উৎপল শুভ্র

ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আছেন তিন দশক। ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ থেকে দেশে। তুলে এনেছেন খবর, শুনিয়েছেন গল্প। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সময়ের বদলে নতুন তারকাদের। ক্রিকেট-ফুটবল বিশ্বকাপ, অলিম্পিক, কাভার করেছেন সব। সময় পাল্টেছে, পাল্টায়নি পাঠকের কাছে উৎপল শুভ্রর গল্প পড়ার মোহ। সেই উৎপল শুভ্র আসছেন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে, ‘উৎপল শুভ্র ডট কম’। 

নিজের নামে করা সেই ওয়েবসাইট, ক্যারিয়ার, ক্রীড়া সাংবাদিকতা, ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ ও প্রথম আলোর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ, সেসব প্রসঙ্গে তিনি কথা বললেন ঢাকা পোস্ট-এর ক্রীড়া সম্পাদক আপন তারিক-এর সঙ্গে-

প্রশ্ন : উৎপল শুভ্র ডট কম। অনেকটা প্রথা ভেঙে নিজের নামে একটা ওয়েবসাইট চালু করলেন। আপনি নিজ নামে পরিচিত। এখন নামের শেষ ডট কম লাগানোর পর এটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারাটা কতটা চ্যালেঞ্জের...

উৎপল শুভ্র : নরমালি ওয়েবসাইটের ঠিকানা থাকে ডট কম,  নামের মধ্যে থাকে না। একটা হচ্ছে উৎপল শুভ্র ব্যক্তি হিসেবে নামে করছে, সেটা একটা। কিন্তু এটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেই ডট কম রাখা। ব্যক্তির নাম রাখতে একটু দ্বিধাও কাজ করেছে। অনেক ওয়েবসাইট হয়েছে স্পোর্টসের। যে কারণে অন্যরা আমাকে বলেছে এত বছর সাংবাদিকতা করে কেন আপনি সময় নেবেন- এটা জানাতে যে এটা আপনার। তার চেয়ে আপনার নামে শুরু করেন। আপনার নামটাতে এখন পর্যন্ত কালিমা নেই, তাদের কথায়। যেহেতু ভালো কথা, তাই তাদেরটা বিশ্বাস করে শুরু করেছি। চ্যালেঞ্জ তো বটেই। যদিও মিডিয়া ব্যক্তিপর্যায়ে চলে গেছে। এটার ধরনটাও আলাদা। এটা নিউজ সাইট হবে না। আমার এত বছরের লেখা এখানে থাকবে। আমি এটাতে নতুন লেখাও লিখব।

প্রশ্ন : শুধু আপনিই লিখবেন এখানে, নাকি অন্যরাও...

উৎপল শুভ্র : আমি এটাকে ধীরে ধীরে সবার প্ল্যাটফর্ম করতে চাই। বাংলা ভাষায় যে দুই দেশের ভালো লেখক আছে, তাদের লেখা থাকবে। সাবেক খেলোয়াড়দের কলাম থাকবে। লেখা, ভিন্নমত, চিঠিপত্র ও প্রশ্ন, এসব নামে থাকবে। যারা অন্য পেশায়, তারাও লিখতে পারবে। এক ধরনের আর্কাইভাল জায়গায় যেতে পারি। যাতে ২০০৪ সালে বোল্ট অলিম্পিক জেতার পর কী বলেছে আমরা হয়তো এখনো পাব। কিন্তু বাংলায় পাওয়া কঠিন। বাংলায় আমি ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডের আর্কাইভাল জায়গা বানাতে চাই। কারো যদি পুরনো লেখা জানতে ইচ্ছে করে, তারা জানতে পারবে। আমার ট্যুরের যে গল্প আছে, সেগুলো থাকবে। আমি যখন সাংবাদিকতা করেছি, ওই সময় নতুন কিছু করতে চেয়েছি স্পোর্টসে। 

