এত দিন আমার কেউ খোঁজখবর নেয়নি
শারীরিক প্রতিবন্ধী বিল্লাল হোসেন
১২ বছর আগে জমিতে কাজ করতে গিয়ে পায়ে সমস্যা দেখা দেয়। একপর্যায় জটিলতা বেশি হওয়ায় দুই পা কেটে ফেলতে হয় তার। আর সেই পঙ্গুত্বকে জয় করে এগিয়ে চলছেন বিল্লাল হোসেন। তিনি গড়ে তুলেছেন সবজি-বাগান। কারও দয়া কিংবা করুণা নয়, দুই পা হারানো বিল্লাল নিজের শ্রমে-ঘামে দুই বিঘা জমিতে চাষ করছেন নানা জাতের সবজি। বৃদ্ধ বয়সেও এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন ষাটোর্ধ্ব এই শারীরিক প্রতিবন্ধী।
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা পশ্চিম ইউনিয়নের মদনেরগাঁও এলাকার কৃষক বিল্লাল হোসেন। পরিবার-পরিজনের মুখে দুই বেলা খাবার জোগাতে সংগ্রাম শুরু করেন কৃষিকাজের মাধ্যমে। প্রথমে তিনি স্বল্প পরিসরে জমিতে নানা ধরনের শস্য আবাদ শুরু করেন। এখন দুই বিঘা জমিতে মৌসুমি নানা জাতের সবজিতে ভরে উঠেছে চারদিক।
বিজ্ঞাপন
বিল্লাল হোসেন অভাবের সংসারেই বড় হন। শিশু বয়সেই তিনি সংসারের চলনশক্তি হিসেবে কাজ শুরু করেন। সংসারজীবনে তিনি চার ছেলে ও এক মেয়ের জনক। দুই ছেলে জাকির গাজী ও হোসেন গাজী এলাকায় মটর মেকানিকের দোকানে কাজ করেন। অপর দুই ছেলে জাহাঙ্গীর গাজী ঢাকায় মাছ ব্যবসা ও আখের গাজী বিস্কুট কারখানায় কাজ করেন।
বিল্লাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি পেশায় একজন কৃষক। অনেক কষ্ট করে আজ জীবনের এই প্রান্তে এসেছি। ১২ বছর আগে কৃষিজমিতে কাজ করতে গিয়ে পায়ে সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমে বিষয়টি বুঝতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। ঢাকায় গিয়েও চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কুষ্ঠরোগের কারণে দুই পায়ে বেশি জটিলতা দেখা দেওয়ায় একপর্যায়ে তা কেটে ফেলতে হয়। এরপর থেকে পঙ্গুত্ব জীবন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। সংসারের অভাব দূর করতে অন্যের জমিতে বর্গাচাষ করছি।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, পরিবারের বোঝা না হয়ে নিজের ওপর ভর করে এগিয়ে যেতে চাই। বর্তমানে আমি দুই একর জমিতে নানা ধরনের শস্যের আবাদ করছি। শত প্রতিকূলতার মাঝেও নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখেন প্রতিবন্ধী বিল্লাল হোসেন।
তিনি বলেন, ফরিদগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। আমার হাতে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড তুলে দিয়েছে। যার অবদান সাংবাদিকদের। এত দিন আমার কেউ খোঁজখবর নেয়নি। কখনো ভাবিনি আমার জন্য কেউ এগিয়ে আসবে। এখন আমাকে সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড দেওয়া হয়েছে। আমি কৃতজ্ঞ। সরকারিভাবে আরও সহায়তা পেলে কৃষিকাজের মাধ্যমে আরও এগিয়ে যাব ইনশা আল্লাহ।
বিল্লাল হোসেনের স্ত্রী আমেনা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভাবের সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে পা হারানো স্বামী অনেক পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। অনেক কষ্ট করে বর্গাচাষে জমিতে ফসল ফলাচ্ছেন। তার কৃষিকাজের জন্য যদি সরকারি কোনো সহায়তা থাকত, তাহলে আরও ভালো হতো।
ছেলে জাকির হোসেন বলেন, ১২ বছর আগে জমিতে কাজ করতে গিয়ে বাবার পায়ে সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু পা দুটি রক্ষা হয়নি। এখন দুই পা ছাড়াই কৃষিকাজ করছেন। সংসারে বাবার পাশাপাশি আমরাও চেষ্টা করি বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে।
মদনেরগাঁও গ্রামের বাসিন্দা কাওসার মিজি বলেন, জমিতে কাজ করতে গিয়ে বিল্লালের পায়ে সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসা করাতে গিয়ে একপর্যায়ে দুই পা কেটে ফেলতে হয়। কিন্তু থেমে থাকেননি তিনি। কঠোর পরিশ্রম করে বর্গাচাষে জমিতে নানা ধরনের শস্য ফলাচ্ছেন তিনি।
একই এলাকার বাসিন্দা হাবিব মুন্সী বলেন, প্রতিবন্ধী বিল্লাল নিজের প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছেন। তাকে ভিক্ষাবৃত্তি বা কারও কাছে কখনো হাত পাততে দেখিনি। বিল্লাল নিজের প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছেন।
চাঁদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. জালাল উদ্দিন বলেন, আমরা কৃষিকাজে কৃষকদের সব ধরনের সহায়তা করে থাকি। শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবে বিল্লাল হোসেনকে ইতোমধ্যে ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। আমাদের কাছেও সহায়তা চাইলে সহযোগিতা করা হবে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিউলী হরি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমে আমাদের কাছে শারীরিক প্রতিবন্ধী বিল্লাল হোসেনের কোনো তথ্য ছিল না। পরবর্তী সময়ে আমরা খোঁজ নিয়ে তাকে উপজেলা সমাজসেবা থেকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড প্রদান করি। উপজেলা প্রশাসন সব সময় তার পাশে থাকবে।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অসীম চন্দ্র বনিক বলেন, দৃঢ় মনোবলে বিল্লাল হোসেন অনেক এগিয়ে গিয়েছেন। তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। সামনে এগিয়ে যেতে প্রয়োজনে সরকারিভাবে আরও সহায়তা করা হবে।
এনএ