ছাই মূল্যহীন হয়ে যায় কোথাও। অথবা একদমই অকেজো। দাঁতের মাজন কিংবা বড়জোর ধানক্ষেতে ছিটিয়ে দেওয়ার মধ্যেই কাজ শেষ। অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ডে হলে অবশ্য ব্যাপারটা ভিন্ন। ‘অ্যাশেজ’ হয়ে ওঠে সেখানে। কখনও কখনও হয়ে ওঠে বিশ্বকাপের চেয়েও বড় কিছু!

অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট ক্যামিন্স যেমন প্রমোশনাল ভিডিওতে বলেন, ‘লেগ্যেসি অব অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট’ রক্ষার দায়িত্ব উঠেছে তার কাঁধে। জো রুট জানান আগেভাগে, তার অধিনায়কত্বের ভাগ্য নির্ধারণ হবে এই সিরিজে। কামিন্স বলেন, তার প্রথম মনে থাকা অ্যাশেজের কথা। 

এসসিজিতে ২০০৩-এ স্টিভ ওয়াহ দ্বিতীয় দিনের শেষ বলে চার হাঁকান। ডনকে ছুঁয়ে ফেলেন তিনি সেঞ্চুরি সংখ্যায়, ২৯টি। কামিন্স বলতে থাকেন, ২০১০ সালের কথা। প্রথম বলেই কামিন্সের নায়ক মাইক হাসি ক্যাচ ধরে ফেলেন সেবার। এর ১২ মাস পরই হাসির সতীর্থ বনে যান কামিন্স!

তিনি বলতেই থাকেন, শেন ওয়ার্নের কথা, পান্টার রিকি পন্টিং, অ্যাডিলেডে হাসির সেই ইনিংসের কথা, ওয়াকাতে গিলক্রিস্ট। কামিন্স বলেই যান, তার বর্তমান সতীর্থদের নিয়ে। ওয়ার্নার, স্মিথ, হ্যাজলউড, স্টার্ক, লাবুশেনদের কথা। বলতে বলতে কামিন্সের গলায় ধরা পড়ে রোমাঞ্চ। চোখেমুখে আঁকিবুঁকি কাটে লড়াইয়ের স্পৃহা। 

স্বপ্নের অ্যাশেজের নেতা তো তিনিই। মাসখানেক আগেও যেটি তার হওয়ার কথা ছিল না। রুটের ব্যাপারটা ভিন্ন। শেষ বার যখন অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাশেজ হয়েছিল, ৪-০ ব্যবধানে হেরেছিল ইংল্যান্ড; ওই দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। এবারও তেমন কিছু হলে, পরিণতিটা জানেন রুট। অধিনায়কত্বটা হারাতে হবে নিশ্চিতভাবেই। 

অ্যাশেজটা তো এমনই। হারানোর, ফিরে পাওয়ার, আত্মসম্মানের লড়াইয়ের। শুরুর গল্পটাও তো তেমনই। 

রেজিনাল্ড ব্রুকস ক্রিকেটার ছিলেন না। কোচ কিংবা আম্পায়ারও না। কিন্তু তিনিই হয়ে গেছেন অ্যাশেজের রূপকার। ব্রুকসের কাজ ছিল লেখা। খোঁচা দিতে পছন্দ করতেন তিনি। তেমনই একটা সুযোগ খুঁজছিলেন ইংল্যান্ডকে নিয়ে। তাকে সেটি এনে দেন ‘শয়তান’ ফ্রেডরিক রবার্ট স্পফোর্থ।

পেশায় ছিলেন ব্যাংকের কেরানি। কিন্তু পড়তে ভালোবাসতেন, নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়তে পারতেন দিনের পর দিন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ১৮৮২ সালে তিনি এসেছিলেন ইংল্যান্ডে। মুখজোরে তার গোঁফ, চুলে দুদিকে শিঁথি করা, চোখেমুখে ছিল ভয় ধরানোর মতো রক্তের আভা, অ্যাকশনও ছিল অদ্ভূত।

