কতদিনে থামবে মাথা নিচু করে থাকা? ছবি : বিসিবি/রতন গোমেজ

ছোটবেলায় পড়া সেই গল্পটার কথা মনে আছে? ওই যে গ্রিক উপকথার জনক ঈশপের উপদেশ মাখা খরগোশ-কচ্ছপের লড়াই? স্মৃতি যাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে তারা চলুন গল্পের মাঝামাঝি থেকে শুরু করি। খরগোশ তো হেসেই খুন, কচ্ছপের সঙ্গে দৌড়- সেটা আবার কোনো ব্যাপার হলো নাকি!

বেজে উঠল দৌড় শুরুর বাঁশি। ‘অহংকারী’ খরগোশ ভাবল, ‘হেলে-দুলে ছোট্ট পায়ে কচ্ছপ আর কতোটুকু এগোবে? রোদের যে তেজ, তার ফাঁকে আমি একটু ঘুমিয়ে নেই। এরপর এক দৌড়ে টপকে যাবো বোকা কচ্ছপকে।’ সেই ভেবে মন জুড়িয়ে যাওয়া বাতাসে একটা সময় গভীর ঘুমের দেশে চলে গেল সেই খরগোশ।

কচ্ছপ জানে তার সীমাবদ্ধতার কথা। তার থামার ভাবনা নেই। চলতে থাকল একটু একটু করে। রোদ, ক্লান্তি কোন কিছুকে পরোয়া করলে কী চলে! এরপর যা হওয়ার তাই হল। ঘুম থেকে জেগে খরগোশ শেষ সীমানায় এসে দেখল- সেখানে আগেই বসে আছে তার সেই হাসির পাত্র ‘পুঁচকে’ কচ্ছপ।

চট্টগ্রাম টেস্ট কি সেই খরগোশ-কচ্ছপের গল্পটাই মনে করিয়ে দিল? অনেকটা তো তাই। ক্রেইগ ব্রাথওয়েটের দল প্রায় সব বিশ্লেষকের চোখেই ‘দ্বিতীয় সারি’র। সেই দলটাই বুঝিয়ে দিল মাঠের ক্রিকেটে ফেভারিট বলে কিছু আসলে নেই। ৩-০ ব্যবধানে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের পর টেস্টে এগিয়ে থেকেই মাঠে নামে বাংলাদেশ দল। তারপর চট্টগ্রাম টেস্টে গোটা চারদিন রাজত্ব করলেও পঞ্চম ও শেষ দিনে এসে সর্বনাশ! একটু একটু করে ম্যাচটা নিজেদের করে নেয় উইন্ডিজ। 

আরেকটু সরাসরি বলা যায় এনক্রুমাহ বোনার ও কাইল মেয়ার্স জয়ের মঞ্চ থেকে এক ধাক্কায় ফেলে দিলেন মুমিনুলদের।

৩৯৫ রানের ‘মিশন ইমপসিবল’ লক্ষ্য ক্যারিবীয়দের সামনে দিয়েছিল বাংলাদেশ। বন্দরে নোঙর করতে জাহাজ প্রস্তুতই ছিল। আগের দিন তিন উইকেট শিকার করে নির্ভার হয়েই রোববার জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে সকালে খেলতে নামে দল। কিন্তু তারপর কি এমন হয়ে গেল যে দল হেরে বসল ৩ উইকেটে? প্রিয় ভেন্যুতে এই হারের কারণই বা কি? চলুন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখি।

এই হারের একগাদা কারণ-

 অনেক বেশি শর্ট বল
 পঞ্চম দিন সকালে ক্যাচ মিস
 সঠিক সময়ে রিভিউ না নেওয়া
 রক্ষণাত্মক ফিল্ডিং
 অকার্যকর, অধারাবাহিক বোলিং
 বৈচিত্রহীন স্পিন আক্রমণ
 সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতি
 পরিকল্পনার অভাব
 রক্ষনাত্মক একাদশ
 মুমিনুল হকের সাদামাটা নেতৃত্ব
 ক্লোজ ফিল্ডারদের নিশ্চুপ ভূমিকা

-বাংলাদেশ কেন হারল, উত্তর খুঁজতে গিয়ে এমন অনেক কারণ যোগ করা যায়। তবে উত্তরটা লুকিয়ে কিন্তু রোববারের সকালে। মাঘের শেষ প্রান্তে মিষ্টি রোদ যখন ছড়িয়েছে তখন জয়ের সুবাস নিতেই মাঠে নামে দল। কিন্তু এরপরের এক ঘন্টাতেই যেন সব শেষ! পঞ্চম ও শেষদিনে দুটি রিভিউ না নেওয়া আর একটি ক্যাচ মিসই যেন ম্যাচ থেকে ছিটকে দেয় টাইগারদের।

নেতাকে নেতৃত্ব বুঝাচ্ছেন সাকিব...?

যে দুজন বাংলাদেশের প্রায় জেতা ম্যাচটা কেড়ে নিয়েছেন সেই অভিষিক্ত বোনার ও মেয়ার্সের জুটি ভাঙার তিনটি সুযোগ এসেছিল বাংলাদেশের সামনে। মেয়ার্স তখন ৪৭ রানে। তাইজুল ইসলামের বলে লেগ বিফোর আউটের আবেদনে সাড়া দেননি আম্পায়ার। রিভিউ নেয়নি বাংলাদেশ। টিভি রিপ্লেতে স্পষ্ট দেখা যায়- বল লাগতো স্টাম্পে। সেই মেয়ার্সই ফের জীবন পান ৪৯ রানে। মেহেদী হাসান মিরাজের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন। কিন্তু নাজমুল হোসেন শান্ত হাতে জমাতে পারলেন না। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মহিরুহ হয়ে উঠেন মেয়ার্স। কে বলবে অভিষেক ম্যাচটা খেললেন তিনি। রূপকথার গল্পের মায়া ছড়িয়ে খেললেন ২১০ রানের অতিমানবীয় এক ইনিংস। 

একইভাবে সকালে প্রথম ঘন্টাতেই ফিরতে পারতেন বোনারও। নাঈম হাসানের টার্ন করা একটি বলে লেগেছিল বোনারের প্যাডে। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে রিভিউ নেয়নি বাংলাদেশ। ২৫ রানে প্রাণ পেয়ে বোনার শেষ অব্দি ফেরেন ২৪৫ বলে ৮৬ রানে!

