স্কুলছাত্র তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী

নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর স্কুলছাত্র তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী হত্যার আট বছর পূর্ণ হতে চললেও মামলার কূলকিনারা হয়নি। এখনও ত্বকী হত্যা মামলার চার্জশিট দিতে পারেনি মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব। অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তকে অনেকটা থমকে দিয়েছে বলে অভিযোগ সচেতন মহলের।  

নিহত ত্বকীর বাবা ও মামলার বাদী রফিউর রাব্বির দাবি- তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব মামলার খসড়া চার্জশিট প্রকাশ করলেও সরকারের প্রভাবে মূল চার্জশিট দিচ্ছে না। 

আর তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব বলছে, আইনের ভাষায় খসড়া চার্জশিট বলে কোনো শব্দ নেই। খুব শিগগিরই মামলাটির তদন্ত কাজ শেষ করা হবে। 

অভিযোগ রয়েছে, শুরুর দিকেই প্রশ্নবিদ্ধ তদন্তের কারণে এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত অপরাধীরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। বিশেষ করে এই মামলার দুইজন আসামির আদালতে দেওয়া দুই ধরনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি মামলাটিকে অনেক বেশি জটিল করে তুলেছে। 

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকে নিখোঁজ হয় ত্বকী। এ ঘটনায় রফিউর রাব্বি রাতেই নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করেন- তার ও তার ছেলের কোনো শত্রু নেই। একদিন পর ৮ মার্চ সকালে ত্বকীর মরদেহ পাওয়া যায় শহরের শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদীনি এলাকায়। ৮ মার্চ রাতে ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বাদী হয়ে সদর থানায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। 

মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধ আন্দোলন করায় কোনো মহল আক্রোশবশত তার ছেলেকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও প্রথমে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী সর্বপ্রথম এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ওসমান পরিবারকে দায়ী করেন। মামলা দায়েরের ১০ দিনের মাথায় রফিউর রাব্বি পুলিশ সুপারকে লিখিত আকারে দেয়া একটি অবগতিপত্রে অভিযোগ করেন, এমপি শামীম ওসমানসহ কয়েকজন ত্বকীর কিলিং মিশনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন। 

এরপর শামীম ওসমান সংবাদ সম্মেলন করে প্রমাণ দেন তিনি হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে দেশের বাইরে ছিলেন।  রফিউর রাব্বি পরবর্তীতে তার বক্তব্য থেকে সরে এসে দাবি করেন- আমি কখনোই বলিনি শামীম ওসমান ও তার ছেলে সক্রিয় থেকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। ২০১৩ সালের ২০ জুন রফিউর রাব্বির আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলার তদন্তভার র‌্যাবকে দেওয়া হয়। 

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, তদন্তে নতুন ক্লু হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। সেটি হচ্ছে ত্বকীর পায়ে থাকা স্যান্ডেল ও পকেটে থাকা ত্বকীর ব্যবহৃত মোবাইল সেট। 

ত্বকীর মরদেহের সঙ্গে পাওয়া মোবাইল ও সেন্ডেল

হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার দুই আসামির জবানবন্দিতে জানা গেছে, ত্বকীর মরদেহ পাওয়ার স্থান থেকে কমপক্ষে তিন কিলোমিটার দূরে ত্বকীকে নির্যাতনের পর হত্যা করে মরদেহ বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু মরদেহ উদ্ধারের সময় সেটি বস্তাবন্দি ছিল না কিংবা এখনও পর্যন্ত ঘটনাস্থলে কোনো বস্তা পাওয়া যায়নি। আবার ত্বকীর স্যান্ডেল জোড়া তার দুই পায়ে পরানো অবস্থায় ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে নির্যাতনের পর মরদেহ বস্তায় ভরে পানিতে ডুবিয়ে দেওয়ার পরও ত্বকীর পায়ে স্যান্ডেল আর পকেটে মোবাইল থাকা সম্ভব কি-না। এ বিষয়টি তদন্তে সংশ্লিষ্টদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। 

অপরদিকে এ হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামি সুলতান শওকত ভ্রমরের দেয়া জবানবন্দি অনুয়ায়ী মামলার বাদী রফিউর রাব্বি দাবি করে আসছেন- ওসমান পরিবারের ছেলে আজমেরী ওসমানের অফিসে নির্যাতন চালিয়ে ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে। আজমেরী ওসমানের অফিস থেকে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে রক্তমাখা একটি প্যান্টও উদ্ধার করে। প্যান্টটি ত্বকীর ছিল এমন কথাও বলা হয়।  কিন্তু মরদেহ উদ্ধারের পর পুলিশের তৈরি করা সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মরদেহ উদ্ধারের সময়ই ত্বকীর পরনে জিন্স প্যান্ট ও শার্ট ছিল। তাছাড়া আসামি ভ্রমরের জবানবন্দি বারবার আমলে নিলেও বাদীপক্ষ অপর আসামি লিটনের জবানবন্দি কেন আমলে নিচ্ছে না, সেটিও তদন্তে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। 

