‘ভর্তি হওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমরা যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেটি এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। গেস্টরুমে নির্যাতনের শিকার হয়েও বাধ্য হয়ে আমাদের হলে থাকতে হয়। এটি যেন একটা আদালত। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ক্রাইম করেছি, এখানে আমাদের বিচার বসে!’

সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন ডেকে এসব কথা বলেন গেস্টরুমে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের শিক্ষার্থী আবু তালিব। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

তিনি বলেন, ‘হলে ওঠা বহু শিক্ষার্থী গেস্টরুমে নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু তারা ভয়ে মুখ খুলতে পারেন না। করোনার ছুটি শেষে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর বঙ্গবন্ধু হলের দ্বিতীয় বর্ষের অন্তত ২৫ জন শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়ে হল ছেড়েছেন। অনেকে হল ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন।’

শিক্ষার্থী আবু তালিবের এসব কথার সূত্র ধরে নির্যাতনের বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে ঢাকা পোস্ট। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, হল ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণার পর থেকে নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। রীতিমতো পরিকল্পনা করে প্রস্তুতি নিয়েই ‘নির্যাতন’ চালিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। নির্যাতনের মুখে অন্তত ১০-১২ জন শিক্ষার্থীর হল ছাড়ার কথা জানিয়েছেন তারা।

জানা গেছে, হলে সপ্তাহে তিন দিন প্রথম বর্ষ থেকে শুরু করে মাস্টার্স পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক ‘গেস্টরুম’ করানো হয়। অর্থাৎ গেস্টরুমে যেতে হয়। এছাড়া হলের বিভিন্ন কক্ষে ‘মিনি গেস্টরুম’ করানো হয়। ম্যানার শেখানোর নামে গেস্টরুম ও মিনি গেস্টরুমে চলে নির্যাতন। নিয়মিত মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি চলে শারীরিক নির্যাতন। এমনকি জুনিয়র শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।

সংবাদ সম্মেলন করা শিক্ষার্থী আবু তালিব গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার হন গত ১০ মার্চ। তার অপরাধ, বড় ভাইদের সামনে ‘সিগারেট খাওয়া’। তাকে হলের মিনি গেস্টরুমে ডেকে নিয়ে হাতে না ধরে, ধোঁয়া না ছেড়ে, কেবল ঠোঁটে চেপে সিগারেট টেনে শেষ করতে বাধ্য করেন তৃতীয় বর্ষের চার শিক্ষার্থী।

অভিযুক্তরা হলেন, সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী শেখ শান্ত আলম, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ইমদাদুল হক বাঁধন, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শাহাবুদ্দিন ইসলাম বিজয় ও আইন বিভাগের নাহিদুল ইসলাম শান্ত। এরা সবাই বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী এবং হল ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান শান্তর ছোট ভাই হিসেবে পরিচিত।

একইদিন ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করা এবং সিনিয়রের রুমে পা তুলে বসাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মহিদুল ইসলাম মুকুলকে ছুরি দেখিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেন কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী।

গেস্টরুমে শিক্ষার্থীরা

এদিকে গত ৮ মার্চ ‘প্রোগ্রামে’ (মিছিল) উপস্থিত না থাকার অভিযোগে দ্বিতীয় বর্ষের ১০ থেকে ১২ জন শিক্ষার্থীকে বঙ্গবন্ধু হল থেকে বের করে দেওয়া হয় এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য তাদের ৩০১ (ক) নম্বর কক্ষ তালা দিয়ে রাখা হয়। পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন হলে ঘুরে ঘুরে রাত কাটান তারা। পরে তারা তালা ভেঙে কক্ষে প্রবেশ করেন। এরপর গেস্টরুমে তাদের ডেকে নিয়ে ‘কে তালা ভেঙেছে’— তা জানতে চাওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছেন বলে ঢাকা পোস্টকে জানান তারা। এই শিক্ষার্থীরা কেউ ভয়ে নাম প্রকাশ করতে চাননি।

এর আগে গত ১ ও ৩ মার্চ গেস্টরুমে ডেকে নিয়ে তুচ্ছ কারণে মোশাররফ হোসেন, সিরাজুম মনির ও মীর সাদ নামের দ্বিতীয় বর্ষের তিন শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শাহনেওয়াজ আরেফিন পল্লব ও শেখ শান্ত আলম। পরে ঘটনা জানাজানি হলে তাড়াহুড়ো করে তাদের হলে তোলেন হল ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান শান্ত।

জানা গেছে, ছাত্রলীগের অলিখিত নিয়মানুয়ায়ী প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গেস্টরুমে নেন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। তবে বঙ্গবন্ধু হলে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের গেস্টরুমে নিতে দেওয়া হচ্ছে না। কারণ, তারা জুনিয়রদের ‘ঠিকমতো’ শাসন করতে পারছেন না। 

