২১ বছরের লম্বা ক্যারিয়ার। জাতীয় দলের হয়ে ৫ টেস্ট আর ৪১ ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা। ১৮২ ম্যাচ খেলে প্রায় ১২ হাজার প্রথম শ্রেণির রান। দেশের সবচেয়ে বেশি, দ্বিতীয় স্থানে থাকা নাঈম ইসলামের রানও প্রায় দুই হাজার কম। বর্ণিল প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন তুষার ইমরান। ১২ হাজারের খুব কাছে গিয়েও ছোঁয়া হয়নি মাইলফলক। 

চাইলেই খেলা চালাতে পারতেন, কেন চালাননি? জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার খুব কাছে গিয়েও পাননি। দায়টা কি নির্দিষ্ট কারও? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঘরোয়া ক্রিকেটে করা রানের বেশির ভাগই উইকেটের পেছন থেকে পেয়েছেন, তিনি নাকি ব্যাটিং করার পর করতেন না ফিল্ডিং। এ নিয়ে তার ভাবনা কী?

এমন নানা বিষয়ে রোববার সন্ধ্যায় তুষার ইমরান দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন ঢাকা পোস্টের ক্রীড়া প্রতিবেদক মাহমুদুল হাসান বাপ্পির সঙ্গে। শুনিয়েছেন নিজের আক্ষেপের কথা, ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্তগুলো। বলেছেন ক্যারিয়ারের উত্থান-পতনের গল্প। বিসিবিতে আসতে চান কি না, দিয়েছেন তার উত্তরও।  

ঢাকা পোস্ট : প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১১,৯৭২ রান। জাতীয় দলের হয়ে ৪৬ ওয়ানডের সঙ্গে পাঁচ টেস্টের ক্যারিয়ার। এখন যখন পেছন ফিরে তাকান, কেমন লাগে?

তুষার ইমরান : ভালোই লাগে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে আমার মতো ক্যারিয়ার হয়তো এখন পর্যন্ত কারও নেই। জাতীয় দলে বেশিদিন সার্ভিস দিতে পারিনি, এটা একটা আক্ষেপ। এমনিতে ঘরোয়া ক্রিকেটের কথা যদি চিন্তা করেন, খারাপ লাগে না। ভালোই লাগে। ২১-২২ বছর পরে অবসরে গেলাম। আমার কাছে মনে হয় একটা উদাহরণ তৈরি করতে পেরেছি।

ঢাকা পোস্ট : এই যে অল্প কিছু রানের জন্য ১২ হাজারের মাইলফলক ছোঁয়া হলো না। আফসোস লাগে না?

তুষার ইমরান : তা তো লাগেই। কিন্তু আগেই আমি বলে দিয়েছিলাম, এটাই আমার শেষ বছর। এরও আগে বলেছিলাম, আমি যেদিন মনে করব রান করতে পারছি না; সেদিন নিজে থেকেই সরে যাব। আমার কাছে মনে হয় সিদ্ধান্তটা সঠিক সময়েই নিয়েছি। যেহেতু এই মৌসুমে আমি চার-পাঁচটা ম্যাচ খেলেছি। 

৭৮ রান বাকি ছিল (মৌসুম শুরুর আগে), করতে পারিনি। ইনজুরির কারণে আমার আর খেলা সম্ভব হচ্ছে না। দুই-তিনটা ম্যাচ মিস করলাম। সামনে আরও খেলা ছিল, চালিয়ে গেলে পারতাম। ১২ হাজার রান পূর্ণ হতো। কিন্তু সম্মানের সঙ্গে চলে যাওয়াটাই ভালো মনে করেছি।  ​

ঢাকা পোস্ট : ক্যারিয়ারে কি আর কোনো আফসোস আছে?

তুষার ইমরান : আফসোস তো আসলে অনেক। ২০০৭ সালের পর তো আর জাতীয় দলে ফিরতে পারলাম না। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত যতদিন জাতীয় দলে খেলেছি, আসা-যাওয়ার ভেতরেই ছিলাম। যখনই খারাপ খেলেছি, বাদ পড়েছি। ঘরোয়া ক্রিকেটে অথবা এ দলে ভালো খেলেই আবার ফিরেছি। 

২০০৭ সালের পর আর সুযোগ হয়নি। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, কিন্তু হয়নি। ২০১৭-১৮ সালের দিকে সুযোগ ছিল কিন্তু সেটা নির্বাচক বলেন বা ক্রিকেট বোর্ড, দেয়নি। এই একটা আক্ষেপ তো কাজ করেই। আমি আমার জায়গা থেকে সাধ্য মতো চেষ্টা করেছি ফিরে আসার। শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছি।

ঢাকা পোস্ট : এই যে ফিরে আসতে পারলেন না বা ফিরতে দেওয়া হলো না, এটা অবিচার মনে করেন কি না?