তবুও অস্ট্রেলিয়া তখন ছিল ঔপনিবেশিক। ইংল্যান্ড দলে ছিলেন ক্রিকেটের আদিবুড়ো ডব্লিউ জি গ্রেস। তিনি মহাশক্তিধর, সবাইকে শায়েস্তা করতে পারেন। খেলাটা লর্ডসে, সেখানে ইংল্যান্ডই শেষ কথা, ঔপনিবেশদের কোনো ঠাঁই নেই। ইংল্যান্ডের হয়তো ভাবনাটা ছিল এমনই। 

প্রথম ইনিংসের পর ভাবনাটা বোধ হয় পোক্ত হয়েছিল তাদের। কেবল ৬৩ রানেই অলআউট করা গিয়েছিল অজিদের। কিন্তু ভেজা উইকেটে শয়তান স্পফোর্থ হয়ে উঠলেন দৈত্য, দানব। ১০১ রানে অলআউট হলো ইংলিশরা। পরের ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া করল ১২২ রান। জিততে ৮৫ রান করতে হবে ইংল্যান্ডের । 

ব্রুকসের লেখা সেই অ্যাবুচেয়রি।

 

যে দলে ডব্লিউ জি গ্রেস খেলেন, তাদের জন্য এ আর এমন কী! গ্রেসও হয়তো ভাবছিলেন, ‘বেটাদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে’। কিন্তু স্পফোর্থ জিতলেন লড়াইটাতে। দুই ইনিংসেই নিলেন সাতটি করে উইকেট। এক পাশে একাই দাঁড়িয়ে থাকলেন গ্রেস। ৭ রানে ম্যাচটা হেরে গিয়েছিল ইংল্যান্ড।

ব্রুকস তো খুঁজছিলেন এমন সুযোগই। দ্য স্পোর্টিং টাইমস-এ লিখে ফেললেন একটা অবিচ্যুয়ারি-

ইংলিশ ক্রিকেটের পূন্যস্মৃতির উদ্দেশ্যে
ওভালে যার মৃত্যু হয়েছে, ২৯ আগস্ট ১৮৮২ সালে
শোকাবহ বেশ কিছু বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের আর্তনাদের মাঝে
আর.আই.পি.
দ্রষ্টব্য- শবটা দাহ করে ভস্মটা (অ্যাশেজ) নিয়ে যাওয়া হবে অস্ট্রেলিয়ায়

অ্যাশেজের যাবতীয় উত্তেজনা ওখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু ইংল্যান্ডের কোনো টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা ছাড়াই অধিনায়ক হওয়া আইভো ব্লাই ঘোষণা দিলেন, অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছেন অ্যাশেজ ফেরত আনতে। কিন্তু সেটা বলা যত সহজ, করা তো আর ততটা না। 

মেলবোর্নে প্রথম ম্যাচে হেরে বসল ইংল্যান্ড। তবে ঘুরে দাঁড়াতে সময় নেয়নি। পরের দুই টেস্ট জিতে তিন টেস্টের সিরিজ জিতে নেয় ইংলিশরা। কিন্তু মেলবোর্নে আরেক টেস্টের আয়োজন করে অস্ট্রেলিয়া। সেখানেই দেখা পেয়ে যান দেশে থেকে আসার সময় চোখে চোখ পড়া ফ্লোরেন্স মার্ফিকে।

যার সঙ্গে পরিচয় পরিণয়েও গড়িয়েছে। তিনি একটা ছাইদানি তুলে দিলেন ব্লাইয়ের হাতে। ১৬ সেন্টিমিটারের সেই শিরোপার নাম হয়ে যায় ‘অ্যাশেজ আর্ন’। এরপর ১৩৫ বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। জার্সির পেছনে নাম ও নম্বর বসেছে, হয়েছে দিবা-রাত্রির টেস্টও। কিন্তু অ্যাশেজ মানে ভিন্ন কিছুই হয়ে থেকেছে ক্রিকেট বিশ্বের কাছে।

এবারের অ্যাশেজ

 

স্পটলাইট

অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাশেজ হলে সবসময়ই ইংল্যান্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন ওপেনাররা। ১৯৭০-৭১- এ জিওফ বয়কট, ১৯৮৬-৮৭তে ক্রিস ব্রড কিংবা ২০১০-১১তে অ্যালিস্টার কুক হয়েছেন উদ্ধারকারী। এই সিরিজে বেন স্টোকস ও জো রুটের দায়িত্ব নিতে হবে অনেক। তবে আলাদা করে নজর রাখতে পারেন ররি বার্নসের দিকে। গেল অ্যাশেজে অ্যাজবাস্টনে সেঞ্চুরি করার পর পেয়েছিলেন আরও দুই হাফ সেঞ্চুরিও।

