মৃত্যুর অনেক, অনেক কাছ থেকে বেঁচে ফেরা এক পুলিশ কনস্টেবলের চোখে মানবিক হিরো গাইবান্ধার পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম। অসুস্থ-অসহায়দের জন্য তিনি যেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। ২৩ বছর বয়সী পুলিশ সদস্য ইউনুসের দুটি কিডটিই নষ্ট হয়ে যখন জীবন প্রদ্বীপ নিভু নিভু, অজানা শঙ্কায় আঁধারেই ঢেকে যাচ্ছিল পরিবারে আলো, কিডনি প্রতিস্থাপনে ১৬ লাখ টাকার প্রয়োজনে তার চিকিৎসা হয়ে পড়ে অনিশ্চিত, জীবন বাঁচাতে মমতাময়ী মায়ের একটি কিডনি পেয়েও যখন আর্থিক সংকটে চিকিৎসা শুরু করা যাইনি ইউনুসের। ঠিক তখনই অলিখিত অভিভাবক হয়ে মৃতপ্রায় ইউনুসের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসেন পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম। 

চিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থা করেন তিনি। ঈশ্বরের কৃপা, মায়ের একটি কিডনি আর পুলিশ সুপারের দূরদর্শী উদ্যোগ ও মানবিকতায় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায় পুলিশ সদস্য ইউনুস। রক্ষা পায় একটি পরিবার। স্বপ্ন দেখার সুযোগ পায় তার দেড় বছরের একমাত্র সন্তান রাহাত আলী।

সুস্থ হয়ে তার মায়ের জন্য দোয়া চেয়ে ও পুলিশ সুপারের দীর্ঘায়ু কামনা করে "এক মানবিক পুলিশ সুপারের গল্প" শিরোনামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) একটি পোস্ট দিয়েছেন পুলিশ সদস্য ইউনুস। ডিস্ট্রিক পুলিশ গাইবান্ধাকে ট্যাগ করা তার পোস্টটি পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-

এক মানবিক পুলিশ সুপারের গল্প
"আসসালামু আলাইকুম। মহান রাব্বুল আলামীন এর ইচ্ছায় আজ আপনাদের মাঝে ফিরে এসে কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছি আমি। দয়া করে একটু সময় নিয়ে আমার পুরো পোস্টটা পড়ার চেষ্টা করবেন। কেন না, আজ আমি বলতে যাচ্ছি এক "মানবিক পুলিশ সুপারের" গল্প। 

আমি কনস্টেবল/৪৩৫ ইউনুস আলী, জেলা পুলিশ গাইবান্ধা, এসএএফ শাখায় কর্মরত একজন পুলিশ সদস্য। গাইবান্ধা জেলায় কর্মরত সকল পুলিশ সদস্যই আপনারা আমাকে চেনেন। আমি গত ৮ এপ্রিল শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করলে গাইবান্ধা পুলিশ হাসপাতালে যাই। সেখানে কর্মরত মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট মো. রুবেল মিয়া আমাকে এসকেএস হাসপাতালে কয়েকটি ব্লাড টেস্ট করার জন্য লিখে দেন। আমি সেই অনুযায়ী এসকেএস হাসপাতালে ব্লাড টেস্ট করি। টেস্ট রিপোর্ট হাতে পেলে চিকিৎসককে দেখাই। চিকিৎসক আমার রিপোর্ট দেখে আমাকে জানায় যে, আমার দুটো কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে। 

সত্যি বলতে, খবরটা শোনার পর আমার দু চোখে অন্ধকার ও নিস্তব্ধতা নেমে এলো। নিস্তব্ধতার খানিক পড়ে ডাক্তারকে বললাম, এর চিকিৎসা কি....? ডাক্তার বললেন এর কোনো চিকিৎসা নেই ভালো করার। নরমাল জীবন কাটাতে গেলেও একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে এবং সেটা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই। আপনার কাছে বেশি সময় নেই। বললাম কত টাকা লাগতে পারে..? ডাক্তার একটু হিসাব করে বললেন, কম হলেও ১৬ লাখ টাকা তাও সেটা অপারেশন পর্যন্ত। এ বাইরেও সারাজীবন ওষুধ এবং চেক আপ করা লাগবে। কথাটা শোনার পর আমার শরীর পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল। কারণ আমার পুরো সম্পত্তি ও বসত ভিটা বিক্রি করলেও এতো টাকা ম্যানেজ করা সম্ভব ছিল না। 

পরবর্তীতে আমি দ্রুত পুলিশ হাসপাতাল গাইবান্ধায় রিপোর্ট করি। গাইবান্ধা জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম পিপিএম স্যার আমার বিষয়টি জানতে পারেন এবং গাইবান্ধা থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে দ্রুত রংপুর মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠালেন। সেখানকার চিকিৎসক প্রাথমিকভাবে ব্যয় বহুল  চিকিৎসায় "ডায়ালাইসিস" করার সিদ্ধান্ত নেন এবং আমার শরীরে প্রতিনিয়ত ডায়ালাইসিস করতে থাকেন। কিন্তু তাতেও সুস্থতা না আসায় দিন দিন আমার অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। অন্য দিকে নিজের জমানো টাকাও শেষ।  