আমি যেখানেই কাজ করেছি, ভোরের কাগজ, প্রথম আলো সব জায়গাতেই সমাজের বড় একটা পরিবর্তনের অংশ ছিলাম। এখানেও সেটা করতে চাই। খেলা আপনাকে অনেক কিছু শেখায়। নেতৃত্ব, হারতে, জিততে শেখায়। আমার কাছে মনে হয় খেলা যখন আলোচনা হয়, আমরা সাকসেস হতে চাইব, যেকোনো খেলায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাইতে চাইব। কিন্তু এটাই একমাত্র উদ্দেশ্য হবে না। আমরা মুখে মুখে বলি স্পোর্টিং নেশন, কিন্তু আসলে তা না। আমার ইচ্ছা আছে, করোনা শেষ হওয়ার পর এমন একটা কিছু করতে চাই, যেটা সারাদেশে একটা পরিবর্তন আনবে। স্কুলগুলোতে যাব। কেন খেলার টিচার বাংলা ক্লাস নেবে? এই কালচারটা বদলানোর চেষ্টা করতে হবে।

প্রশ্ন : তাহলে এবার সামনে দেখতে পাবো আপনাকে?

উৎপল শুভ্র : আমি সবসময় চেহারা দেখাতে চাইনি। টিভি এড়িয়ে চলেছি। মাঝখানে কিছুদিন গেছি। সময়টা তো আমি বদলাতে পারব না, নিজেকেই হয়তো বদলাতে হবে। এখানে ইউটিউব থাকবে, আমার বিশ্লেষণ থাকবে। এখন সব বলতে চাই না। 

প্রশ্ন : ক্রিকেট ও ক্রীড়া সাংবাদিকতার বেশ কিছু ধাপ দেখেছেন আপনি। ড্রেসিংরুমে বসেও ক্রিকেটারদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। টিম হোটেলে প্লেয়ারদের পাশাপাশি থেকেছেন। এখন এমন অনেক কিছুই সম্ভব নয়। নতুনদের জন্য ক্রীড়া সাংবাদিকতা কি কঠিন হয়ে গেল? তারা তো ভাবনার জন্য যথেষ্ট সময়ও পায় না...

উৎপল শুভ্র : কঠিন তো এক অর্থে কাছে যাওয়া, ইন্টারভিউ করাটা কঠিন হয়ে গেছে। কিন্তু সাংবাদিকতাটা কঠিন হয়নি। আপনি যেটা বললেন ড্রেসিং রুমে ইন্টারভিউ করেছি, হোটেলে গেছি। প্লেয়ারদের কাছে এক্সেসটা খুব বেশি ছিল। তার মানে শুধু প্লেয়ারদের কথা শোনার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের সাংবাদিকতা ক্রমশ কোট নির্ভর সাংবাদিকতা হয়ে যাচ্ছে। অমুকে বলেন, তমুকে বলেন, তিনি বলেন। খেলা নেই। স্পোর্টস জার্নালিস্ট যিনি খেলার অ্যানালাইসিস করবেন। আমার তো মাঝেমধ্যে মনে হয় কেউ যদি কথা না বলত তাহলে ক্রীড়া সাংবাদিকরা বাধ্য হয়েই ক্রীড়া সাংবাদিকতায় ফিরতাম। এটা হয়তো আমরা শুরু করেছি। একজন প্লেয়ার সেঞ্চুরি করলে ভালো করলে খেলোয়াড় ভালো করলে, দল জিতলে যেকোনো খেলাতেই তার কথা তো মানুষ শুনতে চাইবেই, তার ইন্টারভিউ শুনতে চাইবে।  

প্লেয়ারদের সঙ্গে কথা না বললে আমি লিখতেই পারব না, তাহলে আর কী হবে। আমার নিজের তো লেখার ক্ষমতা থাকতে হবে যে ঘটনাটা কেমন, বর্ণনা করতে হবে। সেদিক থেকে বলব এটা দুইরকমভাবেই দেখা যায়। একদিকে বলব, সহজও হয়েছে। আমার জীবনের শুরুর কথা বলব, শুরুর অনেক দিন পরও একটা বাড়তি ইনফরমেশনের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হয়েছে। মোটা মোটা খাতা নিয়ে ঘুরতে হয়েছে। যখন বিদেশ থেকে আসতাম, আমার বাম কাঁধে কালশিটে পড়ে যেত। কারণ আমার ব্যাগ ভর্তি আট-দশ কেজি শুধুমাত্র রেফারেন্সই থাকত। কারণ তখন তো ল্যাপটপ নেই, ইন্টারনেটের নামও শোনেনি কেউ। এমনও ছিল, এটা সাধারণ একটা জিনিস, ওটা খাতার মধ্যে দেখে প্রতিটা ম্যাচের স্ট্যাটস, পঞ্চাশ বছরের, চল্লিশ বছরের, বিশ বছরের, দশ বছরের সবগুলোর স্কোরকার্ড আমি বহন করে নিয়ে যেতাম। এখন তো আপনি একটা ক্লিক করলে পৃথিবীর সবকিছু চলে আসছে। সেদিকে আমি বলব সহজ হয়ে গেছে। 

প্রশ্ন : এখন তো প্রতিযোগিতা, তাড়াহুড়োও বেড়ে গেছে...

