একটা সময় যশোরের গৌরব ছিল মণিহার। এ প্রেক্ষাগৃহ ঘিরে সিনেমাপ্রেমীদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে গত দশকে প্রেক্ষাগৃহমুখী দর্শকের সংখ্যা কমেছে নানা কারণে। এই ব্যর্থতার দায় শুধু প্রেক্ষাগৃহের নয়, এটি দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের ভঙ্গুর অবস্থার বহিঃপ্রকাশ।

চলচ্চিত্রশিল্পের নানা সীমাবদ্ধতাকে মোকাবিলা করে টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে মণিহার। ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সমন্বিত সরকারি উদ্যোগও প্রয়োজন বলে মনে করছেন এ প্রেক্ষাগৃহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

জানা গেছে, ১৯৮২ সালে যশোরের সিনেমাপ্রেমী মানুষকে বিনোদন দিতে একটি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের ঘোষণা দেন তৎকালীন ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম। পত্রিকার মাধ্যমে ভালো একটি নামের আহ্বান করেন তিনি। পরে কয়েকশ নামের মধ্যে সিরাজুল ইসলাম মণিহার নামটি বাছাই করেন। যশোর শহরের সিটি কলেজ প্রাঙ্গণে চার বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রেক্ষাগৃহটি নির্মাণে সময় লাগে দেড় বছরের মতো।

এর আসন সংখ্যা ১ হাজার ৪৩০টি। এর নকশা করেন ঢাকার বিখ্যাত নকশাকার কাজী মোহাম্মদ হানিফ। দেশের স্বনামধন্য শিল্পী এস এম সুলতানের তত্ত্বাবধানে প্রেক্ষাগৃহের নির্মাণ-পরবর্তী সাজসজ্জার কাজ সম্পন্ন হয়। দেশের এই ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হলের বৈচিত্র্যময় ও আধুনিক নির্মাণশৈলীর কারণে এ প্রেক্ষাগৃহের সুনাম দেশজুড়ে।

চারতলা ভবনের প্রেক্ষাগৃহটি পুরোটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আছে র‌্যাম সিঁড়ি, ঝরনা, ঝাড়বাতিসহ সিনেমাজগতের বিভিন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীর ছবি। ভালোমানের সিনেমা প্রদর্শনের নীতিতেই ১৯৮৩ সালের ৮ ডিসেম্বর জনি সিনেমা প্রদর্শনের মাধ্যমে এ প্রেক্ষাগৃহ যাত্রা শুরু করে। নিয়মিত দর্শক ও ভালোমানের পরিবেশ থাকায় একসময় ঢাকার চলচ্চিত্রে এটি অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো।

উদ্বোধনের পর মণিহারে প্রথম প্রদর্শিত হয় দেওয়ান নজরুল পরিচালিত নায়ক সোহেল রানা ও নায়িকা সুচরিতা অভিনীত চলচ্চিত্র ‘জনি’। তারপর দেড় হাজারেরও বেশি ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রদর্শিত সিনেমা ১৯৮৯ সালের তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ অভিনীত ‘বেদের মেয়ে জোসনা’। টানা তিন মাস দিনে চারটি শো হাউসফুল থাকে। এ ছাড়া এই হলে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা সফল সিনেমার তালিকায় রয়েছে ‘মনপুরা’, ‘আয়নাবাজি’, ‘যদি একদিনের’ মতো সিনেমা।

১৯৮৩ সালের ৮ ডিসেম্বর ‘জনি’ সিনেমার প্রদর্শনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে সিনেমা হলটি, যা বর্তমানে বিশ্বসুন্দরী পর্যন্ত দেড় হাজারের মতো সিনেমা প্রদর্শিত হয়েছে। প্রতিদিন হলটিতে দুপুর সাড়ে ১২টা, বেলা সাড়ে ৩টা, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা, রাত সাড়ে ৯টাসহ ৪টি করে শো প্রদর্শিত হয়। ১৯৮৩ সাল থেকে মণিহার সিনেমা হলে নিচতলায় ৫ টাকা, ১০ টাকা টিকিটের দাম নির্ধারণ এবং দ্বিতীয় তলা ১৫ টাকা নির্ধারণ করে হল কর্তৃপক্ষ, যা বর্তমানে নিচতলা ৬০ ও ৭০ টাকা এবং দ্বিতীয় তলায় (এসি) ৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মণিহার সিনেমা হলটিতে সেলুলয়েডের ফিল্ম রিলের মাধ্যমে সিনেমা প্রদর্শিত হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে বর্তমান অবধি ‘ডিজিটাল সিনে সার্ভিস’ ডিজিটাল ফরম্যাটে উন্নত মানের লেজার প্রজেক্টের মাধ্যমে সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছে, যা সিনেপ্লেক্স বাদে অন্য কোথাও নেই।

