মঙ্গলবার এলেই হতদরিদ্রদের খোঁজেন জান্নাত
প্রতি মাসের নির্দিষ্ট তারিখে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়েন তিনি। সড়কে খুঁজে বের করেন সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিদের। তারপর গাড়ি থেকে খাবারের প্যাকেট নিয়ে বিলিয়ে দেন অসহায় ব্যক্তিদের হাতে। তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি খাবার দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর সেই খাবার বিলানোর অর্থ পুরোটাই আসে তার ব্যবসার লাভের অংশ থেকে।
নারী উদ্যোক্তা চৌধুরী জান্নাত রাখি। তিনি হোম কিচেন ও অনলাইনে কাপড়ের ব্যবসা করেন। সেই ব্যবসা থেকে যে লাভ আসে, তার পুরোটাই নিজে খাবার তৈরি করে বিলিয়ে দেন সুবিধাবঞ্চিতদের। প্রতি মাসের মতো মঙ্গলবার দুপুরেও তিনি খাবার নিয়ে সিলেট নগরের সড়কে সড়কে ঘুরে বেড়ান। সুবিধাবঞ্চিত যাকেই সামনে পান, তাদের মধ্যেই খাবার বিলিয়ে দেন।
বিজ্ঞাপন
২৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সিলেট নগরীর ওসমানী মেডিকেল রোড, বাগবাড়ি, মদিনা মার্কেট, আখালি, টুকের বাজার, সুবিধবাজার এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত প্রায় ৮৫ জনের মধ্যে খাবার বিতরণ করেন তিনি। এ সময় ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপ হয় জান্নাতের।
জান্নাত রাখি জানান, কাচ্চি বিরিয়ানি, চিকেন বিরিয়ানি, বিফ খিচুড়ি, জামতলা, কমলাভোগ মিষ্টিসহ নানা ধরনের খাবার ঘরে তৈরি করে বিক্রি করেন তিনি। তার হোম কিচেন শপ ম্যাজিক্যাল ফুড থেকে এসব খাবার ডেলিভারি দিয়ে থাকেন। আর এই খাবার বিক্রির একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ লভ্যাংশ তিনি ব্যয় করে থাকেন সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের সেবায়।
বিজ্ঞাপন
এ ছাড়া জান্নাতি রাখি সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় সহায়তা করে থাকেন। হতদরিদ্রদের কারও ঘর করার সময় দিয়ে থাকেন ঢেউটিন। নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে অসহায়দের সহযোগিতা করেন কাপড়চোপড় দিয়ে।
তিনি জানান, প্রতি মাসের লভ্যাংশ দিয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন। কোনো মাসে ৫০ প্যাকেট, কোনো মাসে ১০০ প্যাকেট। তার পুরোটা নির্ভর করে লাভের অংশের ওপরে। সিলেট শহরের এবং শহরতলির বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের খুঁজে বের করে খাবার বিতরণ করেন রাখি।
সিলেট নগরীর নবাবরোড এলাকায় পিডিবি কোয়ার্টারে স্বামী-সন্তানসহ বসবাস করেন চৌধুরী জান্নাত রাখি। স্বামী প্রকৌশলী শামচ ই আরেফিনের চাকরির সুবাদে সিলেট এসেছেন তিনি। নিজের পরিচিতি, আত্মনির্ভরশীল ও ভালো কিছু করার তাগিদে তিনি শুরু করেন হোম কিচেন ও অনলাইনে কাপড়ের ব্যবসা।
চৌধুরী জান্নাত রাখি মনে করেন, প্রত্যেক নারীর নিজস্ব পরিচিতি থাকা উচিত। নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়া উচিত। পাশাপাশি দেশ ও সমাজের ভালোর জন্য কিছু করার দায়বদ্ধতা থাকা দরকার প্রত্যেক মানুষের। তাই তিনি এই ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার লভ্যাংশ দিয়ে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন রাখি।
নবীন এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, আমি মনে করি নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন। তাই আমি হোম কিচেন ও অনলাইনে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করি। আমি চাইলে ঘরে বসে শুধু গৃহস্থালির কাজ করে সময় কাটাতে পারতাম। স্বামীর টাকা দিয়ে আয়েশ করার সুযোগও আছে আমার। কিন্তু তা করিনি। আমার মনে হয়েছে, আমাকে স্বাবলম্বী হতে হবে। সেই তাড়না থেকে আমার এই উদ্যোগ।
প্রত্যেক মানুষেরই দেশ ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। আমারও আছে। তাই আমি আমার ব্যবসার লভ্যাংশ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিই। প্রতি মাসের সেই লভ্যাংশ থেকে আমি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের খাবারের জন্য একটা ইভেন্ট করি। যে মাসে যতটুকু লাভ হয়, সেই লাভের একাংশ দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করি, বলেন রাখি।
এ ব্যাপারে তার স্বামী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেট ডিবিশন-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী শামছ ই আরেফিন বলেন, প্রত্যেক নারীর এমন স্বাবলম্বী হওয়ার চিন্তাভাবনা থাকা উচিত। তা ছাড়া রাখি বরাবরই সামাজিক কাজ করতে অনেক পছন্দ করেন। মানুষকে সাহায্য করা তার একটা নেশা। তার ব্যবসার লভ্যাংশ ব্যবহার করে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য যে খাবারের ইভেন্ট শুরু করেছেন, সেটাতেও মাঝেমধ্যে কন্ট্রিবিউট করার চেষ্টা করি।
সিলেট জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক নিবাস রঞ্জন দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি তার লাভের পুরো অংশটাই সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেন, তাহলে স্বভাবতই বোঝা যায় তিনি বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি বিশাল মনের মানুষ। তার বিষয়ে তেমন কিছুই বলার থাকে না, তার কাছে নিজেকে ছোট মনে হয়। আমরা অভিনন্দন জানাই তাকে। তার এই কাজ প্রশংসার দাবিদার। তাকে আমরা উৎসাহ দিই। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সুবিধা করার সুযোগ থাকে, তাহলে আমরা করব।
এনএ