দুই রকম জবানবন্দিতে মামলা জটিল

২০১৪ সালের ২৯ জুলাই ইউসুফ হোসেন লিটন নামে একজন আসামি সর্বপ্রথম এই মামলায় আদালতে জবানবন্দি দেন। লিটন সেখানে নিহত ত্বকী হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে স্বীকার করে সালেহ রহমান সীমান্ত নামে এক যুবকের বাড়িতে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন। সেখানে কোথাও ওসমান পরিবারের কোনো সদস্যের নাম ছিল না। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন র‌্যাবের হাতে আটক সুলতান শওকত ভ্রমর নামে অপর এক আসামি ওই বছরের ১২ নভেম্বর আদালতে জবানবন্দিতে জানান, ত্বকীকে আজমেরী ওসমানের অফিসে হত্যা করে মরদেহ বস্তাবন্দি অবস্থায় নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। দুই আসামির এমন দুই রকম জবানবন্দি র‌্যাবের তদন্ত কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। 

এ ব্যাপারে নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি অভিযোগ করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার চায় না ত্বকী হত্যার বিচার হোক। তাই বিচার হচ্ছে না। কারণ, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার জড়িত আছে। 

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ঢাকা বিভাগীয় সমন্বয়ক ও নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান মাসুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঘোষণা দিয়ে ত্বকী হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করেছেন। এর কারণ হচ্ছে সরকারের প্রভাবশালী পরিবারকে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। 

ত্বকী হত্যা মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ বাবু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ত্বকী হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে র‌্যাব ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে গ্রেফতার করলেও তাদের মধ্যে একজন কারাগারে এবং চারজনই উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছেন।

তবে বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন ধরণের মন্তব্য করেছেন নারায়ণগঞ্জ কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ ড. শিরিন বেগম। তিনি বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক যে মেধাবী একটি কিশোর খুন হয়েছে। আমরাও এই হত্যাকাণ্ডের বিচার অবশ্যই চাই। কিন্তু ভেবে দেখার বিষয় যে র‌্যাবের যারা তদন্ত করছিলেন তারা কারা। ৭ খুনের মত নৃশংস ঘটনায় যারা দণ্ডপ্রাপ্ত সেই কর্মকর্তাদের অধীনেই কিন্তু তদন্ত চলছিল। একই তদন্তকারী কর্মকর্তার তদন্তকালে দুই আসামির দুই ধরনের জবানবন্দিই প্রমাণ করে তদন্ত কতটুকু প্রশ্নবিদ্ধ। এ বিষয়গুলোও আমাদের ভেবে দেখা উচিত। 

জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মহসিন মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ত্বকীর বাবসহ ত্বকী মঞ্চের লোকজন বারবার ‘খসড়া চার্জশিট’ নিয়ে বক্তব্য দিয়ে আসছেন, বলছেন র‌্যাবের খসড়া চার্জশিটে অমুক আসামি তমুক আসামি রয়েছে। কিন্তু আইনের ভাষায় খসড়া চার্জশিট বলতে কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। আর র‌্যাব তদন্তকারী সংস্থা হয়ে কী করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়ার আগে সেটি বাদী বা মিডিয়ায় প্রকাশ করবে তাও আমার বোধগম্য নয়। বিষয়টি আদৌ সত্য কি-না তা নিয়ে সন্দিহান আমরা। তবে আমরাও চাই প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসুক। 

এ ব্যাপারে এমপি শামীম ওসমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে তদন্তাধীন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা আইনসম্মত নয়। ধৈর্য ধরে আছি, প্রকৃত সত্য একদিন প্রকাশ পাবেই।

তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, তদন্ত চলমান রয়েছে। জটিল মামলা, তাই সময় লাগছে। দৃশ্যমান না হলেও কাজ হচ্ছে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতনরাও তদারকি করছেন। সার্বক্ষণিক এ বিষয়ে তাদের জানানো হচ্ছে। 

তিনি বলেন, চার্জশিট দেওয়ার সময় সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব না। তবে কাজ চলছে। যখনই শেষ হবে, তখনই জমা দেওয়া হবে।

আরএআর