ব্যবসার পাশাপাশি আর কী উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল সিনেমা হলটি, জানতে চাইলে মণিহার সিনেমা হলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম সিরাজুল ইসলামের ছেলে হলটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মিঠু ঢাকা পোস্টকে বলেন, মূলত আমার বাবা মরহুম সিরাজুল ইসলামের শৈপ্লিক মন থেকেই এই সিনেমা হল নির্মাণ করা। তা ছাড়া ব্যবসার পাশাপাশি যশোরের বুকে ঐতিহ্যবাহী কিছু করে যেত, যা তার সৃষ্টিকে মানুষ মনে রাখবে। এই দেশে ভালো মানের সিনেমা তৈরি হবে, যা এই সিনেমা হলে প্রদর্শিত হবে এবং যশোরের মানুষের বিনোদনের খোরাক মেটাবে। তার সেই ইচ্ছা থেকেই এই সিনেমা হল তৈরি করা। সিনেমা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে দেশে একপর্যায়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই মণিহার সিনেমা হলটি। যশোর শহরের সিটি কলেজ এলাকাকে বর্তমানে সবাই মণিহার নামেই চেনে।

তবে কালের বিবর্তনে মণিহার সিনেমা হল আমরা আগের মতো করে সাজিয়ে জৌলুশ রাখতে পারলেও সিনেমা প্রদর্শনের প্রাণ যে দর্শক, সেই দর্শকই নেই এখন আর। সে কারণে সিনেমা হলের ব্যবসার পাশাপাশি মণিহার রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল, কমিউনিটি হল ও মণিহার মার্কেট ব্যবসাও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সেগুলো পৈতৃক সূত্রে পারিবারিকভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে বলে বলেন তিনি।

প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে বর্তমান অবধি কত টাকা আয় হয়েছে সিনেমা প্রদর্শনের মাধ্যমে, জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে তিনি বলেন, একসময় মানুষ সিনেমা দেখত। এখন মোবাইলে সিনেমা দেখা যায়। আগে কেউ ঘুরতে গেলে সিনেমা হলগুলেতেই যেত। বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কারণে বর্তমানে দর্শক কমে গেছে বলে দাবি তার। তবে, ভালো সিনেমা বানালে দর্শক আসেন সিনেমা হলটিতে।

মণিহার সিনেমা হলের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে জিয়াউল ইসলাম জানান, অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় সিনেমা হলটি আজ ৩৭ বছরে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৮৩ সালের ৮ ডিসেম্বর হলটি উদ্বোধন হওয়ার পর নিয়মিত বিভিন্ন সিনেমা প্রদর্শন হলেও ২০১২ সালের ২২ জুলাই প্রথমবারের মতো মণিহার সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যায়। এলাকায় সন্ত্রাসীদের হামলা ও চাঁদাবাজির জন্যই সিনেমা হলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ২০ দিন পর প্রশাসন নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে এবং কর্মচারীদের দুর্দশার কথা বিবেচনায় সিনেমা হলটি পুনরায় চালু করা হয়। যদিও হলটির অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। সম্প্রতি হলটির অর্থনৈতিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে।

ভালো মানের সিনেমা না আসায় মণিহার দর্শকখরায় ভুগছে জানিয়ে জিয়াউল বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন সিনেমা হল বন্ধ থাকায় গত ১৬ অক্টোবর হলটি খোলা হয়। নতুন কোনো সিসেমা না এলে বা ভালো মানের সিনেমা না হলে হলটি চালিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। প্রতিদিন মণিহার সিনেমা হলে বিদ্যুৎ, কর্মচারীসহ খরচ ২০ থেকে ২২ হাজার টাকার মতো। কিন্তু প্রতিদিন তো ২০ থেকে ২২ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। আবার করোনার কারণেও আমাদের খরচ বেড়ে গিয়েছে। প্রতিদিন করোনা স্বাস্থ্যবিধি মানতে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসামগ্রী বিতরণ করতে হচ্ছে। আসলেই আমরা এভাবে কত দিন টিকে থাকতে পারব জানি না।

