কিশোরগঞ্জে বিস্তীর্ণ হাওরের বুকে কৃষি আবাদ করেন জিরাতিরা (কৃষক)। বছরের অর্ধেক সময়ের জন্য তাদের সেখানে থাকতে হয়। এ জন্য সেখানে ছাপরা ঘর নির্মাণ করে বসবাস করেন তারা। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাথায় নিয়ে এভাবে ঝুঁকি নিয়ে সোনালি ফসল আবাদ করে যাচ্ছেন এসব কৃষিসৈনিক।

স্থানীয়ভাবে এসব কৃষককে বলা হয় ‘জিরাতি’। হাওরে এখন চারদিকে সবুজের সমারোহ। চারদিকে বোরো ধানের আবাদ। সেই সবুজগালিচায় স্বপ্ন বুনছেন এসব জিরাতি। বংশপরম্পরায় ফসল উৎপাদনে তারা অবদান রাখলেও তাদের জীবনযাপনের খবর রাখে না কেউ।

জানা গেছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বৃহত্তর হাওরাঞ্চলের 'গেটওয়ে' হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর জনপদ ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের হাওরাঞ্চলের ফসলের মাঠে এই সময়টায় চোখে পড়ে ছোট ছোট এমন ছাপরা ঘর। বোরো মৌসুমে হাওরে ছোট ছাপরা ঘর বানিয়ে ছয় মাসের জন্য সংসার পাতেন জিরাতিরা। আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে গাছপালা কিংবা ছায়া নেই।

যাদের বাড়ি হাওর থেকে অনেক দূরে, তারাই এসব ঘর বানিয়ে হাওরে বোরো ধান আবাদ করেন তারা। এ তিনটি হাওর উপজেলায় কার্তিক থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে গলাঘরে বসবাস করেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা প্রায় ২৫ হাজার জিরাতি।

লোকালয় থেকে বহু দূরে অবস্থিত কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে অস্থায়ী ‘গলাঘর’ তৈরি করে বসবাস করছেন হাজার হাজার কৃষক। ‘জিরাতি’ নামে পরিচিত এসব কৃষক গবাদিপশুর সঙ্গে গাদাগাদি করে ঝড়-বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই কষ্টে বোনা ফসল ঘরে তুলতে দিনরাত পরিশ্রম করেন তারা।

হাওরে ধানক্ষেতের মাঝখানে চোখে পড়বে ছোট এসব ছাপরা ঘর। সামান্য উঁচু জমিতে তৈরি এসব অস্থায়ী ঘরে বাস করেন তারা। জীবনের ঝুঁকির নিয়ে বছরের অর্ধেকটা সময় জীবনকে তুচ্ছ করে মাঠে পড়ে থাকেন হাজার হাজার কৃষক। গবাদিপশুর সঙ্গে গাদাগাদি করে গলাঘরে রাত কাটান তারা। এসব মানুষের নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার টয়লেট কিংবা রাতে ঘুমানোর মতো জায়গা।

কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন হাওর ঘুরে দেখা গেছে, ছোট্ট ছাপরা ঘরে বসবাস করা জিরাতিরা ঘরের মাচায় স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ঘুমান। মাচার নিচেই রাখা হয় গবাদিপশু। চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বসবাস করা এসব মানুষের ভাগ্যে জোটে না পুষ্টিকর খাবার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মোটা ভাত আর মরিচ ভর্তা, পাল কিংবা পান্তা ভাত দিয়ে চলে খাবার। নেই বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা। পান করেন নদীর পানি। প্রকৃতির কাজ সারতে হয় ক্ষেতের আলে। আছে শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাতসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি।

