নদী-জলাশয়ের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করবে কে?

রংপুর শহরের শ্যামাসুন্দরী নদীতে একসময় অনেক মাছ ছিল। এই মাছ এখন একেবারেই নেই। দূষিত পানির কারণে কোনো মাছ আর এখানে বেঁচে থাকে না। পাশেই ঘাঘট নদী ছিল মাছে ভরা। এখন সেসব মানুষের গল্পে বেঁচে আছে। লালমনিরহাটে সতী নদীতে চল্লিশটির বেশি প্রজাতির মাছ ছিল। এখন সেখানে সংখ্যা ১০-১৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।
তিস্তা অনেক বড় নদী। এ নদীর প্রচুর মাছের গল্প শোনা যায়। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম পক্ষে সম্পূর্ণ তিস্তা নদী নৌপথে ঘুরেছি। সব মিলিয়ে ২০টি নৌকাও ছিল না মাছ ধরার। যারা মাছ ধরছিলেন তারাও তেমন মাছ পাননি।
তিস্তা নদী যখন অনেক গভীর ছিল তখন নদীতে মাছ থাকতো। ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর মাছও ধরে রাখা যায়নি। পদ্মা-যমুনাসহ সব নদীরই জীববৈচিত্র্য সংকটের মুখে। ছোট নদীতে কিংবা জলাশয়ে ছোটবেলা অনেক প্রজাতির মাছ দেখেছি। এখন আর সেসব মাছ চোখেই পড়ে না। নদী-বিল-জলাশয় সব স্থান থেকে দেশি মাছ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
কেবল মাছের বিষয়টি আমাদের চোখে পড়ে। তাও যে সবার চোখে পড়ে তা নয়। নতুন প্রজন্ম যেহেতু এসব মাছ দেখেনি তাই তাদের এসব মাছের প্রতি বিশেষ টান নাও থাকতে পারে।
পদ্মা-যমুনাসহ সব নদীরই জীববৈচিত্র্য সংকটের মুখে। ছোট নদীতে কিংবা জলাশয়ে ছোটবেলা অনেক প্রজাতির মাছ দেখেছি। এখন আর সেসব মাছ চোখেই পড়ে না। নদী-বিল-জলাশয় সব স্থান থেকে দেশি মাছ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
নদী-জলাশয় থেকে অসংখ্য পোকামাকড় উঠে গেছে। বিলে-নদীতে আগে প্রচুর পটকা পোকা পাওয়া যেত এখন আর নেই। আগে প্রচুর জোঁক ছিল সেই জোঁকও কমে গেছে। কাছিম ছিল অনেক। সেই কাছিমও এখন বিরল হয়ে উঠেছে। ভোঁদড় ছিল সর্বত্রই। ২০২৪ সালে তিস্তা নদীতে একটি ভোঁদড় দেখেছি। ভোদড়ের সংখ্যা বিলীন প্রায়। কুমির কিংবা শুশুক অনেক নদীতে দেখা যেত। সেগুলো আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।
বড় মাছ, ডলফিন, কাছিম থেকে শুরু করে ছোট ছোট পোকামাকড় অনেকটাই বিলুপ্ত। প্রকৃতিতে যত পোকামাকড় আছে সবগুলোই প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে। অথচ আমাদের দেশে অবস্থা এমন যে কেবল মানুষকে বাঁচিয়ে রেখে এবং সরাসরি মানুষের প্রয়োজন এমন কিছু প্রাণীকে অগ্রাধিকার দিয়ে আর সবকিছুকে মেরে ফেলার চেষ্টায় যেন আমরা নেমেছি।
আমরা লক্ষ্যই করি না যে, নদী তথা জলাশয়গুলো ভরাট হওয়ার কারণে কিংবা বিষ প্রয়োগে পোকামাকড়-ছোট মাছ মেরে ফেলার কারণে পাখিও তার আবাস এবং খাবার হারাচ্ছে। খাদ্য এবং আবাস সংকটে এদেশের নদী-জলাশয় নির্ভর পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন
সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়ে এসব নিয়ে কোনো গবেষণাও চোখে পড়ে না। সরকারিভাবে এসব প্রাণী সংরক্ষণে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা চোখে পড়ে না। অনেক নদীকে বিল শ্রেণিভুক্ত করে লিজ দেওয়া হয়।
অনেক জলাশয়ও লিজ দেওয়া হয়। লিজ গ্রহীতাগণ অধিক মুনাফার আশায় বিষ প্রয়োগে প্রথমে সব পোকামাকড় ছোট মাছ মেরে ফেলে। এরপর মাছ চাষ করে। মাছ চাষ শেষে আবারও বিষ প্রয়োগ করে শেষ মাছটুকুও মেরে বিক্রি করে। এতে করে ওই জলাশয়-নদীর মাছ এর সাথে পোকামাকড়ও মারা যায়। সরকারিভাবে এসবের কোনো তদারকি নেই।