তিনি আরও বলেন, সামনে হলগুলো অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে কি না, সেটার মধ্যে ভয়ে রয়েছি। আগে তো যে পরিমাণ টিকিট বিক্রি করেছি, তার খরচ বাদ দিয়েও ভালো অঙ্কের মুনাফা দাঁড়াত। বর্তমানে এগুলো সম্ভব হচ্ছে না। কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিলসহ নানা খরচও উঠছে না। এমনও সময় যায় ঠিকমতো বিদ্যুৎ বিলও দিতে পারছি না। সব মিলিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছি। সম্পূর্ণ খোলা রাখতে হলে সরকারি সহায়তা ছাড়া কোনো উপায় নেই বলে জানান তিনি। ভালো মানের ছবি যদি এ দেশে নির্মাণ না করতে পারে, তাহলে সরকারকে আমদানি করেই সিনেমা হলকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তা ছাড়া কোনোমতেই সিনেমা হলকে বাঁচানো সম্ভব নয়।

মণিহার সিনেমা হলের প্রধান পরিচালক শফিউদ্দীন মিন্টু ঢাকা পোস্টকে জানান, সিনেমা হলটি প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আমি এই হলের সঙ্গে জড়িত। ১৯৮৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সেলুলয়েডের ফিল্ম রিলের মাধ্যমে বহু ছবি চালিয়েছি। ২০১২ সাল থেকে এই পর্যন্ত ডিজিটাল ফরমেটে ছবি প্রদর্শিত করছি। আমার এই কর্মজীবনে মণিহার আমার রক্তে মিশে আছে। অন্য কোনো কাজ করতেও মন চায় না। মনও বসে না। প্রতিষ্ঠাকালীন আমরা এই হলে ৭০ জন কর্মচারী ছিলাম। তার মধ্যে ১০ জন মারা গেছেন। বর্তমানে আমরা ২৫ জন শ্রমিক এই হলে কাজ করছি।

মণিহার সিনেমা হলের স্মৃতিচারণা করে শফিউদ্দীন বলেন, আগে নতুন ছবির ফিল্ম আসা নিয়ে চিন্তা করা লাগত। ফিল্ম এলে সেই ফিল্ম আমার গুছিয়ে চাকা আকারে বানাতে হতো। মেশিনে ছবি প্রদর্শিত করার সময়ে একজন করে সব সময় সর্বদা দাঁড়িয়ে থাকতে লাগত। আগে শারীরিক খাটুনিও ছিল। এর মধ্যেই কাজ করে আমারা চঞ্চলতা অনুভব করতাম। আর এখন চারজনের কাজ একজনে করি। তারপরও অলস সময় পার করতে হয়। এখন কম্পিউটারে সব কাজ করতে হয়। সব অন করে দিয়ে বাইরে চলে যাই। হাফ টাইম হওয়ার আগে চলে আসি।

বিভিন্ন হল বন্ধ হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, ছবির গুণগত মান ভালো নয়। যার জন্য দর্শক সিনেমা দেখতে যান না। আবার সিনেমা হলে খারাপ ছবি প্রদর্শিত হওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন হলে দর্শক কমে গেছে। মণিহার হলে চিত্রনায়িকা শাবনূর ছাড়া নায়করাজ রাজ্জাক, শাবানা, প্রবীর মিত্র, মান্না, শাকিব খান, রিয়াজসহ চিত্রাঙ্গনের সবাই এসেছেন। আগে নতুন কোনো সিনেমা এলে চিত্রাঙ্গনের বিভিন্ন শিল্পী আসতেন এখানে। বর্তমানে মণিহার নিয়ে অনেক স্মৃতি রয়েছে আমার।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ১০ বছর আগে যখন সিনেমা চালাতাম, প্রতিটি শোই দর্শকে ভরা থাকত। দর্শক বেশি থাকলে আমাদের মনে আনন্দ লাগত। লোকজন এখন সিনেমা দেখতে আসেন না। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই সময়ের সিনেমার কাহিনি ভালো না। আগে সিনেমা কাহিনিনির্ভর ছিল। রাজ্জাক-শাবানার আমলে কোনো কান্নার দৃশ্য হলে অনেকেই হলে কেঁদে দিয়েছেন। সর্বশেষ এই হলে ‘আয়নাবাজি’ ছাড়া কোনো ছবি দর্শক পায়নি বলে জানান তিনি। মণিহারে ১৯৮৩ সাল থেকে ৯৫ সাল পর্যন্ত সব সিনেমাই ব্যবসাসফল হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছিল ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবি।

