রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনায় ও রচনায় শিশুচরিত্র

জমিদারের সন্তান এবং বিশাল পরিবারের সদস্য হলেও অনেকটাই নিঃসঙ্গ কেটেছে রবীন্দ্রনাথের শিশুকাল। এই নৈঃসঙ্গ্য তাকে কাবু করেনি বরং প্রকৃতির রূপ উপভোগ ও কল্পনাবিলাস তাকে করে তুলেছে ভাবুক ও কবি।
স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, ‘গাড়ি যখন সবুজ প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে চলছিল তখন মনে হচ্ছিল যেন নিজের কাছ থেকে দৌড়ে ছুটে পালাচ্ছি। একদিন আমার বয়স অল্প ছিল, আমি ছিলুম বিশ্বপ্রকৃতির বুকের মাঝখানে, নীল আকাশ আর শ্যামল পৃথিবী আমার জীবন-পাত্রে প্রতিদিন নানারঙের অমৃতরস ঢেলে দিত, কল্পলোকের অমরাবতীতে আমি দেবশিশুর মতোই আমার বাঁশি হাতে বিহার করতুম।’
সারাজীবন তিনি এই দেবশিশুর বোধকে তিনি লালন করতেন। তাই শিল্প-সাহিত্যের সব শাখায় সমান বিচরণ করতে গিয়ে তিনি শিশুদের জন্য ভাবনার জায়গাটিও উন্মুক্ত রেখেছিলেন।
সাহিত্যে বিশেষ করে লোকসাহিত্যে শিশুর উপযোগী উপকরণ যথেষ্টই আছে। প্রাক-রবীন্দ্রযুগের সাহিত্যের শিশু রয়েছে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথই প্রথম শিশুদের কথা ভেবেছেন শিশুদের মতো করেই। শিশুদের মনের কথা, যা একান্তই তাদের নিজস্ব—এই বোধ তিনি লালন করেছেন। শিশুদের এই ভাবনা যা শিশু হয়তো তা মা-বাবার কাছেও খোলসা করে প্রকাশ করে না, রবীন্দ্রনাথ সেই কথাগুলোও তুলে এনেছেন তার ছড়া, গান ও নানান রচনায়।
রবীন্দ্রনাথ কবিতা রচনার শুরু করেছেন শিশু বয়সেই। তার স্মৃতিকথায় জানা যায়, “আমার বয়স তখন সাত-আট বছরের বেশি হইবে না। আমার এক ভাগিনেয় শ্রীযুক্ত জ্যোতিপ্রকাশ আমার চেয়ে বয়সে বেশ একটু বড়ো। তিনি তখন ইংরাজি সাহিত্যে প্রবেশ করিয়া খুব উৎসাহের সঙ্গে হ্যামলেটের স্বগত উক্তি আওড়াইতেছেন। আমার মতো শিশুকে কবিতা লেখাইবার জন্য তাঁহার হঠাৎ কেন যে উৎসাহ হইল তাহা আমি বলিতে পারি না। একদিন দুপুরবেলা তাঁহার ঘরে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, ‘তোমাকে পদ্য লিখিতে হইবে।’ বলিয়া, পয়ারছন্দে চৌদ্দ অক্ষর যোগাযোগের রীতিপদ্ধতি আমাকে বুঝাইয়া দিলেন।” (কবিতা রচনারম্ভ)
মায়ের সঙ্গে শিশুর যে সম্পর্ক তা রবীন্দ্রনাথ সুন্দরভাবে অংকন করেছেন। তার ‘শান্তিনিকেতন’ প্রবন্ধে পাই তারই চমৎকার ও সাবলীল প্রকাশ, ‘মাতাই শিশুকে জানিয়ে দিলে, বিশাল বিশ্বজগৎ তার আত্মীয়, নইলে মাতা তার আপন হত না। মাতাই তাকে জানিয়ে দিলে, নিখিলের ভিতর দিয়ে যে যোগের সূত্র তাকে বেঁধেছে, সেটি কেবল প্রাকৃতিক কার্যকারণের সূত্র নয়, সে একটি আত্মীয়তার সূত্র। সেই চিরন্তন আত্মীয়তা পিতামাতার মধ্যে রূপ গ্রহণ করে জীবনের আরম্ভেই শিশুকে এই জগতে প্রথম অভ্যর্থনা করে নিলে। একেবারেই যে অপরিচিত, এক নিমেষেই তাকে সুপরিচিত বলে গ্রহণ করলে, সে কে? এমনটা পারে কে? এ শক্তি আছে কার? সেই অনন্ত প্রেম, যিনি সকলকেই চেনেন এবং সকলকেই চিনিয়ে দেন।’