যেসব নদীতে দূষণ আছে সেখানে মাছ কিংবা কোনো পোকামাকড় বেঁচে থাকার উপায় নেই দেখে এগুলো বাঁচে না। আবার যেসব নদী ভরাট হয়ে যায় সেখানে আবাস হারিয়েছে জলজ প্রাণী। যেসব নদী গভীরতা হারিয়েছে সেখানে গভীর পানির মাছ ও পোকামাকড় থাকে না। যেসব নদী বিল হিসেবে ইজারা দেয় সেখানে জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হয়। আমাদের জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস সরকার বহুমাত্রিক চেষ্টা আছে। একটি চেষ্টাও নেই এগুলো বাঁচিয়ে রাখার।
যাদের বয়স এখন পঞ্চাশ তারাও যত জলজ প্রাণীর বিষয়ে গল্প করেন তাতে বোঝা যায় চল্লিশ বছর আগেও প্রচুর জলজ প্রাণী ছিল। এই মাত্র ৩০-৪০ বছরে একটি দেশ থেকে শত শত প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে।
মাছসহ আমাদের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আমাদের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই উদ্যোগ দেশের সাধারণ সচেতন নাগরিকদের গ্রহণ করতে হবে। কেবল সরকার করছে না—এই সমালোচনা করে আমাদের এসব জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা যাবে না।
সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলেও সরকারের কর্তা ব্যক্তিগণ অধিকাংশ সময়ে এগুলোর ক্ষেত্রে উদাসীন থাকে। এজন্য ব্যক্তি-সংগঠন-সংস্থাও জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষায় কাজ করতে পারে। জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
আমরা লক্ষ্যই করি না যে, নদী তথা জলাশয়গুলো ভরাট হওয়ার কারণে কিংবা বিষ প্রয়োগে পোকামাকড়-ছোট মাছ মেরে ফেলার কারণে পাখিও তার আবাস এবং খাবার হারাচ্ছে। খাদ্য এবং আবাস সংকটে এদেশের নদী-জলাশয় নির্ভর পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
সরকার ছোট নদীসহ জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ নিষেধ করতে পারে। কীভাবে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা জলজ প্রাণী টিকে থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারিভাবে একটি তালিকা প্রণয়ন করা হোক—যেখানে আমাদের দেশের জলজ প্রাণীর অতীত-বর্তমান সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
জলজ প্রাণীসমূহ সংরক্ষণের রূপরেখা তৈরি করতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সরকার যদি জলজ প্রাণী সুরক্ষায় কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে তবে এ কাজ সহজ হবে। নয়তো আমাদের দেশের নদী-জলাশয় থেকে নিকট ভবিষ্যতে আরও অনেক জলজপ্রাণী বিলুপ্ত হবে।
যার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব পড়বে পরিবেশের ওপর, যার চূড়ান্ত ক্ষতি হবে মানুষের। যে মানুষ আজ বুঝতে পারছে না পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তারা এক অভিশপ্ত প্রকৃতিবলয় নির্মাণ করে চলছে।
আমাদের উন্নয়ন অবশ্যই হতে হবে প্রকৃতিবান্ধব। প্রকৃতির ক্ষতি সাধন করে যে উন্নয়নই হোক না কেন তা পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষতি করেই হবে। কেবল নিজেদের আয়েশের জন্য মানুষের জন্ম নয়। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি জনবান্ধব প্রকৃতিবলয় আমাদের রেখে যাওয়া একজন আদর্শ নাগরিকের দায়িত্ব-কর্তব্য। রাষ্ট্রের জন্য এটাই আদর্শ হওয়া জরুরি।
ড. তুহিন ওয়াদুদ : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
[email protected]