উৎপল শুভ্র : আপনি যেটা কঠিন বললেন, হ্যাঁ হয়তো মিডিয়া বেশি বেড়েছে। কম্পিটিশন বেড়েছে। সেটাতো আগেও ছিল। আমি তো মনে করি এটা একটা সুযোগও। যেকোনো ক্রাইসিসই একটা সুযোগ। যে প্রবলেমটার কথা বললেন, সেটা হ্যাঁ শুধুমাত্র প্লেয়ারদের কাছে যাওয়া ছাড়া অন্য সব সুযোগ-সুবিধা লেখা পাঠানোর আগে সেটা পাবেন কি না।  একটু দূরে গেলে অফিসে না ফিরে লেখাটা পাঠাতে পারতেন না। যেমন ধরেন সাভারের বিকেএসপিতে খেলা, আপনাকে ফিরে লিখতে হতো। এখন তো সেটা লাগছে না। কাজেই আমি মনে করি একেক সময়ের চ্যালেঞ্জ একেকটা। সেটা উত্তরণের একটাই পথ আসলে। এখন যেটা হয়েছে, মিডিয়া যেহেতু বেড়েছে, সাংবাদিকও বেড়েছে। অনেকে খুব ভালো করছেন, অনেকে আবার দেখছি সাংবাদিক হওয়াটা খুব সহজ হয়ে গেছে। 

প্রশ্ন : উৎপল শুভ্রর উৎপল শুভ্র হয়ে ওঠার পেছনে কী পরিবেশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল? পরিবেশ বলতে অফিসের সাপোর্ট, তাড়াহুড়ো না থাকা, শুভ্র দা কি মনে করেন এখনকার এই অনলাইনের এত প্রতিযোগিতার যুগে তিনি উৎপল শুভ্র হয়ে উঠতে পারতেন?

উৎপল শুভ্র : এটা কঠিন প্রশ্ন। উৎপল শুভ্র হতে পারতাম কি না এই প্রশ্নের আগে প্রশ্নটা হচ্ছে উৎপল শুভ্র কী হয়েছে এমন? আমি সাংবাদিকতাটাই করেছি। যেটা আমার প্যাশন ছিল। ক্রীড়া সাংবাদিকই হব, এমন কোনো ইচ্ছা ছিল না, ঘটনাচক্রেই হয়ে গেছে। সেটাও তো ২৮ বছর হয়ে গেছে। এটা শুরু করার পর এটা আমার ধ্যানজ্ঞান, এখানে আমার বড় কিছু করতে হবে, এমন লক্ষ্য আমার ছিল না। আমার এটা মজা লেগেছে। নিজেরও কিছু নেশা ছিল পড়াশোনা করার। একাডেমিকের বাইরে গল্প-উপন্যাস পড়ার। আমার পড়তে খুব ভালো লাগে। যে কারণে এটা সম্ভবত অটোমেটিক্যালিই আমাকে হেল্প করেছে। যে কারণে এখনকার পরিবেশে হতে পারতাম কি পারতাম না, এটা খুব ডিফিকাল্ট প্রশ্ন। তবে আমার কথা হলো, আমার সময়ে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল, কম্পিটিশন ছিল। এখন হয়তো আরেক ধরনের আছে। যে কারণে সময়ের সঙ্গে সবকিছু বদলে গেছে। যে কারণে আমি যদি বলতাম পারতাম, তাহলে সেটা ঔদ্ধত্য শোনাত, আর পারতাম না এটা বললেও ভন্ডামি করা হবে। এই শব্দটাই আমি উচ্চারণ করতে চাই না। এটা প্লেয়ারদের ক্ষেত্রে বলা হয়, কেউ যদি একসময় গ্রেট হয়, অন্য সময়ও হতে পারে। আমি কিন্তু আবার নিজেকে গ্রেট বলছি না। হ্যাঁ সময়টা একটু অন্যরকম। এটা আমার খুব পছন্দও না। কারণ আমি একটা অরিয়েন্টেশনে বেড়ে উঠেছি। কিন্তু কিছু করার তো নেই।  

জাতীয় দলের তিন তারকা সাকিব আল হাসান, নাসির হোসেন ও রুবেল হোসেনের সঙ্গে উৎপল শুভ্র।

প্রশ্ন : ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে কাদের লেখা আপনাকে বেশি অনুপ্রাণিত করত?