তুষার ইমরান : আসলে আমার যখন ক্যারিয়ার শুরু হয় তখন অল্প বয়স, টেস্ট খেলা বুঝতাম না কিন্তু খেলে ফেলি। এতে হয় কী, আমার গড়টা কমে যায়। ফলে পরবর্তীতে নির্বাচক যারা ছিলেন, সুযোগটা দেননি। ক্রিকেট বোর্ডও নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করেনি। প্রথমে যে টেস্ট ম্যাচগুলো খেলি, সেখানে যদি ভালো খেলতাম, গড়টা যদি আরেকটু ভালো হতো তাহলে হয়তো সুযোগটা পেতাম।

ঢাকা পোস্ট : বরাবরই বোর্ডের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এটা আপনার ক্যারিয়ারে কোনো প্রভাব ফেলেছে কি?

তুষার ইমরান : আমার কাছে এটা মনে হয় না। বোর্ডের বিপক্ষে অবস্থান নেই কিংবা নেই না... দুয়েক সময় হয়তো কথা বলি...। কিন্তু এখন এই জায়গা থেকে আমার মনে হয়, এই কারণে... প্রথমে যে পাঁচটা টেস্ট খেলি, সেখানে যদি ভালো করতে পারতাম...। 

গড়টা যদি ভালো থাকত, তখন হয়তো নির্বাচক বা বোর্ডের কর্মকর্তারা দ্বিতীয়বার ভাবতেন। ১০ বছর পরও হয়তো চিন্তা করতেন। ‘১৭-১৮ সালের দিকে কথা  উঠেছিল। খুব কাছে থেকেও আবার দলে ঢোকা হয়নি। মনে হয় গড় দেখেই বাদ দেওয়া হয়েছে তখন। 

ঢাকা পোস্ট : কাছে গিয়েও যে ফিরে আসলেন, এর দায়টা কি নির্দিষ্ট কারও বলে মনে করেন?

তুষার ইমরান : না। কাউকে দায়ী করি না। আসলে নিজেকেই দায়ী করি। ওই অল্প বয়সে যদি টেস্ট না খেলতাম! ধরেন, আরও পাঁচ বছর পর যদি আমার টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু হতো। ২০০১-০২-এ না হয়ে সেটা যদি ‘০৫-০৭ এর দিকে হতো। তাহলে আমার কাছে মনে হয়, আমার ভেতরে যে সক্ষমতা ছিল, ভালো কিছু করতে পারতাম।

আমি তখন টেস্ট বুঝতাম না। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটও বেশি খেলিনি, অভিজ্ঞতাও তেমন হয়নি। এখন যদি এই সুযোগ পেতাম। ৩০ বছর বয়সের পর যদি সুযোগটা পেতাম। কিংবা যখন অভিষেক হয়েছে, তার পাঁচ বছর পর যদি হতো। তাহলে জাতীয় দলে ক্যারিয়ারটা আরও লম্বা হতো। 

ঢাকা পোস্ট : ২১ বছরের লম্বা ক্যারিয়ার। সেরা মুহূর্ত বাছাই করাও কঠিন। তাও যদি তিনটা সেরা মুহূর্ত বলেন...

তুষার ইমরান : একটা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কার্ডিফের ওই জয়টা। স্মরণীয় মুহূর্তের মধ্যে মুলতানের টেস্টটাও রাখব। যেটা আমরা জিততে জিততে হেরে গিয়েছিলাম। আরও অনেক আছে। কিন্তু আফসোসের দিক থেকে আমি রাখব ২০০৩ বিশ্বকাপে কেনিয়ার বিপক্ষে হারটা। 

যাওয়ার আগে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যদি একটা ম্যাচেও জিতি, কেনিয়াকে হারাব। আমি ম্যান অব দ্য ম্যাচ হব। কাছে গিয়েও আসলে পারিনি। এটা আমার ক্যারিয়ারের জন্য একটা স্মরণীয় মুহূর্ত।

ঢাকা পোস্ট : কেনিয়াকে হারানোর ওই দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কারণ কী?

