উৎসাহ একদিকে, বাধা অন্যদিকে, ট্রাভেল খাতে স্পষ্ট দ্বৈত নীতি

দেশে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করলেও ভ্রমণ খাতের ক্ষুদ্র ট্রাভেল এজেন্টরা নিজেদের জন্য পরিস্থিতিকে আরও কঠিন বলেই দেখছেন। তাদের অভিযোগ—সরকার উদ্যোক্তা তৈরিতে উৎসাহ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তব নীতিমালায় ছোট এজেন্টদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
কঠোর নীতিমালায় ছোট এজেন্সিগুলোর দিশেহারা অবস্থা। সম্প্রতি লাইসেন্সিং, নিরাপত্তা যাচাই এবং অনলাইন সিস্টেমে কঠোরতা ছোট এজেন্টদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। তাদের অভিযোগ—উদ্যোক্তা তৈরির প্রণোদনা একদিকে, আর বাস্তব নীতিমালা অন্যদিকে—ফলে তৈরি হয়েছে এক ধরনের দ্বৈততা।
ছোট ছোট ট্রাভেল এজেন্টদের অনেকের বক্তব্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়-লাইসেন্স ফি ও সিকিউরিটি ডিপোজিট বেড়েছে, বাড়তি কাগজপত্র ও যাচাই–বাছাইয়ের চাপ, অনলাইন সিস্টেম ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা কিংবা বড় বড় ট্রাভেল এজেন্টগুলোর বাজার দখলের প্রবণতা। ছোট ছোট ট্রাভেল এজেন্সির উদ্যোক্তাদের সবার বক্তব্যই প্রায় একই রকম, তা হচ্ছে, ‘নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার কথা শুনি, কিন্তু আমাদের মতো ছোট এজেন্টদের টিকে থাকার জায়গাটাই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।’
উদ্যোক্তাবান্ধব নীতির সঙ্গে বাস্তবতার সংঘাত ওপেন স্কাই-এর মতো। সরকার ও নীতিনির্ধারক সংস্থাগুলো বলছে, দেশে ব্যবসা সহজীকরণ, ডিজিটাল সেবা, প্রশিক্ষণ ও স্টার্টআপ সহায়তা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ট্রাভেল এজেন্টদের মতে, এই সুবিধাগুলো বাস্তবে তাদের কাছে পৌঁছায় না। বাস্তবতার নিরিখে তাদের বক্তব্য হলো, ‘উদ্যোক্তা তৈরির প্রচারণা এক দিকে—অন্যদিকে এমন নীতি যে, নতুন বা ছোট এজেন্টরা ব্যবসায় আসতেই ভয় পায়।’
যেকোনো সেক্টরে বিশেষজ্ঞদের মতে, নীতিমালায় অসামঞ্জস্যতা থাকলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যায় এবং বাজারে বড় প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া প্রভাব বৃদ্ধি পায়। বড় ব্যবসায়ীরা আরও বড় হতে থাকে আর ছোট ব্যবসায়ীরা ছোট হতে হতে একসময় অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বড় বনাম ছোট বাজার ব্যবস্থায় অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশে অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি সেক্টর বর্তমানে বেশ গতিশীল এবং সুসংহত চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর জনপ্রিয়তা দেশে দ্রুততার সাথে বাড়ছিল। দেশে অন্তত ৪০টি সক্রিয় ওটিএ রয়েছে, যা বিমান টিকিট, হোটেল বুকিং, ভিসা প্রসেসিং, ট্যুর প্যাকেজ ইত্যাদি সার্ভিস দিচ্ছিল। জনপ্রিয় বেশ কতগুলো ওটিএ এর মধ্যে শেয়ারট্রিপ, ট্রিপলাভার, ফার্স্টট্রিপ, গোযায়ান, আকিজ এয়ার, বিফ্রেশ উল্লেখযোগ্য। তাদের প্রবৃদ্ধি প্রতিনিয়ত বাড়ছিল; তাদের এয়ার-টিকেট, প্যাকেজ, হোটেল এবং ভিসা সেবা প্রতিনিয়ত কয়েকগুণ বাড়িয়ে ট্রাভেল ইন্ডাস্ট্রিকে করোনা মহামারি পরবর্তী এ খাত পুনরায় ব্যবসায় দৃষ্টিকোণ থেকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিজেদের তৈরি করছিল।
