বিয়ে করেছি, বাচ্চাও রয়েছে, এবার খেলব বাংলাদেশের হয়ে
বাংলাদেশে খেলতে-কোচিং করাতে এসে অনেক ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ধর্মান্তরিত হয়েছেন। আবার অনেক ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের অবদান ও সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্র সম্মাননা নাগরিকত্ব দিয়েছে। কিন্তু নিজ উদ্যোগে কোনো বিদেশি ক্রীড়াবিদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করার ঘটনা প্রথম ঘটিয়েছেন এলিটা কিংসলে। নাইজেরিয়ান থেকে বাংলাদেশি হওয়া, তার ফুটবল ক্যারিয়ার, পরিবারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের-এর সঙ্গে।
ঢাকা পোস্ট: অভিনন্দন। আপনার অনেক দিনের চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হলো। এখন বাংলাদেশি হয়েই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ খেলবেন। কিছুদিন পর আপনাকে বসুন্ধরা কিংসের জার্সি গায়ে দেখা যাবে। আপনার মূল পজিশন স্ট্রাইকার। কিংসে তো আপনার প্রিয় পজিশন পাওয়া কঠিন।
বিজ্ঞাপন
এলিটা: আমি অনুশীলনে আমরা সেরাটা দেব। কোচ দলের কম্বিনেশনের জন্য আমাকে যেখানে খেলাবেন সেখানেই খেলার জন্য প্রস্তুত। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
ঢাকা পোস্ট: আপনি মূল ধারার ফুটবল থেকে কিছুটা দূরে। আপনার নতুন দল কিংসের ফুটবলাররা ফিটনেসে এগিয়ে। পাশাপাশি তাদের খেলার একটা ধরণও দাঁড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয় লেগ শুরু হওয়ার আগে এর সাথে মানিয়ে নিতে পারবেন তো?
বিজ্ঞাপন
এলিটা: আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুশীলন চালিয়ে গিয়েছি। ব্যক্তিগত অনুশীলন ও দলীয় অনুশীলনে অনেক তফাৎ। কিংসের অনুশীলন, ম্যাচ সম্পর্কে আমি যথেষ্ট পরিমাণে ওয়াকিবহাল। তারা যথেষ্ট গতিশীল ও আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে। আমার মানিয়ে নিতে বেশি সময় লাগবে না।
ঢাকা পোস্ট: মুক্তিযোদ্ধা, আরামবাগ, টিম বিজেএমসি এই তিন দলেই আপনি মূলত ফরোয়ার্ড লাইনের নেতা ছিলেন। গোলের পর গোল করেছেন। কিংসে অবশ্য আপনার ওপর পুরোপুরি নির্ভর হবে না। এটা আপনার জন্য ইতিবাচক না নেতিবাচক।
এলিটা: বাংলাদেশের মানুষ এলিটাকে চেনে গোলের জন্য। আমি কিংসের হয়ে দ্বিতীয় লেগে অন্তত কয়েকটি ম্যাচ খেলতে পারলে গোল করব আপনাকে বলে রাখলাম। দ্বিতীয় লেগে আমি ১০ গোল করব এটা লিখে রাখতে পারেন।
ঢাকা পোস্ট : আপনার নাগরিকত্বের খবর শোনার পর বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ জেমি ডে বলেছেন, ‘লিগে পারফরম্যান্স করলে আপনাকে বিবেচনা করবে।’ কোচের মন্তব্যকে কীভাবে দেখছেন?