সিনেমা হলের আরেক প্রবীণ কর্মচারী মোল্লা ফারুখ স্মৃতিকাতর হয়ে ঢাকা পোস্টকে জানান, মণিহারে ১ হাজার ৪৩০ সিট। আগে সিনেমার শো শুরু হলে সিনেমার শো হাউসফুল হয়ে বাইরে প্রায় আরও এক হাউসের দর্শক দাঁড়িয়ে থাকত। অনেকেই টিকিট না পেয়ে সিনেমা না দেখে চলে যেত। কিন্তু বর্তমানে এসব অতীত। আগে সব সামাজিক সিনেমাই ছিল বেশি। এখন অশ্লীলতার কারণে পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে আসেন না কেউ। তবে মানুষ হলমুখী হবেন না, এটা ভুল কথা। ভালো মানের সিনেমা নির্মিত হলে মানুষ সিনেমা হলে আসবে।

চিত্রনায়িকা শাবানার ‘ভাত দে’ সিনেমার সঙ্গে মণিহারের অনেক স্মৃতি রয়েছে বলে তিনি আরো বলেন, শাবানা মণিহার সিনেমা হলে ‘ভাত দে’ সিনেমাটি দেখেছিলেন। ছবি দেখে তিনি নিজেই সিনেমা হলে উচ্চ স্বরে কেঁদেছিলেন।

মণিহার সিনেমা হলের কর্মচারী আসলাম জানান, আগে ছবি মুক্তি পেলে শুক্রবার বসার জায়গা দিতে পারতাম না। প্রতিটি শো প্রায় হাউসফুল থাকত। বর্তমানে যে অবস্থা, আমাদের মণিহার সিনেমা হলে দর্শক তেমন হয় না। সিনেমা মুক্তি পেলে ২০ থেকে ২৫ জন দিয়ে শো শুরু করতে হয়। নাইট শো তো আবার ৫ থেকে ১০ জন নিয়ে শো চালাতে হয়। অনেক সময় নাইট শোই আবার বন্ধ হয়েও যায়। বর্তমানে মণিহার সিনেমা হলের অবস্থা খুবই খারাপ। তারপর আবার আমাদের দেশে ভালো মানের ছবিও তৈরি হয় না। বর্তমানে ‘বিশ্বসুন্দরী’ নামে একটি ভালো সিনেমা চলছে কিন্তু কোনো দর্শকই নেই। আগে নতুন সিনেমা দেখতে এলে সিনেমা হলে কোনো হাসির দৃশ্য হলে দর্শক সিনেমা হল উন্মাদ করে ফেলত। তবে সেই  উল্লাস আর উন্মাদনা এখন আর নেই।

হলের ম্যানেজার তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, পাঁচ বছর বা তার আগেও ভালো অবস্থা ছিল মণিহার সিনেমা হলের। বর্তমানে এখন খারাপ অবস্থার মধ্যে দিন পার করছে মণিহার। কম দর্শক, পাশাপাশি সিনেমাও ভালো মানের নয়। পুরোনো সিনেমা দিয়েই ছবি প্রদর্শিত করে যাচ্ছি। তার মধ্যে করোনার কারণে অনেকেই সিনেমা দেখতে আসছে না। ভালো মানের সিনেমা এলে দর্শক আসতে পারে। আগে নরমাল সময়ে ১ হাজার ৪৩০ সিটের মধ্যে ৫০০ থেকে ৬০০ করে টিকিট বিক্রি হতো। এখন ভালো মানের কোনো সিনেমা না হওয়ায় প্রতি শো টিকিট বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৫০টির মতো।

নিরাপত্তা প্রহরী সোহেল জানান, দীর্ঘদিন ধরে হল বন্ধ থাকায় বর্তমানে দর্শক নেই। যদি ভালো মানের কোনো সিনেমা মুক্তি পায়, তাহলে দর্শক আসবেন। এখনকার যে সিনেমা, সে কারণে দর্শক সিনেমা হলে এসে সিনেমা দেখতে আসেন না। ভালো মানের সিনেমা মুক্তি পেলেই দর্শক ফিরবেন বলে তিনি আশা করেন।