ব্যাপারটা একই রকম অস্ট্রেলিয়ার জন্যও। কামিন্সের ভাষায় ‘ফাইটার’ ডেভিড ওয়ার্নারের দিকে চোখ থাকবে সবার। যদিও গত ২৩ মাসে কেবল ২ টেস্ট খেলেছেন তিনি। এটি চিন্তা অজিদের জন্য। কিন্তু গত বিশ্বকাপেই ওয়ার্নার প্রমাণ করেছেন, যখন তিনি রান করেন, অস্ট্রেলিয়া ট্রফি জেতে যেকোনো ফরম্যাটেই। অস্ট্রেলিয়া নিজেদের বোলারদের ভালো একটা সংগ্রহ দিতে তাকিয়ে থাকবে স্টিভ স্মিথ ও মার্নাস লাবুশেনের দিকেও।

পিচ ও কন্ডিশন

এক মাস ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে কুইন্সল্যান্ডে। গত সপ্তাহ থেকে সেটি যদিও কিছুটা কম। তবে গ্যাবায় অ্যাশেজের প্রথম টেস্টেও বৃষ্টি ও বৈরি আবহাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। পিচ সবুজ ঘাসে ঢাকা থাকবে। যদিও অজি অধিনায়ক কামিন্সের বিশ্বাস, গ্যাবা থাকবে ‘নরমাল’।

পরিসংখ্যান

*১৯৮৬-৮৭ সালের পর ব্রিসবেনে জেতেনি ইংল্যান্ড। এখানে অবশ্য ৩২ বছরই হারেনি অস্ট্রেলিয়া। তাদের ওই অহংকার অবশ্য চলতি বছরই ভেঙেছে ভারত।

*গত ১১ মাস ধরে ৩৯৯ উইকেটে আটকে আছেন অজি স্পিনার নাথান লায়ান। অ্যাশেজে তার প্রথম উইকেটই শেন ওয়ার্ন ও গ্লেন ম্যাকগ্রার পর মাত্র তৃতীয় অস্ট্রেলিয়ান বোলার হিসেবে ৪০০ উইকেটের মালিক করবে। পুরো বিশ্বে ১৭তম ও সপ্তম স্পিনার হিসেবে এই কীর্তি গড়বেন তিনি।

*অস্ট্রেলিয়ায় কখনো সেঞ্চুরির দেখা পাননি জো রুট। ১৭ টেস্ট ইনিংসে ৩৮.০০ গড়ে রান করে ছয়বার পঞ্চাশের বেশি করলেও ছুঁতে পারেননি তিন অঙ্ক। সর্বোচ্চ ৮৭ রানে আটকে গেছেন তিনি। রুট ১০ ইনিংসের বেশি খেলেছেন, এমন দেশগুলোর মধ্যে কেবল অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেই ৫০ এর বেশি গড় নেই তার।

তারা কী বলছেন

ঘরের মাঠে আমরা যেমন কন্ডিশনে খেলি ওই তুলনায় এটা আলাদা, বিশেষত এই (গ্যাবায়) ভেন্যুতে। এখানে বাড়তি একটা বাউন্স থাকে। কিন্তু আমরা সেরা প্রস্তুতিটাই নিয়েছি। প্রথম ম্যাচের সকালে যেমন আবেগ কাজ করে, আমরা যদি সেটা মানিয়ে নিতে পারি তাহলে ভালো কিছু নিয়েই দেশে ফিরতে পারবো।

জো রুট, অধিনায়ক, ইংল্যান্ড

আমার মনে হয় আপনি যদি ২০১৭-১৮ এর অ্যাশেজে দেখেন। আমাদের ব্যাটসম্যানরা ছিল অবিশ্বাস্য, ৫০০-৬০০ রান করেছে। আমার মনে হয় ওয়াকাতে আমরা ৭০০ এর কাছাকাছি গিয়েছিলাম। এটা নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি। আমাদের ব্যাটসম্যানদের দিকে আলাদা নজর থাকবে এবারও।

প্যাট কামিন্স, অধিনায়ক, অস্ট্রেলিয়া।

এমএইচ