এলিটা: কোচ অত্যন্ত যৌক্তিক ও পেশাদার মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া কলকাতায় খেলছে। সে কলকাতায় নিয়মিত না খেললে দলে ডাকলে প্রশ্ন উঠতো। তেমনি বাংলাদেশ লিগেও অনিয়মিত কাউকে ডাকলে প্রশ্ন উঠতো। সে এবার প্রতিটি ম্যাচ দেখেছে। তার দল নির্বাচন দুর্দান্ত হয়েছে। আমি দ্বিতীয় লেগে ভালো করতে পারলে আমাকে ডাকতে পারে।
ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশের ফুটবলে আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোলসংখ্যা খুব কম। ফরোয়ার্ডরা গোল মিস করেন। ফুটবলপ্রেমীদের প্রত্যাশা আপনি সেই অভাবটি পূরণ করতে পারেন।
এলিটা: বাংলাদেশেও মেধাবী ফরোয়ার্ড রয়েছে। যেকোনো ফুটবলার গোল করতে চায়। কেউ ইচ্ছে করে মিস করে না। জীবন,জুয়েল সবাই গোলের জন্য মরিয়া। আমি তাদের থেকে অভিজ্ঞতা ও শক্তি এই দুই জায়গায় এগিয়ে থাকব। এই দুটি দিয়ে আমি চেষ্টা করে যাব। তবে আবার আমার একটি বাড়তি চাপ ও নেতিবাচক দিকও থাকবে।
ঢাকা পোস্ট: সেটি কোনটি?
এলিটা: বাংলাদেশের মানুষের আমার ওপর প্রত্যাশা ও চাপটা বেশি থাকবে। পুরো ম্যাচে হয়তো আমি দুটি বা একটি গোলের সুযোগ পেতে পারি। কোনো কারণে গোল না হলে আমার ওপর চাপ বাড়বে। আবার দেখা গেল তিনটির মধ্যে আমি একটি গোল করলাম দুটি পারলাম না তখনও আবার সমালোচনা হতে পারে। তবে সেই চাপ ও সমালোচনা আমি নেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখি।
ঢাকা পোস্ট: আপনি এক মৌসুমে টিম বিজেএমসির হয়ে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন। অন্য মৌসুমেও ধারাবাহিক স্কোরার ছিলেন। এরপরও আপনি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে বড় দলগুলোতে খেলতে পারেননি।
এলিটা: খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। আমি বড় দলগুলোতে খেললে আরও বেশি গোল করতে পারতাম। সেটার প্রমাণ কিন্তু আমি চট্টগ্রাম আবাহনীর হয়ে দেখিয়েছি। শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপে ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছি। আমি লোনে চট্টগ্রাম আবাহনীর হয়ে খেলতে গিয়েছিলাম। চট্টগ্রামের সবাই আমার ভক্ত বনে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম আবাহনী আমাকে রাখেনি। তারা আমাকে জানিয়েছিল, ‘আমার চেয়ে ভালো মানের এক বিদেশি আনছে তারা।’ আবাহনী, শেখ রাসেল, জামালের মতো বড় দলগুলো কখনো আমাকে প্রস্তাব দেয়নি। আমি বড় দলগুলোর বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে গোল করেছিলাম। তারা নতুন বিদেশি আনা ও তাদের ক্লাবে খেলা বিদেশিদের বাইরে যেত না।
ঢাকা পোস্ট: আপনি এখন ৩১ পার করছেন। খুব অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে হয়তো জুনেই আপনার বাংলাদেশ দলের হয়ে অভিষেক হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ দলের জার্সি কয় বছর গায়ে জড়িয়ে রাখতে পারবেন ?
এলিটা: ত্রিশের পর ফুটবলাররা খেলে অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিদীপ্ততা দিয়ে। ফরোয়ার্ড বা স্ট্রাইকরাদের সূক্ষতা বয়স বাড়ার সঙ্গে আরও বাড়ে। আমি বাংলাদেশ দলে আরো পাঁচ বছর খেলতে চাই।
ঢাকা পোস্ট:বাংলাদেশের ফুটবলারের আন্তর্জাতিক ম্যাচে হ্যাটট্রিক, দেশের হয়ে করা গোলের সংখ্যা খুব বেশি না। আপনি পাঁচ বছর খেললে অনেক রেকর্ড আপনার হয়ে যেতে পারে।
এলিটা: সেটি হয়তো সময় বলবে। তবে আমি কিছুদিনের মধ্যে শোনার অপেক্ষায় রয়েছি যে জামাল বলবে, ‘এলিটা দারুণ খেলেছে, ম্যাচ জয়ে তার ভূমিকা রয়েছে’ কোচ বলবে,‘ এলিটা আমার অন্যতম স্তম্ভ।’
ঢাকা পোস্ট: বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য আপনাকে নাইজেরিয়ার নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হয়েছে। বিষয়টি কতটুকু কঠিন ছিল।
এলিটা: আমি একজন ফুটবলার। আমি দেশের হয়ে ফুটবল খেলতে চাই। আমার নিজ দেশ নাইজেরিয়ার হয়ে সেটা সম্ভব না। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে খেলছি। এখানকার সংস্কৃতি, পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়েছি। বিয়ে করেছি, বাচ্চাও রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করব এজন্য আমার নাইজেরিয়ান নাগরিকত্ব বাদ দিতে বেশিক্ষণ ভাবতে হয়নি।
ঢাকা পোস্ট: কিন্তু নাইজেরিয়ায় আপনার জন্ম, মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব এদের বিষয়টি মাথায় আসেনি?