রবীন্দ্রনাথই প্রথম শিশুদের কথা ভেবেছেন শিশুদের মতো করেই। শিশুদের মনের কথা, যা একান্তই তাদের নিজস্ব—এই বোধ তিনি লালন করেছেন।
কেবল মা নন, বাবার সঙ্গে শিশুর সম্পর্কও তিনি আবিষ্কার করেছেন। তার ভাবনার সব অংশ জুড়েই শিশু। তাই শান্তিনিকেতন নিয়ে লিখতে গিয়েও তিনি শিশুর কথা ভোলেননি। মাতাপিতার দায়িত্ব পালনের কথাও তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। শিশুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা এবং পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠা নিয়ে তাঁর দর্শন এরকম—‘ভগবান তাকে তাদের সঙ্গে সমান হতে দেবেন না; তিনি চান যে তাঁর বিশ্বের মধ্যে কেবল মানুষই আপনাকে গড়ে তুলবে, আপনার ভিতরকার মনুষ্যত্বটিকে অবাধে প্রকাশ করবে। সেইজন্যে তিনি মানুষের শিশুকে সকলের চেয়ে অসহায় করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, তাকে উলঙ্গ করে দুর্বল করে পাঠিয়েছেন। আর-সকলেরই জীবনরক্ষার জন্যে যে-সকল উপকরণের দরকার তা তিনি দিয়েছেন; বাঘকে তীক্ষ্ম নখদন্ত দিয়ে সাজিয়ে পাঠিয়েছেন। কিন্তু, এ কী তাঁর আশ্চর্য লীলা যে, মানুষের শিশুকে তিনি সকলের চেয়ে দুর্বল অক্ষম ও অসহায় করে দিয়েছেন! কারণ, এরই ভিতর থেকে তিনি তাঁর পরমা শক্তিকে দেখাবেন। যেখানে তাঁর শক্তি সকলের চেয়ে বেশি থেকেও সকলের চেয়ে প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে সেইখানেই তো তাঁর আনন্দের লীলা। এই দুর্বল মনুষ্যশরীরের ভিতর দিয়ে-যে একটি পরমা শক্তি প্রকাশিত হবে এই তাঁর আহ্বান।’ (শান্তিনিকেতন)
রবীন্দ্রসাহিত্যে ‘শিশু’ শব্দটি যেমন হুবহু আছে তেমনি তার প্রতিশব্দ যেমন ছেলেবেলা, ছোটবেলা কিংবা সমাসবদ্ধ নানান যুক্তশব্দও রয়েছে। রবীন্দ্ররচনাবলি ঘেঁটে সরাসরি ‘শিশু’ শব্দটি কতবার ব্যবহৃত হয়েছে, তার একটি সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব করা যায়। তাতে দেখা যায়, শিশু-সম্পর্কিত বিভিন্ন শব্দ এসেছে ৮৭২ বার।
‘শিশু’ শব্দটি সরাসরি এসেছে ৩৩৭ বার। ষষ্ঠী বিভক্তিযুক্ত ‘শিশুর’ শব্দটি এসেছে ২২৫ বার। ‘শিশুকাল’ ১২২ বার, ‘শিশুদের’ ৭০ বার, ‘শিশুকে’ ৪৩ বার, ‘শিশুকালে’ ২৪ বার, ‘শৈশব’ ১৮ বার, ‘শিশুরে’ ১২ বার, ‘শিশুদিগকে’ ১১ বার, ‘শৈশবকাল’ ৮ বার, ‘শিশুতে’ ২ বার।