তুষার ইমরান : আমরা তখন কেনিয়ার চেয়ে আন্ডার ডগ ছিলাম। কেনিয়া তো ২০০৩ সালে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলে। তখন আমরা ওই রকম ভালো দল না। কানাডার সঙ্গে হেরেছিলাম। আমি দেশ ছাড়ার আগে বলে গিয়েছিলাম, কেনিয়াকে হারাব। কারণ, আমাদের গ্রুপে তারা খুবই শক্তিশালী দল ছিল।

 

ঢাকা পোস্ট : আপনার ব্যাপারে কিছু অভিযোগও শোনা যায়। ঘরোয়াতে করা আপনার রানের বেশির ভাগই বিহাইন্ড স্কয়ার থেকে উইকেটের পেছনের অঞ্চল দিয়ে। ব্যাপারটা কি সত্যি?

তুষার ইমরান : কাট শট ভালো খেলতাম, এজন্য হয়তো উইকেটের পেছন দিয়ে বেশি রান করেছি। দেখেন, ওখানে চার-পাঁচজন ফিল্ডার থাকে, তার ভেতর দিয়েও রান করি। এটা তো আমার দোষ না (হাসি)। অনেকেই বলে, কিন্তু কেন বলে জানি না। 

ঢাকা পোস্ট : অনেকে তো এটাও বলে, আপনি নাকি ফিল্ডিং করতেন না...

তুষার ইমরান : এটা ভাই...ধরেন, ৯০ ওভার ফিল্ডিং করার পর ২-৩ ওভার বাইরে গিয়ে বসে থাকলে যদি কেউ বলে...; ক্রিকেট কেউ খেলছে নাকি তা তো জানি না। এমন হলে তো আম্পায়াররা অভিযোগ দিত, তারা তো দেয়নি।

ঢাকা পোস্ট : জাতীয় দল থেকে যখন বাদ পড়লেন তখন বিসিবির সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করাও কঠিন হয়ে পড়ল। ফিটনেস ঠিক রাখলেন কীভাবে?

তুষার ইমরান : নিজের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম, জাতীয় দলে আবার ফিরে আসব। ২০০৭ সালের পর থেকে আমার ভেতরে ব্যাপারটা কাজ করত। জাতীয় লিগে আমার দলও ছিল খুব শক্তিশালী। দলে সুযোগ পেতে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। লড়াইটা আসলে নিজের সঙ্গে নিজের ছিল।

চিন্তা করতাম, জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা খেলুক অথবা না খেলুক, আমি তাদের থেকে বেশি রান করব। অন্তত আমি একটা পজিশন ধরে রাখতে পারি। খুলনা দল থেকে যেন বাদ না পড়ি। কারণ, এই দলে অনেকেই খেলে, মিথুন-সৌম্য-বিজয়-সোহান। তাদের মধ্যে টিকে থাকা খুবই কঠিন। যদি পারফরম না করতাম তাহলে খুলনা দল থেকেও বাদ পড়তাম।

ঢাকা পোস্ট : আপনি তো নিজের সঙ্গে লড়াই করে টিকে ছিলেন। কিন্তু অন্যরা, জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ে বা ঘরোয়া লিগে নিয়মিত খেলার জন্য যে অনুশীলনের ব্যবস্থার দরকার, তা কি আছে?

তুষার ইমরান : এখানে আসলে সবাইকে সুযোগ দিতে হবে। ঢাকার কথা যদি ধরেন, একটা মাঠ বা খুলনাতে অনেক ফ্যাসিলিটিজ আছে। কিন্তু এজন্য অনেককে ফোন-টোন দিতে হয়। আমার মনে হয় এসব থাকা উচিত না। ঘরোয়া লিগে নিয়মিত খেলে অথবা জাতীয় দলে ছিল এমন খেলোয়াড়দের জন্য ব্যবস্থাপনাগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। সেন্টার উইকেট না হলেও সাইড উইকেট যেন তৈরি করা হয়। 

ঢাকা পোস্ট : আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে অনেকে অনেক কথাই বলেন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলতেন, এখানে উন্নতির জন্য আসলে কী কী করা দরকার? 

তুষার ইমরান : অবশ্যই উইকেটটা বদলাতে হবে। উইকেটের মান ভালো করতে হবে। আমার মনে হয় জাতীয় দলের যে তারকা ক্রিকেটাররা আছেন, তাদের নিয়মিত জাতীয় লিগ বলেন বা বিসিএলে নিয়ে আসতে হবে।

ঢাকা পোস্ট : অবসর তো নিয়েই নিলেন, এখন কি বোর্ডে আসতে চান?

তুষার ইমরান : যদি সুযোগ থাকে, যদি বিসিবি চিন্তা করে যে বাংলাদেশ ক্রিকেটে আমি অবদান রাখতে পারব; তাহলে অবশ্যই আমি তৈরি আছি।

এমএইচ