সরকারি হিসাবে, গত তিন বছরে কিশোরগঞ্জ হাওর বজ্রপাতে ৩৯ জন কৃষকের মৃত্যু হয়েছে।

তবে সবকিছুকে তুচ্ছজ্ঞান করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সোনালি বোরো ধান ফলাতেই কৃষকরা বছরের অর্ধেকটা সময় পড়ে থাকেন হাওরে। নিজেদের ঘরবাড়ি, পরিবার, আত্মীয়স্বজন ফেলে কার্তিক মাসে তারা পাড়ি জমান হাওরে। জমি তৈরি করা, চারা রোপণ, সেচ, পরিচর্যা থেকে শুরু করে ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই শেষে নতুন সোনালি ফসল ধান সঙ্গে নিয়ে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বাড়ি ফেরেন তারা। আর ফলন ভালো হলে ভুলে যান ছয় মাসের দুঃখ-কষ্টের জীবন। আবারও স্বপ্ন দেখেন পরের বছর যাওয়ার।

বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ এভাবেই চলছে কৃষকদের জীবন। বাপ-দাদা থেকে শুরু করে এভাবেই চালাচ্ছেন নিজেদের কৃষিকাজ। নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন যে কৃষিসৈনিকরা, অথচ তাদের খবর নেয় না কেউ। তাদের কৃষি উৎপাদন সময়কালে জীবনমান উন্নয়ন কিংবা সামান্য পানীয় জল আর স্যানিটেশন নিশ্চিত করা হলে দেশের তরে আরও অবদান রাখতে পারবেন তারা।

করিমগঞ্জ থেকে ইটনা হাওরে চাষ করতে আসা কৃষক হাফিজ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বোরো ধান চাষ করে তো আয়-উন্নতি হয় না। এরপর নদী ভেঙে জমি চলে যাচ্ছে। জমি টিকিয়ে রাখার উপায় নেই। ছয় মাস এখানে জিরাত (চাষ) করি। বাড়িতে গিয়ে পরিবারের খরচ শেষে এখন ঋণ পরিশোধে আছি। কৃষিকাজ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছি। আবার ডিজেল ও সারের দাম বেড়ে গেছে। এখন তো আমাদের কঠিন অবাস্থা দাঁড়িয়েছে।

তাড়াইল থেকে আসা দুই ভাই দুলাল মিয়া ও রিপন মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, জিরাতির জীবন অনেক কষ্টের জীবন। পরিবারকে বাড়িতে রেখে ছয় মাস এখানে কষ্ট করে থাকতে হয়। রাতে ঘুমাতে হয় গরু-ছাগলের সঙ্গে। খাবার পানির সমস্যা, নেই টয়লেট। অনেক সময় নদীর পানি খেয়ে অনেকের অসুখ হয়। আমার যে এত কষ্ট করে হাওরে বোরো ধান চাষ করি, আমাদের খবর নেয় না কেউ। সরকার যদি আমাদের পাশে দাঁড়াত, তাইলে এখানে থেকে ফসল চাষ করতে আরও সুবিধা হতো।

কৃষক রজব আলী জানান, দেশের অনেক জায়গা থেকে বোরো ধান চাষ করতে হাওরে মানুষ আসে। ছয় মাস হাওরে থেকে ঝড়-বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই কষ্টে বোনা ফসল ঘরে তোলে। অনেক সময় দেখা যায় শিলা বৃষ্টি বা বন্যার কারণে ফসল ঘরেও তোলা হয়ে ওঠে না। আবার অনেক সময় জমিতে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে অনেকের মৃত্যু হয়।

রাষ্ট্রপতির বড় ছেলে কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই দুর্যোগ থেকে তাদের কীভাবে রক্ষা করা যায়, এ নিয়ে আমারও উদ্বিগ্ন। হাওরের মাঝখানে পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থাও নেই। তারা তা অস্থায়ীভাবে করে নেয়। পাশাপাশি খাবার পানির সংকট। যে জমিতে সেচ দেয়, সেই ডিপ টিউবওয়েলের পানিই তাদের ভরসা।

তিনি আরও বলেন, বজ্রপাতের বিষয়টি হাওরে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ বিষয়ে আমার সরকারের সঙ্গে কথা বলেছি। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাওরে টাওয়ার করে লাইটনিং এরেস্টার লাগাবে। পাশাপাশি ঝড় থেকে রক্ষার জন্য হাওরে সরকার স্থাপনা করার উদ্যোগ নেবে।

এনএ