শিশুর যত সম্পদ আছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ সম্পদ তার মা। মাকে কেন্দ্র করেই তার সব জগত আবর্তিত। মাকে শিশুর সব সময় মনে পড়ার কথা। কিন্তু কখনো কখনো সে মাকেও ভুলে যায়। আবার তখনই হয়তো কোনো কাজের ফাঁকে মা এসে সামনে দাঁড়ায়। এই অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে ‘শিশু ভোলানাথ’ গ্রন্থের ‘মনে পড়া’ কবিতায়—
‘মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে
হঠাৎ অকারণে
একটা কী সুর গুনগুনিয়ে
কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন
আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত, আমার
দোলনা ঠেলে ঠেলে;
মা গিয়েছে, যেতে যেতে
গানটি গেছে ফেলে।’
মায়ের পাশে বাবাও থাকেন শিশুর অন্তরে। শিশুর দুষ্টুমিতে বাবা শাসন করলে শিশু তার মাকে জানায়। কেবল মাকে জানানো নয়, রীতিমতো অভিযোগ দায়ের! ‘শিশু’ গ্রন্থের ‘সমালোচক’ কবিতায় শুনি—
‘বাবা নাকি বই লেখে সব নিজে।
কিছুই বোঝা যায় না লেখেন কী যে।
সেদিন পড়ে শোনাচ্ছিলেন তোরে,
বুঝেছিলি? -- বল্ মা সত্যি ক'রে।
এমন লেখায় তবে
বল্ দেখি কী হবে।
তোর মুখে মা, যেমন কথা শুনি,
তেমন কেন লেখেন নাকো উনি।
ঠাকুরমা কি বাবাকে কক্খনো
রাজার কথা শোনায় নিকো কোনো।
সে-সব কথাগুলি
গেছেন বুঝি ভুলি?’
এই অভিযোগের কি জবাব আছে? শিশুদের মনের এই মৌলিক জিজ্ঞাসা রবীন্দ্রনাথই যথাযথভাবে শনাক্ত করতে পেরেছেন। এই সমালোচক-শিশুই আবার হয়ে পড়েন পালিয়ে বেড়ানোর সুযোগ খোঁজা এক বুদ্ধিমান ভাবুক। ভেতরে ভেতরে সে হয়ে ওঠে নিতান্তই বাউল।
রবীন্দ্রসাহিত্যে শিশুভাবনার নানান রূপ ও তার রূপান্তর আছে। ওপরের এই ছড়া-কবিতায় তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। ছোটদের উপযোগী করে তিনি লিখেছেন ‘খাপছাড়া’, ‘চিত্রবিচিত্র’, ‘ছড়ার ছবি’, ‘ছড়া’, ‘শিশু’, ‘শিশু ভোলানাথ’ প্রভৃতি। এসব গ্রন্থে তিনি শিশুমনের বিচিত্র ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। শিশুর চিন্তা কেবল সরল ও সহজ নয়, তা যে অনেক জটিল রহস্যেও ভেতরেও প্রবেশ করতে পারে তা জানা যায় ‘জন্মকথা’ কবিতায়—
“খোকা মাকে শুধায় ডেকে--
"এলেম আমি কোথা থেকে,
কোন্খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।'”
শিশুমনের এই চিরন্তন প্রশ্ন কেবল শিশুরই নয়, যেকোনো মানুষেরই। ‘জন্মকথা’র মধ্য দিয়ে যে জন্মরহস্য উঁকি দিয়ে যায়, তার জবাব খুঁজে ফিরছেন বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানী ও দার্শনিক। শিশুর এই প্রশ্নের জবাব দিতে কবি মায়ের মুখে জুড়ে দিয়েছেন অমোঘ এক বাণী—‘ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে’।