ওটিএগুলো বি-টু-বি ও বি-টু-সি উভয়ভাবেই পরিচালনা করছে। হঠাৎ যেন ছন্দপতন। সরকার নতুন একটি খসড়া পরিপত্র প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে ‘এক ট্রাভেল এজেন্সি অন্য এজেন্সির সঙ্গে টিকিট ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না।’
তাহলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি এজেন্সিগুলোর জন্য বড় ঝুঁকির কারণ তারা বড় এজেন্সি বা আয়াটা অনুমোদিত এজেন্সি থেকে টিকিট কিনে বিক্রি করে থাকে। শেষ পর্যন্ত যদি সরকার পরিপত্রে অটল থাকে তাহলে সারা দেশে প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক ট্রাভেল এজেন্ট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। যা কোনোভাবেই ট্রাভেল ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভালো ফল বয়ে নিয়ে আসবে না। বড় ট্রাভেল এজেন্টগুলো সক্ষমতার কারণে আরও অধিক ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে আরও বড় হবে কিন্তু উদ্যোক্তা পর্যায়ে ছোট ট্রাভেল এজেন্টগুলো ব্যবসা হারিয়ে ভবিষ্যৎ স্বপ্নকে অংকুরেই ধ্বংস করে নিঃস্ব হয়ে পথে বসে যাবে।
অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সির জন্য স্পষ্ট এবং কঠোর নীতিমালা দরকার। প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড এবং ‘লোভনীয় প্যাকেজ’ প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্কতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। কিছু স্ক্যাম বা প্রতারণামূলক ওটিএ-র ঘটনা আটাব-এর উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
ওটিএগুলো শুধু টিকিট বিক্রি করেই থেমে থাকে না—তারা ট্যুর প্যাকেজ, ভিসা সেবা, হোটেল বুকিং এবং কর্পোরেট ট্রাভেল সেবা প্রদানে সম্ভাবনাময়। সফল ওটিএ যেমন শেয়ারট্রিপ, ট্রিপ লাভার, বিফ্রেশ, ফার্স্টট্রিপ, আকিজ এয়ার ইতিমধ্যেই বাজারে ভালো ব্র্যান্ড ইমেজ গঠন করেছে, যা নতুন ব্যবহারকারী আকর্ষণ করতে সহায়ক। দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ওটিএগুলো এই চাহিদা মেটাতে পারে।
যদি সঠিকভাবে নিয়ম ও নীতিমালা গৃহীত হয় এবং ছোট এজেন্সিগুলোর জন্য সুবিচার করা হয়, তাহলে ওটিএ সেক্টর আরও টেকসই ও সার্বিকভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে। একদিকে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা তরুণ উদ্যোক্তা তৈরির জন্য নানা উদ্যোগ নিচ্ছে—স্টার্টআপ ফান্ড, প্রশিক্ষণ, কর-সুবিধা, অনলাইন ব্যবসা সহজীকরণ ইত্যাদি। অন্যদিকে ট্রাভেল এজেন্সি খাতে সাম্প্রতিক নীতি, লাইসেন্স নবায়ন, কঠোর নিয়ম, নিরাপত্তা যাচাই, আর্থিক গ্যারান্টি ইত্যাদি ছোট এজেন্টদের জন্য বাস্তবে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ফলে প্রকৃত চিত্র দাঁড়ায়—উদ্যোক্তা হওয়ার উৎসাহ আবার ছোট ট্রাভেল এজেন্টদের নিয়ন্ত্রণ। এ কারণে এটি বহু মানুষের কাছে দ্বৈত নীতির প্রকাশ মনে হয়।
উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি ঘোষণাগুলো ইতিবাচক হলেও ভ্রমণ খাতের ছোট এজেন্টদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন বাস্তবতা তুলে ধরছে। তাদের মতে, ‘উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে উদ্যোক্তা হতে, কিন্তু নিয়মগুলোই ছোট উদ্যোক্তাদের পথ আটকে দিচ্ছে।’
ফলে ট্রাভেল সেক্টরে নীতির এই দ্বৈততা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বাস্তবসম্মত ও সহনশীল নীতির উপস্থিতি প্রত্যাশা করছে।
মো. কামরুল ইসলাম : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, ঢাকা পোস্ট