উৎপল শুভ্র : সেটা অনেক নাম, বলতে গেলে হয় কী, রিস্ক থাকে। একটা বলা কঠিন আসলে। ছোটবেলায় যা পেতাম, তাই পড়তাম। গল্প-উপন্যাস। ক্লাস ফাইভে থাকতে মা'র কারণে প্রথম উপন্যাস পড়ি। খেলার লেখাও পড়তাম। তখন ম্যাগাজিন ছিল। শুরুতে নাম খেয়াল করতাম না। পরে বড় হওয়ার পর রণজিৎ বিশ্বাসের লেখা খুব ভালো লাগত। মনে আছে পূর্ণিমাতে তার সঙ্গে যখন লেখা প্রকাশ হয়, আমি আমার ব্ন্ধুদের খাইয়েছিলাম। ওই সময় তার খুব বড় কন্ট্রিবিউশন। আরেকজন আছেন সানাউল হক খান। তিনি অনেক ধরনের লেখা লিখেছেন। জালাল (আহমেদ চৌধুরী) ভাইয়ের লেখার আমি খুব ভক্ত। অজয় (অজয় বড়ুয়া) দার এক দুই লাইন এখনো মনে আছে। আমার সঙ্গে যারা কাজ করেছে, ৭০ জনের মধ্যে অনেকের লেখা পছন্দ হয়েছে। আমি তাৎক্ষণিকভাবে বলছি, হয়তো অনেকের নাম বাদ পড়তে পারে। দুইটা হয় একজনের হয়তো সব লেখা ভালো লেগেছে, কারো একটা দুইটা। ইন্টারন্যাশনালি বাংলায় গৌতম ভট্টাচার্যের লেখা পছন্দের। আমরা যখন একসঙ্গে হই, ক্রীড়া সাংবাদিকতা নিয়ে আলোচনা করি। 

প্রশ্ন : প্রথম আলোর সঙ্গে আপনার প্রাণের সম্পর্ক। পত্রিকাটির জন্ম যন্ত্রণার সঙ্গী আপনি। এরপর এই প্রতিষ্ঠানকে শীর্ষে নিয়ে যেতেও রেখেছেন বড় ভূমিকা। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানটি দুই দশক পর এসে ছাড়লেন। 

উৎপল শুভ্র : ছেড়ে চলে যেতে হবে বললে মনে হয় ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। ব্যাপারটা এমন না। আমি আসলে নিজেই ছেড়েছি, এবং সেটা খুব বেশি প্ল্যান করেও না। আমি সাংবাদিকতায় যেমন প্ল্যান করে আসিনি। আমার আসলে লজিকের চেয়ে আবেগ বেশি কাজ করে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এটার আসলে নির্দিষ্ট কারণ বলা মুশকিল। আমি মজা করে বলি আমি প্রথম আলোর চাকরি ছেড়েছি, প্রথম আলো ছাড়িনি। আমার বন্ধু-বান্ধব ওখানে। আমি যদি বলি, যতটুকুই যা হয়েছি, সেটার পেছনে মতিউর রহমানের অনেক বড় অবদান আছে। আমিও যেটা বলি, প্রথম আলো না থাকলে হয়তো আমি উৎপল শুভ্র হতাম না। আবার একইভাবে আপনি যেটা বললেন প্রথম আলোও হয়তো আমার লেখা হেল্প করতেও পারে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে মতিউর রহমানের কাছে যা ঋণ আছে, সেটা শোধ করার কথা কল্পনাও করতে পারি না। এজন্য এটা বলা ঠিক না যে প্রথম আলোর সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক। এটা থেকে বের হয়ে এসে আমি নতুন চ্যালেঞ্জ নিচ্ছি। আমি আসলে চাকরি করার আগের দিনও জানতাম না পরের দিন চাকরি ছেড়ে দেব। এটা অবিশ্বাস্য শোনাবে। আমাদের প্রচলিত অর্থে ভালো আর নিরাপদ চাকরি। এটা বললাম না পুরোটাই ঝোঁকের মাথায়। ছাড়ার কিছুদিন পর আমার খুবই মন খারাপ হয়েছে। জীবনের একটা অংশ এটা, প্রায় ২০-২১ বছর কেটেছে। কারণ বন্ধু-বান্ধব এখানে। ছাড়ার পরও প্রথম আলোতে এক-দুই বছরে পঞ্চাশটা লেখা লিখেছি। হয়তো কোনো বাঁকে গিয়ে মিলতে পারি। আমার দিক থেকে কোনো তিক্ততা নেই। 