রবীন্দ্রভাবনায় শিশু কেবল ‘শিশু’ নয়, এটি নবীনতা এবং সৃষ্টিশীলতার প্রতীক। তিনি যখন সাহিত্যচর্চা শুরু করেন, কিংবা বলা যায় সাহিত্যের হাল ধরেন, তখন সাহিত্যকে তিনি মনে করতেন ‘শিশু’। তাঁর ভাষায়—‘‘আর, আমাদের দুয়ারানীর ঘরে আমাদের দেশের সাহিত্য, আমাদের দেশের ভাবী আশাভরসা, আমাদের হতভাগ্য দেশের একমাত্র স্থায়ী গৌরব জন্মগ্রহণ করিয়াছে। এই শিশুটিকে আমরা বড়ো একটা আদর করি না; ইহাকে প্রাঙ্গণের প্রান্তে উলঙ্গ ফেলিয়া রাখি এবং সমালোচনা করিবার সময় বলি, ‘ছেলেটার শ্রী দেখো! ইহার না আছে বসন, না আছে ভূষণ; ইহার সর্বাঙ্গেই ধুলা!’ ভালো, তাই মানিলাম। ইহার বসন নাই, ভূষণ নাই, কিন্তু ইহার জীবন আছে। এ প্রতিদিন বাড়িয়া উঠিতে থাকিবে। এ মানুষ হইবে এবং সকলকে মানুষ করিবে। আর, আমাদের ঐ সুয়ারানীর মৃত সন্তানগুলিকে বসনে ভূষণে আচ্ছন্ন করিয়া যতই হাতে-হাতে কোলে-কোলে নাচাইয়া বেড়াই-না কেন, কিছুতেই উহাদের মধ্যে জীবনসঞ্চার করিতে পারিব না।’’ (বাংলা জাতীয় সাহিত্য)
একই প্রবন্ধে তিনি শিশু সাহিত্যের সেবক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন। এই ‘শিশু সাহিত্য’ শিশুদের জন্য রচিত সাহিত্য নয়, সাহিত্য হিসেবে যে শিশু পর্যায়ে অর্থাৎ শুরুও পর্যায়ে রয়েছে, তাকে বোঝানো হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—‘আমরা যে-কয়েকটি লোক বঙ্গভাষার আহ্বানে একত্র আকৃষ্ট হইয়াছি, আপনাদের যথাসাধ্য শক্তিতে এই শিশু সাহিত্যটিকে মানুষ করিবার ভার লইয়াছি, আমরা যদি এই অভূষিত ধূলিমলিন শিশুটিকে বক্ষে তুলিয়া লইয়া অহংকার করি, ভরসা করি কেহ কিছু মনে করিবেন না।’ (বাংলা জাতীয় সাহিত্য)
আরও পড়ুন
তিনি যেমন সাহিত্যকে শিশুর সঙ্গে তুলনা করে তাকে লালন করার প্রতিজ্ঞা করেছেন, তেমনি নিজের সাহিত্যেও পাঠক হিসেবে শিশুকে স্তন্যদায়ী মাকেও কামনা করেছেন। মা যেমন শিশুকে ভালোবাসেন, তেমনি যেন তার সাহিত্যকে ভালোবাসেন, এমন বাসনায় তিনি লিখেছেন—‘শত শত পাঠকের ঘরের মধ্যে বসিয়া তাঁহাদের সহিত কথা কহিতেছি। ... কোন জননী কি তাঁহার স্নেহের শিশুকে স্তন্যদান করিতে করিতে আমার লেখা পড়েন নাই ও সেই সঙ্গে সেই অসীম স্নেহের কিছু ভাগ আমাকে দেন নাই? সুখে দুঃখে হাসি কান্নায় আমার মমতা,আমার স্নেহ, সহসা কি সান্ত্বনার মত কাহারও কাহারও প্রাণে গিয়া প্রবেশ করে নাই ও সেই সময়ে কি প্রীতিপূর্ণ হৃদয়ে দূর হইতে আমাকে বন্ধু বলিয়া তাঁহারা ডাকেন নাই? ...যাঁহারা আমার যথার্থ বন্ধু, আমার প্রাণের লোক, কেবলমাত্র দৈববশতই যাঁহাদের সহিত আমার কোনো কালে দেখা হয় নাই, তাঁহাদের সহিত যদি মিলন হয়! সেই সকল পরমাত্মীয়দিগকে উদ্দেশ করিয়া আমার এই প্রাণের ফুলগুলি উৎসর্গ করি।’ (বিবিধ প্রসঙ্গ)
