেন ক্যাচটা হাতে জমাতে পারেননি তা নিয়ে ছিল আক্ষেপ!

সেমিফাইনাল থেকে বিদায়ের পর সবচেয়ে বড় স্বান্তনটা বাবর আজমরা পেয়েছেন দেশ থেকেই। বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক যিনি এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সেই ইমরান খান বৃহস্পতিবার রাতে টুইটারে যা লিখলেন তার অনুবাদ অনেকটা এমন, ‘বাবর আজম ও তার দলকে বলছি, এ মুহুর্তে তোমাদের মনের অবস্থাটা কেমন আমি জানি। কারণ ক্রিকেট মাঠে এমন হতাশায় আছন্ন হওয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। তবে তোমরা যে ক্রিকেট খেলেছো এবং জয়ের জন্য যে বিনয় দেখিয়েছো তাতে তোমার গর্ব করা উচিত।’ সঙ্গে ইমরান অভিনন্দন জানালেন জয়ী অজিদেরও।

ফাইনালে ট্রান্স-তাসমান লড়াই। ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় শিরোপার দুবাইয়ের মাঠে লড়বে তাসমান পাড়ের দুই দেশ অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড। দুটি দলের নামের পাশেই নেই কোন টি-টোয়েন্টি ট্রফি। এর অর্থ নতুন চ্যাম্পিয়ন দেখতে যাচ্ছে বিশ্ব। আর বাংলাদেশ দেখবে যাদের কিছুদিন আগেই মিরপুরে নিজেদের মতো উইকেট বানিয়ে হারিয়েছে, সেই দুই দল খেলছে বিশ্বকাপের ফাইনালে!

এটি