হলের টিকিট বিক্রেতা ওমর খোরশু টিটু জানান, আগের মতো দর্শক নেই। টিকিট বিক্রির সঙ্গে প্রায় ৩৭ বছর জড়িত রয়েছি। আগে প্রচুর দর্শক হতো। এখন সিনেমা ভালো হয় না বলে হলের দিকে দর্শক ফিরেও তাকায় না। আগে দর্শকদের দীর্ঘ লাইন থাকত। এখন আর তা নেই। সব সময় কাউন্টটার ফাঁকা থাকে।

শামীম আনোয়ার নামের আরেক কর্মচারী জানান, মণিহার সিনেমা হল একটি ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল। বর্তমানে ‘বিশ্বসুন্দরী’ সিনেমাটি চলছে। মোটামুটি ভালো চলছে। করোনাভাইরাসের পর ভালো সিনেমা এটি। যদি আরো ভালো সিনেমা আসে, তাহলে সিনেমা হলে দর্শক ফিরবে।

মণিহার সিনেমা হলের ক্যানটিন পরিচালক অরণ্য হোসেন জানান, মণিহার সিনেমা হলে আগে অনেক দর্শক আসত। সেই রকম বেচাকেনাও হতো। এখন সিনেমা হলে দর্শক নেই। তাই আমার বেচাকেনাও নেই।

মাগুরা থেকে আসা দর্শক সোহানুর রহমান জানান, যশোরের মণিহার সিনেমা হলের নামডাক অনেক শুনেছি। কিন্তু যশোরে এসে মণিহারে দেখলাম ভিন্ন চিত্র। মণিহার তার নির্মাণশৈলী ধরে রাখলেও কোনো দর্শক নেই। ছবি দেখতে এসে অনেক হতাশ হয়েছি।

ইমরান নামে এক দর্শক জানান, স্কুল বন্ধ থাকায় বন্ধুদের নিয়ে আমি প্রথম সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে এসেছি। তবে দর্শক নেই।

সিনেমা হল-সংলগ্ন ইলোরা স্টুডিওর মালিক বিধান চন্দ্র জানান, মণিহার আগে অনেকটাই দর্শকে ভরপুর ছিল। আগে অনেক দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসত সিনেমা দেখার জন্য। সিনেমা দেখার আগ্রহ ছিল। সিনেমাগুলো ছিল গল্পনির্ভর ও সামাজিক। পরিবার নিয়ে সবাই সিনেমা দেখতে আসত। বর্তমানে সেই পরিবেশ নেই। স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, আগে যে দর্শক পেত মণিহার, নিজেদের নিরাপত্তাকাজে নিয়োজিত লোকজন ছাড়া প্রশাসনের বাহিনী দিয়ে লোক সরাতে হতো। কেউ ব্ল্যাকেও টিকিট পেত না। এখন তো সারা দিন ২০০ লোকও হয় না। এ দিয়ে হল চলবে কী করে!

আরেক প্রবীণ ব্যবসায়ী তাজ ডিজিটাল স্টুডিওর মালিক শামসুউদ্দিন আহম্মেদ জুয়েল জানান, মণিহার নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। মণিহারের পাশেই একটি স্কুলে পড়তাম। স্কুল পালিয়ে মণিহারে সিনেমা দেখতে আসতাম। মণিহারের যে জৌলুশ ছিল, তার ছিটেফোঁটাও নেই এখন। আগে এত লোক আসত সিনেমা দেখতে যে মণিহার এলাকার মার্কেটগুলোতেও ভিড় লেগে যেত। যারা একবার যশোরে এসেছে, তারা মণিহারে সিনেমা না দেখে যশোর ছাড়েনি। বর্তমানে সিনেমা হলটির নাজুক অবস্থা। বলতে গেলে দিনে ১০০ লোকও হওয়া মুশকিল।

যশোরের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সুস্থধারার পরিচ্ছন্ন বিনোদনধর্মী বা কাহিনিনির্ভর সামাজিক ছবি নির্মাণ না করায় দর্শকরা সিনেমা হলে গিয়ে চরম হতাশা ও বিরক্তি নিয়ে ফিরে আসেন। ঘুরেফিরে একই ধরনের নকল ছবি প্রদর্শন করায় সিনেমা হল থেকে দূরে সরে গেছেন দর্শকরা। তা ছাড়া সিনেমা হলগুলোর পরিবেশেরও অবনতি হয়েছে। ভদ্র পরিবারের কেউ আর সিনেমা হলে যান না। সিনেমা হলের দর্শক এখন সমাজের খেটে খাওয়া নিম্নবিত্তের মানুষ। সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে।

এনএ