দেশে তাঁতপল্লি হিসেবে পরিচিত যমুনাপাড়ের জেলা সিরাজগঞ্জ। এ জেলার তাঁত পণ্য দিয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। কিন্তু চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় অধিকাংশ তাঁত কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে উৎপাদন কমেছে অর্ধেকেরও বেশি।

কারখানার মালিকরা ডিজেল-চালিত জেনারেটরের সাহায্যে কারখানা সচল রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ডিজেলের দাম বাড়ায় কারখানা সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে থ্রি-পিস, লুঙ্গি, শাড়ি ও গামছা তৈরিতে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে।

জানা যায়, জেলার ৯টি উপজেলায় প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার তাঁত রয়েছে। এই তাঁত কারখানায় সুতা তৈরি, সুতায় রং দেওয়া, সুতা শুকানো ও কাপড় উৎপাদনের জন্য প্রতি তাঁতে ২ থেকে ৩ জন শ্রমিকের প্রয়োজন। এতে মালিক ও শ্রমিক মিলে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

জেলার উৎপাদিত থ্রি-পিস, গামছা, লুঙ্গি ও শাড়ি দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি হয়। সপ্তাহে দুদিন উল্লাপাড়া, বেলকুচি, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর ও পাঁচিল বাজারে কাপড়ের হাট বসে। এই হাটে জেলাসহ বিভিন্ন স্থানের পাইকারিরা আসেন। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এই কাপড় বিদেশেও রপ্তানি হয়। কিন্তু তাঁতপল্লি হিসেবে পরিচিত জেলায় চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় অধিকাংশ তাঁত কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। 

লোডশেডিংয়ের কারণে আগে যেখানে ১০ জন শ্রমিক কাজ করতেন, বর্তমানে সেখানে তিনজন শ্রমিক কাজ করছেন। এতে উৎপাদন কম হচ্ছে। আবার যতটুকু উৎপাদিত হচ্ছে, সেগুলো মূল্যবৃদ্ধির কারণে হাটবাজারে বিক্রি হচ্ছে না। যে কারণে বাধ্য হয়ে অনেকে তাঁত কারখানা বন্ধ রাখছেন।

শাহজাদপুরের দারিয়াপুর এলাকার শাড়ি তৈরির শ্রমিক জুবায়ের হোসেন জানান, দিনে তিন-চারটি শাড়ি তৈরি করা যেত। লোডশেডিংয়ের কারণে এখন সারা দিনে দুটি শাড়ি তৈরি করা যায় না।

বেলকুচির মুকন্দগাতী গ্রামের তাঁতশ্রমিক, সুমন, আসলাম ও পলাশ সরকার বলেন, আগে একজন শ্রমিক সপ্তাহে তিন-চার হাজার টাকার কাজ করত। এখন এক থেকে দেড় হাজার টাকার কাজ করা হচ্ছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণে দিনে ও রাতে বেকার বসে থাকতে হচ্ছে।

চন্দনগাঁতি গ্রামের পাওয়ারলুম শ্রমিক আব্দুস সাত্তার জানান, প্রায় ২০ বছর ধরে তাঁতকলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে সাতজনের সংসার চালাচ্ছি। কাজ যতই কম থাকুক না কেন, প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে দুই থেকে তিন হাজার টাকা কামাই করতাম। বর্তমানে কারেন্টের সমস্যা থাকায় ঠিকমতো উৎপাদন হচ্ছে না। এতে কামাইও কমে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিবার নিয়ে বিপদে পড়ে যাব।

রায়গঞ্জের বহ্মগাছা গ্রামের তাঁতশ্রমিক রহিজ উদ্দিন বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে কারেন্ট জ্বালাতন শুরু করেছে। যে কারণে আমাদের কাজ কাম কমে গেছে। এভাবে যদি কারেন্ট জ্বালায়, তাহলে আমাদের আয় কমে যাবে। আর যদি কমে যায়, তাহলে সংসার চালাব কেমন করে? এ নিয়ে চিন্তায় রয়েছি।

বেলকুচির রায় প্রডাক্টসের মালিক রিপন সাহা বলেন, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালু রাখা হতো। হঠাৎ তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় জেনারেটরও চালানো যাচ্ছে না। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা জেনারেটর চালু রাখলে পাঁচ থেকে সাত লিটার তেল প্রয়োজন। এই কয়েক ঘণ্টার জন্য এক হাজার টাকা খরচ হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় অনেক।

সদর উপজেলার সয়দাবাদ এলাকার বিসমিল্লাহ সুতাঘরের মালিক বিদ্যুৎ সরকার বলেন, একদিকে লোডশেডিং, অন্যদিকে সুতার মূল্যবৃদ্ধি। এতে তাঁতিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। ৫০ কাউন্টের ১ বস্তা সুতা ১ বছর আগেও ছিল ১৪ হাজার ৫০০ টাকা, এখন তা ২২ হাজার ২০০ টাকা। ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

সিরাজগঞ্জ বড় বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক শফিকুল ইসলাম জিন্না বলেন, বিদ্যুৎ বিল ও জেনারেটরও চালাতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। তাঁতমালিকদের গুনতে হচ্ছে লোকসান। বর্তমানে এই শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। জেলার তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশ পাওয়ারলুম অ্যান্ড হ্যান্ডলুম অনার্স অ্যাসেসিয়েশনের সভাপতি বদিউজ্জামান বলেন, লোডশেডিং ও তেলের দাম বাড়ার কারণে অধিকাংশ সময় কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকছে। শ্রমিকরাও কাজ করতে পারছেন না। নতুন করে তেলের দাম বাড়ায় সুতার দামও বেড়েছে। আর যতটুকু কাপড় তৈরি করা হচ্ছে, তা বিক্রি করা যাচ্ছে না। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে মালিকদের।

তিনি আরও বলেন, জেলায় প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার তাঁতকল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি যন্ত্র বন্ধ রয়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে শ্রমিকরাও বেকার হয়ে যাচ্ছেন। তারা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। সবকিছু মিলিয়ে কারখানা চালানো যাচ্ছে না। তাঁত-মালিকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। আর তাঁতের ব্যবসা টিকে না থাকলে জেলার লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাবে। তাই সরকার ব্যবসায়ীদের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

সিরাজগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার রমেন্দ্র চন্দ্র রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে সারা দেশেই লোডশেডিং। তাই আমাদের দিক থেকে তেমন কিছু করার নেই। তবে তাঁতশিল্পে উৎপন্ন স্বাভাবিক রাখতে তাদের এখন লোডশেডিংয়ের সময়ে বিকল্প ব্যবস্থা বেছে নিতে হবে।

চাহিদার তুলনায় অনেক কম বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সিরাজগঞ্জ জেলার জন্য দিনের বেলায় দরকার হয় ৬০ থেকে ৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আর আমরা সেখানে পাই ৪০ থেকে ৪৫ মেগাওয়াট। এ ছাড়া রাতের জন্য প্রয়োজন হয় ১০০ থেকে ১০৫ মেগাওয়াট, সেখানে আমরা পাচ্ছি ৭০ থেকে ৭৫ মেগাওয়াট। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এনএ