প্রশ্ন : তিন দশকের বেশি ক্যারিয়ার আপনার। আপনি আপনার নিজের ক্যারিয়ারটা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন। নিজেকে কত স্কোর দেবেন? 

উৎপল শুভ্র : এটা বলা খুবই ডিফিকাল্ট। তবে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার আগে লাস্ট দুই-তিন বছর আমি খুব একটা এনজয় করিনি। চাকরি ছাড়ার পেছনে সম্ভবত এটাও একটা কারণ ছিল। এর আগে আমি প্রতিটা দিন খুব এনজয় করেছি। প্রথম আলোর যে অবস্থান, সুনাম, সেখানে নিশ্চিন্তে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু আমি জানি এখানে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে হারতেও পারি। অবশ্য জেতার আশা না থাকলে তো আর মাঠে নামিনি। কিন্তু হারার আশঙ্কাও আছে। আমি ক্যারিয়ার নিয়ে মূল্যায়নটা কখনো করিনি। আমি যদি পেছন ফিরে তাকাই, তখন মনে হয় আমি আরও অনেক কিছু করতে পারতাম। এটা আমার খুব আফসোস হয়। ক্যারিয়ার যখন শুরু করেছিলাম, তখন টিটো ভাই (ফরহাদ টিটো) সিনিয়র ছিলেন, তবে আমরা সম পদমর্যাদায় শুরু করেছিলাম আজকের কাগজে। এর এক-দেড় বছরের মাথায় আমি ক্রীড়া সম্পাদক। তারপর স্পোর্টসের সীমানা ছাড়িয়ে প্রথম আলোতে আমার ভূমিকা ছিল। নিজের কাজের বাইরে তখন অনেক কাজে জড়িত থাকতে হয়েছে। যে কারণে আমার মনে হয়, আমি যদি শুধুই ক্রীড়া সাংবাদিকতা করতাম, তাহলে হয়তো আরও ভালো হতো। অনেক সময় এমন হয়েছে, অন্য সবকিছু সামলে, পাতা রেডি করে আমাকে লিখতে হয়েছে। 

প্রশ্ন : কিন্তু ট্যুরে তো আমরা অন্য এক উৎপল শুভ্রকে পেতাম। দারুণ সব লেখার সমাহার...

উৎপল শুভ্র : আমি ট্যুর কারাটা বেশ এনজয় করতাম। কারণ সেই সময় আমার নিজের লেখা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা থাকত না। যে কারণে দেখবেন আমার ইন্টারভিউ বেশিরভাগই ট্যুরে গিয়ে করা। দেশে কিছু বড় ইন্টারভিউ আছে। বিদেশে যখন খেলা নেই, তখন তো টিমের সঙ্গে আছেন। তখন কাজ করার সুযোগটাও বেশি থাকে।

প্রশ্ন : প্রথম আলো ছাড়ার পর অনেক অপশন ছিল আপনার সামনে। পত্রিকা, টেলিভিশন কোনোটাতেই না গিয়ে বেছে নিলেন ওয়েবসাইট। আপনি যেখানে কাজ করে এসেছেন, সেই ছাপা পত্রিকার এখন অনেক দুঃসময়। সার্কুলেশন কমছে প্রতিদিনই। পাঠক ছাপা পত্রিকা আগের মতো হাতে নিতে চাইছে না। ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ কি দেখছেন?