এলিটা: অবশ্যই এসেছে। আমি তো তাদের থেকে ছিন্ন হয়ে যাইনি। আমার মাকে বাংলাদেশে আসতে বলেছি। আমিও সময় পেলে যাব। এখন আমাকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে নাইজেরিয়ার ভিসা নিয়ে যেতে হবে।
ঢাকা পোস্ট: ভিসা নিয়ে গিয়ে তো বেশি দিন থাকতে পারবেন না। আর বললেন পাঁচ বছরের মতো ফুটবল খেলতে চান। ফুটবল ছাড়ার পরও তো জীবন থাকবে অনেক দিনের। সেই বিষয়টি কি ভেবেছেন?
এলিটা: হ্যাঁ ভেবেছি। ফুটবলার হিসেবে অবসর নেওয়ার পর বাংলাদেশেই থাকতে চাই। বাংলাদেশের ফুটবল উন্নয়নে কাজ করে যেতে চাই।
ঢাকা পোস্ট: বাংলাদেশের ফুটবলাররা ক্যারিয়ার শেষ করার পর বিভিন্ন ক্লাব, ফেডারেশনে জড়িত হয়। ক্লাব, ফেডারেশন সর্বত্রই একটা কোরাম, পক্ষ-বিপক্ষ গ্রুপ আছে। সেগুলো পাশ কাটিয়ে বা এগুলোর সঙ্গে মিশে কাজ করতে পারবেন অবসরের পর?
এলিটা: আগামী পাঁচ বছর ফুটবলটা খেলতে চাই মনোযোগ দিয়ে। এরপর এই বিষয় গভীরভাবে ভাবব। সরাসরি ক্লাব, ফেডারেশনে জড়িত না হয়েও ব্যক্তিগতভাবে ফুটবল বা ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়ন করা যায়। আমি সেই পথেও হাঁটতে পারি।
ঢাকা পোস্ট: বাংলাদেশে এসে অনেক ক্রীড়াবিদ-কোচ ধর্মান্তরিত হয়েছেন। আপনি জাতীয়তা পরিবর্তন করেছেন। মুসলিম স্ত্রী বিয়ে করলেও নিজ ধর্ম পালন করে যাচ্ছেন।
এলিটা: ফুটবলের লক্ষ্য পূরণের জন্য জাতীয়তা পরিবর্তন করতে হলো। ধর্ম যারটা তার কাছে। আমার স্ত্রী তার ধর্ম পালন করছে, আমি আমারটা। আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমিও এক ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ইসলামও এক সৃষ্টিকর্তার কথাই বলে। ফলে ধর্ম নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা নেই।
ঢাকা পোস্ট: আপনার একজন মেয়ে হয়েছে বাংলাদেশেই। সে কীভাবে বেড়ে উঠবে?
এলিটা: এটা সম্পূর্ণ তার ইচ্ছে ও স্বাধীনতা। সে আমার সাথে চার্চেও যেতে পারে। মায়ের সঙ্গে মসজিদেও। আমার কোনো বাধা বা পরামর্শ নেই। তার যেটা পছন্দ ও ভালো লাগে সেটাই করবে।
এমএইচ/এটি