এই প্রাণের ফুল তার সমগ্র সাহিত্য ও শিল্পকর্ম। আর সব কিছুতেই তিনি শিশুকে তুলে ধরেছেন। তিনি যেমন শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন, অর্থাৎ শিশুদের উপযোগী ছড়া-কবিতা লিখেছেন আবার শিশুচরিত্রকে নিয়ে তিনি বড়দের উপযোগী সাহিত্য রচনা করেছেন। বলা যায়, তিনি যখন বড়দের জন্য লিখেছেন, তখনও শিশুকে সমান গুরুত্বে স্থান দিয়েছেন। তিনি যখন সন্ধ্যাসংগীত রচনা করেছেন তখনও এসেছে শিশুদের কথা।
এখানে মানবশিশু নয়, মেঘশিশু হয়ে উঠেছে গানের উপজীব্য। আবার কান্নার তুলনা করতে গিয়েও তিনি শিশুর প্রসঙ্গ এনেছেন সন্ধ্যাসংগীতেরই আরেকটি গানে—
‘সমস্ত হৃদয় ব্যাপি একবার উচ্চস্বরে
অনাথ শিশুর মতো ওঠ্ রে কাঁদিয়া
প্রাণের মর্মের কাছে
একটি যে ভাঙা বাদ্য আছে
দুই হাতে ডুলে নে রে, সবলে বাজায়ে দে রে
নিতান্ত উন্মাদ-সম ঝন্ ঝন্ ঝন্ ঝন্।’ (দুঃখ-আবাহন)
‘প্রভাতসংগীত’-এর ‘দাঁড়ায়ে মুখোমুখি হাসিছে শিশুগুলি’, ‘এ ধরায় মোরা সবে শতাব্দীর ক্ষুদ্র শিশু’, ‘ফুটে আছে শিশুমুখে প্রথম হাসির প্রায়’ প্রভৃতি গানে শিশু এসেছে নানান অনুষঙ্গে। ‘মানসী’, ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘চৈতালী’, ‘কণিকা’, ‘কথা ও কাহিনী’, ‘কল্পনা’, ‘ক্ষণিকা’, ‘নৈবেদ্য’, ‘খেয়া’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘বলাকা’ প্রভৃতি কাব্যের অজস্র চরণে শিশু এসেছে উপমা-প্রতীক-রূপক হয়ে।
রবীন্দ্রসাহিত্যে শিশুভাবনার নানান রূপ ও তার রূপান্তর আছে। ওপরের এই ছড়া-কবিতায় তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। ছোটদের উপযোগী করে তিনি লিখেছেন ‘খাপছাড়া’, ‘চিত্রবিচিত্র’, ‘ছড়ার ছবি’, ‘ছড়া’, ‘শিশু’, ‘শিশু ভোলানাথ’ প্রভৃতি।
গীতাঞ্জলি কাব্যে ‘রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে’ কিংবা ‘যতকাল তুই শিশুর মতো রইবি বলহীন’ চরণে শিশুর উপস্থিতি আবিষ্কার করা যায়। এমন করে ‘সোনার তরী’ কাব্যেও কয়েকটি চরণ উদ্ধার করা যায়—
‘শিশু অশ্বত্থের গাছ আপন ছায়ার নাচ’
‘কোলের শিশুরে হেরিয় জননী হাসিছে আপন মনে’
‘আমি পৃথিবীর শিশু বসে আছি তব উপকূলে’
‘জননী যেমন জানে জঠরের গোপন শিশুরে’
‘মাতৃস্তন পানরত শিশুর মতন’
‘এখনো তোমার বুকে আছি শিশুপ্রায়’ প্রভৃতি।
