শীতলক্ষ্যায় বিশালাকৃতির ড্রেন দিয়ে রঙ ও দুর্গন্ধযুক্ত পানির ধারা

ভয়াবহ দূষণের কবলে পড়েছে এককালের স্রোতস্বিনী শীতলক্ষ্যা। নারায়ণগঞ্জের প্রাণ শীতলক্ষ্যা এখন মৃতপ্রায়। দূষণের মাত্রা এতটাই যে, পানির দুর্গন্ধের কারণে নদীর ধারে-কাছেও যাওয়া যায় না। শীতের আগেই নদীর পানি একেবারে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সেন্ট্রাল খেয়াঘাট-সংলগ্ন ওয়াকওয়ের নিচে বিশালাকৃতির ড্রেন দিয়ে রঙ ও দুর্গন্ধযুক্ত পানির ধারা সরাসরি শীতলক্ষ্যায় পড়ছে। একই সঙ্গে পলিথিন ও গৃহস্থালির বর্জ্যও পড়ছে। শীতলক্ষ্যার ওই এলাকাজুড়ে পানির রঙ কালো ও দুর্গন্ধ। আশপাশের মানুষ এ উৎকট গন্ধে সেখানে দাঁড়াতেও পারছিলেন না।

একটু এগিয়ে সেন্ট্রাল খেয়াঘাট থেকে টানবাজারের দিকে যেতে নজরে আসে আরও কয়েকটি ড্রেন। সেখানেও একই পন্থায় দূষিত পানি বের হচ্ছে। নদীতীর ঘেঁষে একটি নৌকায় করে সেন্ট্রাল খেয়াঘাট থেকে আরও একটু উত্তরে গেলে দেখা যায়, একের পর এক ড্রেনের মুখ। শহর ও শহরতলীর ড্রেনগুলো এসব মুখে যুক্ত। শহরের প্রায় সব এলাকার পানি শীতলক্ষ্যায় পড়ে।

শহরের খানপুর বরফকল মাঠ এলাকায় গিয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। সন্ধ্যার পর পাঁচটি মোটা পাইপের মাধ্যমে বিভিন্ন ডাইংয়ের দূষিত পানি নদীতে গিয়ে পড়ে। কারণ ডাইং কারখানাগুলো বর্জ্য ও দূষিত পানি ছেড়ে দেয়। এ ছাড়া অনেক ডাইং কারখানা বর্জ্য ফেলার পাইপগুলো পানির নিচ দিয়ে নিয়েছে; যাতে সেগুলো দৃশ্যমান না হয়। আরেকটু উত্তরে গেলে চোখে পড়ে পাঠানটুলী এলাকার আরও ভয়াবহ চিত্র।

ব্যবহারের অযোগ্য শীতলক্ষ্যার পানি

বরফকল ঘাটের নৌকার মাঝি সাইফুল বলেন, ‘দিনের বেলায় নাকে রুমাল চেপে নৌকা পারাপার করতে হয়। গন্ধে টিকা যায় না। আর সন্ধ্যার পর কালো পানি লাল হয়ে যায়। মনে হয় রক্তের বন্যা বইতে শুরু করেছে।’

শহরের ৫ নম্বর খেয়াঘাটের ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাঝি সুমন মিয়া বলেন, ‘ইঞ্জিনের পাখা ঘুরলে দুর্গন্ধ অনেক বেড়ে যায়। প্রায়ই পলিথিন পাখায় আটকে যায়।’

সিদ্ধিরগঞ্জের চিত্তরঞ্জন খেয়াঘাটের মাঝি সোলেমান মিয়া বলেন, ‘এখন কারখানা মালিকরা চালাক হয়ে গেছে। পাইপ এমনভাবে বসায় যেন কেউ দেখতে না পায়। কারখানাগুলো যখন বর্জ্যপানি ছাড়ে তখন নদীর তীরে বুদবুদ হয় এবং লাল ও কালো রঙের পানি বেরিয়ে আসতে থাকে। বিভিন্ন এলাকার লোকজনও নদীতীরে বর্জ্য ফেলছে। আর সেগুলো ধীরে ধীরে নদীতে গিয়ে পড়ছে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ও আশপাশে কমপক্ষে ৫ শতাধিক শিল্প কারখানা রয়েছে। এ ছাড়া দূরবর্তী অনেক কারখানার পানিও ড্রেনের মাধ্যমে নদীতে ফেলা হচ্ছে। কারখানার বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই নদীতে পড়ে।

এলাকার প্রবীণরা জানায়, আগে এ নদীতে মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করতেন অনেকে। কিন্তু ১৫-২০ বছর ধরে কেউই নদীতে মাছ ধরে না। নদীর যে অবস্থা তাতে মাছ থাকা অসম্ভব।

পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ জোনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, অনেক কারখানার ইটিপি প্ল্যান্ট আছে। জরিমানা বা প্রশাসনিক ঝামেলা এড়াতে ইটিপি প্ল্যান্ট তৈরি করলেও সেটা ব্যবহার করে না। কারণ মালিকদের দাবি, এটা ব্যবহার করলে প্রতিদিন মোটা অংকের টাকা খরচ হয়। খরচ বাঁচাতেই বিকল্প পাইপ দিয়ে অনেক ডাইং ও শিল্প কারখানার কেমিক্যালযুক্ত পানি সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। আর রাতে এ কাজটি বেশি করায় সহজেই তাদের ধরা যাচ্ছে না।

পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ জোনের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত এক বছরে নদীদূষণের অভিযোগে বহু কারখানাকে প্রায় কোটি টাকার মতো জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু লোকবল সংকটে সব সময় পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া ঢাকার অফিস থেকে অভিযানগুলো পরিচালনা করা হয়। সেখানেই কারখানা মালিকদের তলব করে শুনানি হয়। অনেকে উচ্চ আদালতে মামলা করেও দখল-দূষণ অব্যাহত রেখেছেন।

এমএসআর