উৎপল শুভ্র : খুবই কঠিন সময়। মিডিয়া ল্যান্ডস্কেপ এত দ্রুত বদলাচ্ছে যে বলা কঠিন। তবে আমার মনে হয় ছাপা পত্রিকা অবশ্যই থাকবে হয়তো। হয়তো বলছি। তবে এটাও বলব, চ্যালেঞ্জ সব সময় অপরচ্যুনিটি। সুযোগটা কাজে লাগানোর মতো মেধা, চিন্তা, এই জায়গাটায় বড় চ্যালেঞ্জ। খেলাতে যেমন নতুন ধারার কথা বলা হয়। এখন অনলাইনে টিভিতে সব জেনে যাওয়ার পর আপনাকে নতুনভাবেই সব ছাপা পত্রিকায় উপস্থাপন করতে হবে। এমন কিছু দিতে হবে, যা মানুষ জানে না। এটা বলা সহজ, কিন্তু করা অনেক কঠিন। মানুষের পাঠাভ্যাসটা কমে যাচ্ছে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। নতুন প্রজন্ম, যারা নতুন তারা এটার স্বাদই পায়নি, তারা এটা মিস করে। সবকিছু মিলিয়ে কঠিন একটা সময়। তবে আগের মতো রমরমা থাকবে না, এটা জানা কথাই। 

প্রশ্ন : অনেকেই জানতে চায় আসলে উৎপল শুভ্র ডট কমের পেছনে উৎপল শুভ্র ছাড়া আর কে আছেন? মানে আপনার এই ওয়েবসাইটে কারা বিনিয়োগ করছে?

উৎপল শুভ্র : না, কোনো ফিন্যান্সার নেই। এটা আমার প্রতিষ্ঠান। আমাকে সহযোগিতা করার জন্য আমার পরিচিত কিছু বন্ধু রয়েছেন। বিনিয়োগকারী যদি বলেন, সেটা কেউ নেই। এখানে সিটি ব্যাংক আমার সঙ্গে আছে। তবে তারা বিনিয়োগ করছে না। বিজ্ঞাপনদাতা হিসেবে রয়েছে। এত বছর সাংবাদিকতায় আছি বলেই হয়তো আরও কিছু বিজ্ঞাপনদাতার সঙ্গে কথা হয়েছে। শুরু থেকেই তারা থাকছে। 

শেষ প্রশ্ন, ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আসা নাকি এখনকার উৎপল শুভ্র ডট কম—কোনটা আপনার কাছে সবচেয়ে কঠিন মনে হয়?

উৎপল শুভ্র : কোনোটাই কঠিন মনে হয়নি। ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আসাটা তো আমার কাছে কঠিন মনেই হয়নি। সারা জীবন মন যা বলেছে তাই করেছি। আমি সাংবাদিকতায় আসব, এটা খুব সচেতনভাবে বসে নিয়েছি তা কিন্তু না। ভালো লেগেছে, তাই করে গেছি। তবে হ্যাঁ, বাসায় সমস্যা হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারে যা হয়। ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর সাংবাদিক হবে, সেটা আবার ক্রীড়া সাংবাদিক। তাও আবার ১৯৮৯ সালের কথা। বাবা-মার খুবই মন খারাপ ছিল। তবে আমার নিজের জায়গা থেকে সিদ্ধান্তটা কোনোভাবেই কঠিন ছিল না। এটাও একই রকম। এখানে নামে করার একটা সুবিধা আছে, অনেকেই এটাতে ঢুকবেন। দেখতে চাইবেন যে এখানে কী হচ্ছে। আবার একইসঙ্গে এটা চাপও। যদি নর্মাল একটা ওয়েবসাইট করি। প্রত্যাশার একটা চাপ তো আছেই। এটা যখন ভাবি তখন মনে হয় হ্যাঁ এখানে নতুন করে পাওয়ার কিছু নেই, হারানোর আছে। তবে সেই চিন্তা আমি মন থেকে সঙ্গে সঙ্গে দূর করে দেই। চ্যালেঞ্জ না থাকলে সেটা আসলে কোনো কাজ না। প্রথম আলোতে আমার নিশ্চিন্ত একটা জীবন ছিল। কিন্তু ভেতরে সব সময় একটা ভিন্ন চিন্তা তাড়িয়ে বেড়াত। ছকের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে সবসময়ই থাকত।

এটি/এমএমজে/এমএইচ