রোববার দিনভর কি শুধুই খারাপ বল করেছে বাংলাদেশ? না, একদমই নয়। জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে টার্ন মিলছে। বাউন্স ছিল। কিন্তু একটা দুটো ভাল বলের পরই খেই হারিয়েছেন বোলাররা। হতাশার ছিল নাঈম হাসানের বোলিং। প্রতি ওভারেই শর্ট বল করে মেয়ার্স-বোনারকে রান করতে দিয়েছেন তিনি। বৈচিত্রহীন স্পিন বোলিং ডুবাল দলকে। 

আবার দলের পেস আক্রমণের সবধেন নীলমণি মুস্তাফিজুর রহমান। তার ধারহীন বোলিংয়ে কিছুই করতে পারেননি। উইকেটের বিপজ্জনক জায়গায় পা ফেলার জন্য আম্পায়ার সতর্ক করেছিলেন আগের দিনই।

 তারপর থেকেই এলোমেলো দ্য ফিজ! শেষ দিনে মুমিনুল তার হাতে নতুন বল তুলে দিলেও সাফল্য পেলেন কোথায়?

দল সাকিব আল হাসানকেও মিস করল। প্রথম ইনিংসে তার ব্যাট থেকে আসে ৬৮। বল হাতে নিজেকে মেলে ধরার আগেই চোট নিয়ে মাঠ ছাড়েন দলের সেরা ক্রিকেটার। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে পারলেন না। এরপর ঊরুর ইনজুরিতে টেস্টের বাকিটা সময় থাকলেন মাঠের বাইরে। বোলিংয়েও দেখা গেল না তাকে। 

কিন্তু মাঠের বাইরে থেকে ছটফটানিটা ঠিকই থাকলে। বারবারই ড্রেসিংরুম ছেড়ে বেরিয়ে আসলেন। একবার তো দেখা গেল অধিনায়ক মুমিনুল হককেও পরামর্শ দিচ্ছেন সাকিব। কিন্তু সমীকরণ মিলল না। মাঠের সাকিবের অভাবটা কী আর পূরণ হয়! উইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ছিলেন সিরিজ জয়ের নায়ক। টেস্টের প্রথম ম্যাচটিতেই দলের হার দেখলেন মাঠের বাইরে বসে! 

প্রাণ ছিল না আসলে মাঠের এগার জনের মধ্যেও। বিশেষ করে ক্লোজে যারা ফিল্ডিং করলেন তারা বল কুড়াতেই থাকলেন ব্যস্ত। অনেকটা নিশ্চুপ ভূমিকায় ছিলেন তারা। বোলারদের উৎসাহ কিংবা প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের মনোযোগ নষ্ট করার চেষ্টাটুকুও ছিল না। একইভাবে উইকেটকিপার লিটন দাস যে মাঠে আছেন সেটা বুঝতেও তার স্ট্যাম্পিং মিসটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। 

চট্টগ্রাম টেস্টে হারের আরেকটা বড় কারণ হতে পারে সাদামাটা নেতৃত্ব। মুমিনুল হক বরাবরই কম কথার মানুষ। আড়ালে থাকতেই যেন স্বচ্ছন্দ তার। কিন্তু দলকে নেতৃত্ব দিতে হলে যে দিনের পুরো ৯০ ওভারেই সজাগ থাকতে হয়। একইভাবে সেই সনাতনী চিন্তাতেও নিজেকে বন্ধী করে রাখা যায় না। কথায় তো আছেই, ‘অ্যাটাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’। সেটাই করতে পারেননি তিনি। আক্রমণে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়াতে পারেননি প্রতিপক্ষকে। অথচ সিরিজ শুরুর আগে জোর গলায় বলেছিলেন আক্রমণাত্মক ক্যাপ্টেন হতে চান তিনি।

চট্টগ্রাম ট্র্যাজেডির অবশ্য সব দায় যে ক্রিকেটারদের তা কিন্তু নয়। মাঠের বাইরে যারা থাকেন মানে টিম ম্যানেজম্যান্টও কম দায়ী নয়। গোড়ায় গলদের মতো দল গঠনেই তো ছিল নেতিবাচক মানসিকতা। দেশের মাঠে লড়াই, তাই স্পিনে কাবু করতে হবে প্রতিপক্ষকে। 

ভারত সফরের আগে হঠাৎ নেতৃত্ব পেয়ে দেশের মাঠে এবারই প্রথম টেস্ট খেললেন মুমিনুল। ব্যাট হাতে আগের দিন শতরানে রঙিনও করলেন নিজেকে। একটা কথা মনে হয় ভাবতে হবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে- এমন সাদামাটা নেতৃত্বেই কি চলবে টেস্ট দল নাকি চ্যালেঞ্জ নিতে জানেন এমন কাউকে খুঁজবেন তারা? -এই প্রশ্নের উত্তর জানা শুধু বোর্ড কর্তাদেরই।

তবে এটা বলাই যায় ছোটবেলায় পড়া খরগোশ-কচ্ছপের গল্পটা ভুলে গেছেন মুমিনুল-মুশফিকরা!

এটি/এমএইচ