রংপুরের চিকিৎসকরা দ্রুত কিডনি প্রতিস্থাপনের বিষয়টি বলতে থাকেন। চোখের সামনে এ অবস্থা সহ্য করতে না পেরে আমার গর্ভধারীনি মা আমাকে তার নিজের একটি কিডনি দিতে চায়। কিন্তু কিডনি দিয়ে কি করব, যদি চিকিৎসার টাকাই না থাকে। এক পর্যায়ে কোনো উপায় না পেয়ে চিকিৎসার জন্য আবাদি জমি ও বসতভিটা বিক্রির মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় আমার পরিবারের লোকজন। হঠাৎ একদিন পুলিশ সুপার স্যার আমার খবর নিতে আমায় ফোন দেন। আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে স্যারকে সব খুলে বললাম,  স্যার আমার কথা শুনে আমাকে চিকিৎসার জন্য টাকা যোগাড় করে দেওয়ার কথা বললেন। 

স্যারের কথা শুনে মনে হলো হয়তো আমি আবার পৃথিবীর আলো দেখে বাঁচতে পারব। এর কিছুদিন পর মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ও পুলিশ সুপার স্যারের দূরদর্শী উদ্যোগে গাইবান্ধার সব পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে আমার চিকিৎসার জন্য সাহায্যের টাকা উত্তোলন করা হয়। আপনাদের এ সাহায্য আমার নতুন জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই আমি ও আমার পরিবার গাইবান্ধা জেলার সকল পুলিশ সদস্যদের কাছে চির কৃতজ্ঞ। 

এ বিষয়ে আরেকজন ব্যক্তি অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়েছেন যার কথা না বললেই নয়, তিনি হচ্ছেন আমাদের জেলার সুযোগ্য আরও-১ স্যার মো. আব্দুর রশিদ। পুলিশ সুপার মহোদয়ের উদ্যোগে উত্তোলনকৃত ৬ লাখ ৪৭ হাজার টাকা, জেলা কল্যাণ থেকে ২৩ হাজার টাকা দেওয়া হয় আমাকে। এই টাকা দিয়ে আমি ঢাকান শ্যামলি সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করি।

এছাড়াও পুলিশ সুপার স্যার অপারেশনের ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন বিষয়ে ডাক্তারদের সঙ্গে নিজেই কথা বলা। ওষুধের ব্যবস্থাসহ প্রতিনিয়ত তার এতো মূল্যবান সময়ের মাঝেও আমার খোঁজখবর নিয়েছেন। যা আমার অনেক নিজের আত্মীয়-স্বজনও করেনি। চিকিৎসার মাঝ পথে টাকার প্রয়োজন জানতে পেরে পুলিশ সুপার স্যার আমাদের রেঞ্জ ডিআইজি, রংপুর মহোদয় বরাবর প্রতিটি জেলা থেকে আমার চিকিৎসার জন্য সাহায্যের আবেদন করেন এবং এতে করে বিভিন্ন সময়ে মোট প্রায় দুই লাখ টাকা পাই। সব কিছুর মধ্য দিয়ে আমার একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। 

কিডনি প্রতিস্থাপনের পর ছোট খাটো আরো অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আমাকে। সর্বোপরি প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্যারের অবদান কখনোই ভুলবার নয়। বর্তমানে আমি অনেকটাই সুস্থ। বলতে গেলে এভাবে একটা কিডনি দিয়েই কোনো রকম নরমাল জীবন যাপন করে করতে হবে। আমার এই বিপদে স্যারকে পেয়েছি আমি বড় ভাই ও অলিখিত অভিভাবকের মতোই। স্যারকে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা  দিয়ে ছোট করতে চাই না। স্যারের জন্য আমার মা এবং আমার পুরো পরিবার দোয়া করে এবং করবেন আজীবন। বাংলাদেশ পুলিশে প্রতিটি ইউনিটে মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, পিপিএম স্যারের মতো মানবিক পুলিশ সুপার থাকলে শত বিপদেও আশার আলো ও নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখবে প্রতিটি পুলিশ পরিবার।

সর্বপরি স্যারের সর্বদা মঙ্গল কামনা ও গাইবান্ধা জেলায় কর্মরত আমার সকল সহকর্মীদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আপনারা আমার ও আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন। বেঁচে থাকুক আমার ও আমার পরিবারের স্বপ্নগুলো। বাবাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখুক আমার দেড় বছরের ছেলেটি। এভাবেই বেঁচে থাকুক মানবতা। মহান সৃষ্টিকর্তা দীর্ঘজীবি করুন মানবিক পুলিশ সুপার মহোদয় মুহাম্মদ তৌহিদুল আলম পিপিএম স্যারকে...আমিন।

কনস্টেবল ইউনুস আলী রংপুরের পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের সওদাগরপাড়া গ্রামের মো.আব্দুর রশিদের ছেলে। ২০১৭ সালের ৮ মে তিনি পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মায়ের দেওয়া একটি কিডনি তার দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়। ২০২০ সালের শুরুর দিকে গাইবান্ধায় বদলি হয়ে আসেন তিনি।

জানতে চাইলে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, পুলিশ সদস্য ইউনুসের বিষয়টি ছিল খুব বেদনার। আমি যখন জানতে পারলাম তার দুটি কিডনিই ড্যামেজ (নষ্ট) হয়ে গেছে। তখন একজন পুলিশ সুপার হিসেবে তার পাশে থাকা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যায়। আমি আমার দায়িত্বপালন করেছি মাত্র। এসময় জেলা পুলিশের সকল সদস্যসহ ইউনুসের যে কোনো সংকটে পাশে থাকার কথা জানিয়ে ইউনুস ও তার মায়ের সুস্থতা কামনা করেন তিনি।

রিপন আকন্দ/এমএএস