হলের গেস্টরুম বা অতিথিকক্ষে ডেকে নির্যাতন চালানোর ঘটনা শিক্ষার্থীদের কাছে ‘গেস্টরুম নির্যাতন’ নামে পরিচিত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বঙ্গবন্ধু হলের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, সপ্তাহে তিন দিন রুটিনমাফিক ছয় ঘণ্টা গেস্টরুম করতে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে। টানা গেস্টরুম করার কারণে শিক্ষার্থীদের সারা দিনের খাওয়া-দাওয়া, পড়ালেখা ও ঘুমানোর রুটিন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। কোনো কিছুই ঠিকঠাক হচ্ছে না। না পারছেন পড়তে, না পারছে ঘুমাতে। সম্ভব হলে এবং আর্থিক অবস্থা ভালো হলে ক্যাম্পাসের বাইরে বাসা ভাড়া করে থাকতেন বলে জানান তিনি।  

তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘এখন সাধারণত দুই ধরনের গেস্টরুম হয়ে থাকে—ফরমাল ও ইনফরমাল। ফরমাল গেস্টরুমের ক্ষেত্রে রাত ৯টা থেকে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা অন্তত ৪০ মিনিট ধরে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গেস্টরুম করান। এরপর তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের গেস্টরুম করান আরও ৪০ মিনিট ধরে। এভাবে চলে মাস্টার্স পর্যন্ত। ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা গেস্টরুম শেষ করার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এটা পুরোপুরিই একটা টর্চার সেল।’

মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা যারা এখন মাস্টার্সে অধ্যয়নরত, তাদের পড়াশোনা ছাড়া বাকি কোনোকিছু চিন্তা করার সুযোগ নেই। অথচ এই হলে আমাদেরও গেস্টরুমে যাওয়ার জন্য বাধ্য করা হয়। এটা আগে ছিল না। ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হওয়ার পর শুরু হয়েছে। এটি আমাদের জন্য এক ধরনের মানসিক নির্যাতন। আমরা এ নির্যাতন থেকে মুক্তি চাই।’

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে একের পর এক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। তারা বলছেন, প্রশাসন ছাত্রলীগের হাতে জিম্মি। 

তবে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ছাত্রলীগের নেতারা। তারা বলছেন, গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হয় না। সেখানে সিনিয়রদের সঙ্গে জুনিয়রদের বন্ধন তৈরি করা হয় এবং নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। 

মেহেদী হাসান শান্ত

বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গেস্টরুম হচ্ছে সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধন। এখান থেকে সিনিয়র-জুনিয়রের বন্ধন তৈরি হয়। রাজনৈতিক, সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, এখানে গান হয়, পাঠচক্র হয়। দু-একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা অনেক সময় ঘটে যায়। অতি উৎসাহীরা এমন কর্মকাণ্ড করে ফেলে। এমন ঘটনা ঘটলে এদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। আমি সবসময় চাই হলে আমরা পরিবারের মতো থাকতে।’

একই হলের একই সংগঠনের সভাপতি মেহেদী হাসান শান্ত বলেন, ‘বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম-গেস্টরুম করছে। যারা করছে না তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হচ্ছে না। গেস্টরুমকে আমরা পরিবারের বন্ধন হিসেবে দেখি। আমাদের বঙ্গবন্ধু হলে গেস্টরুমে নির্যাতন হয়, অত্যাচার হয় এ ধরনের প্রমাণ নেই। আবু তালিবের সঙ্গে যেটা ঘটছে সেটা হয়তো ব্যক্তিগত পরিপ্রেক্ষিতে বা সিনিয়রের সঙ্গে জুনিয়রের বেয়াদবির কারণে হতে পারে। কিন্তু গেস্টরুমে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে বিষয়টি সঠিক নয়।’

নির্যাতনের কারণে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আবু তালিব যে অভিযোগ তুলেছেন, ২৫ জন ছাত্র হল ছেড়েছেন, তার কাছে কি প্রমাণ আছে? আমাদের হলে দ্বিতীয় বর্ষে এখনো ৬০ থেকে ৬৫ জন শিক্ষার্থী আছে। হল ছাত্রলীগ প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে এদের রাখে। কেউ যদি ইচ্ছে করে চলে যায়, তাকে কি আমি জোর করে হলে রাখব?’

ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২৪ ঘণ্টা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকে। ছাত্রলীগ তাদের গাইডলাইন দেয়। শিক্ষার্থীরা সুখ-দুঃখ সবকিছুই তাদের সঙ্গে শেয়ার করে। আমরা কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য অবশ্যই মর্মাহত।’ 

তিনি বলেন, ‘আমরা এ কারণেও মর্মাহত যে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা, ক্যান্টিনের খাবারের মান উন্নয়নে কাজ করা, সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম আয়োজনের মতো আমাদের ভালো কাজগুলো গণমাধ্যমে সেভাবে উঠে আসে না। গণমাধ্যমের দ্বিমুখী নীতি আমাদের হতাশ করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে যারা হলের পরিবেশ নষ্ট করবে, অ্যাকাডেমিক পরিবেশ নষ্ট করবে, ছাত্রলীগের সুনাম ক্ষুণ্ন করবে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। হল প্রশাসনকেও আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করছি।’

হল প্রশাসন বলছে, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অভিযোগ না পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই।

বঙ্গবন্ধু হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আকরাম হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অভিযোগ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। কেউ যদি অভিযোগ না করে সেক্ষেত্রে আমরা কী করব? সর্বশেষ ঘটনায় আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখব। আশা করি, এসব অভিযোগ কমে আসবে।’

এইচআর/আরএইচ