রবীন্দ্রনাথের এই শিশুভাবনা নিয়ে রবীন্দ্রগবেষক রেখা রায়চৌধুরীর মূল্যায়নটি এক্ষেত্রে স্মরণ করা যায়। ‘শিশু রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের শিশুকাব্য’ নামের এক প্রবন্ধে তিনি যথার্থই পর্যবেক্ষণ করেছেন—‘...শিশুর উপমা, শিশুর রূপক আর শিশু কথাটি কবির রচনায় বাড়ে বাড়ে ঘুরেফিরে এসেছে। বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে যে শিশু বলতে কবি শুধু মানবকে বুঝিয়েছেন তাই নয়। বৃক্ষশিশু, পশুশিশু, মানবশিশু—সমস্ত কিছুই তাঁর কাছে সমমর্যাদায় স্থিত। একেই বলা যায় রবীন্দ্রনাথের শৈশবচেতনার স্বরূপ। সেই চেতনার জগতে এক হয়ে মিশে রয়েছে মানুষ, মনুষ্যেতর প্রাণী, উদ্ভিদ, বনরাজি, ঋতুবৈচিত্র্য সমস্ত কিছুই।’ (পশ্চিমবঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনম্মৃতি’ ও ‘ছেলেবেলা’য় শিশুকালের স্মৃতি তুলে ধরেছেন। ‘গল্পগুচ্ছ’-এর ‘খোকুবাবুর প্রত্যাবর্তন, ‘গিন্নি’ সম্পত্তি সমর্পণ’, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ছুটি’, ‘বলাই’, ‘ইচ্ছাপূরণ’, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’ প্রভৃতি গল্পে শিশুচরিত্র এবং শিশুমনস্তত্ত্ব প্রস্ফুটিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সত্তা জুড়ে যে শিশু রয়েছে, এই গল্পগুলোই তার প্রমাণ বহন করে চলছে।
নাটক রচনার ক্ষেত্রে তিনি শিশুদের প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন। ‘মুকুট’, ‘ছাত্রের পরীক্ষা’ এবং ‘রোগের চিকিৎসা’ এই তিনটি নাটক পুরোপুরিই শিশুতোষ। এর পাত্রপাত্রীও শিশু। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে যে, নাটকের ক্ষেত্রেও তার ভাবনা শিশু বর্জিত হয়নি। তার শিশুভাবনা নিয়ে বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক এবং শিশুসাহিত্যিক অমিতাভ চৌধুরী বলেছেন—‘রবীন্দ্রনাথ ছোট বড় সকলের। কিন্তু আমার মনে হয় তিনি যেন ছোটদেরই বেশি। গল্প কবিতা নাটক—কত কিছু লিখেছেন তাদের জন্যে। ছোটদের মন ভোলাতে, শিক্ষা দিতে তিনি যেন শিক্ষকের ভূমিকা নিয়েছেন। শান্তিনিকেতনে তো শিক্ষকতাও করেছেন অনেকদিন।’
হ্যাঁ শিক্ষক হিসেবেও তিনি ভেবেছেন শিশুদের নিয়ে। তার শিক্ষাভাবনায়ও গুরুত্ব পেয়েছে শিশু। তাই শান্তিনিকেতনকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হলেও শিশুশিক্ষার পাঠ তিনি অব্যাহত রেখেছেন। রবীন্দ্রসাহিত্যে শিশুভাবনার বহুমাত্রিক প্রকাশ কেবল আদর জানানো কিংবা আনন্দ দেওয়া নয়, ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে যোগ্য করে গড়ে তোলার অঙ্গীকারও বটে! রবীন্দ্রসাহিত্যে শিশুভাবনা তাই কবি রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনভাবনারই সমার্থক।
ড. তপন বাগচী ।। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত ফোকলোরবিদ ও কবি; পরিচালক (চলতি দায়িত্ব), বাংলা একাডেমি
