মানসিক ভারসাম্যহীন জাহাঙ্গীর

জাহাঙ্গীরের হাতে লোহার শিকল আর আছিয়ার পায়ে লোহার শিকল। জাহাঙ্গীরকে গাছের সঙ্গে পশুর মতো বেঁধে রাখা হয়েছে। আর আছিয়াকে বেঁধে রাখা হয়েছে ঘরের পালার সঙ্গে। একই বৃত্তে বারবার ঘুরতে থাকেন ভাই-বোন। জাহাঙ্গীর উদাম শরীরে সারা দিন মাটিতে গড়াগড়ি করেন। মুখে রা নেই তার। ধারেকাছে কাউকে পেলে ইশারা-ইঙ্গিতে শিকলের বাঁধন খুলে দেওয়ার আর্তি জানান। আছিয়াও ছোট ভাইয়ের মতোই ধারেকাছে কাউকে পেলে ইশারা-ইঙ্গিতে শিকলের বাঁধন খুলে দেওয়ার আর্তি জানান।

নির্মম এ দৃশ্য দুটি যে কাউকেই ব্যথিত করবে। কিন্তু জাহাঙ্গীর ও আছিয়ার হতদরিদ্র পরিবারের পক্ষে এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। টাকার অভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন সন্তান দুটির  চিকিৎসা করাতে পারেননি দরিদ্র দিনমজুর ফজলু মিয়া (৬৮)। সন্তান দুটি যাতে হারিয়ে না যায়, সে কারণে শিকল দিয়ে তাকে বেঁধে রাখার চেষ্টা।

কিশোরগঞ্জ জেলা কটিয়াদী উপজেলার আচমিতা ইউনিয়নের গনেরগাঁও গ্রামে দিনমজুর ফজলু মিয়ার চার মেয়ে এক ছেলে। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ফজলু মিয়া। বয়সের ভারে এখন মজুরির কাজও করতে পারছেন না। কখনো বাড়ি আসেন, নয়তো কখনো অন্যের ঘরে রাত কাটান ফজলু মিয়া।

দারিদ্র্য ঘোচাতে ১৪ বছর বয়সে মেয়ে আছিয়া খাতুন (২৩) পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। বেশ ভালোই যাচ্ছিল সংসার। নিজের ভবিষ্যতের জন্য কিছু টাকা জমাও রাখতেন একজনের কাছে। দীর্ঘ পাঁচ বছরে বেশ টাকা জমা হয়। হঠাৎ করেই জমানো টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায় লোকটি। এরপর থেকে হারাতে থাকেন মানসিক ভারসাম্য। সম্ভব হয়নি চিকিৎসাও।

একমাত্র ছেলে জাহাঙ্গীর (১৮) পড়াশোনার পাশাপাশি শ্রমিকের কাজ করতেন। পরে মোবাইল ফোনে ভুল নম্বরে যোগাযোগ হয় এক মেয়ের সঙ্গে। তারপর শুরু হয় মনের দেওয়া-নেওয়া। একদিন মেয়েটি জাহাঙ্গীরকে ছেড়ে চলে যায়। এরপর তিনিও ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।

ঝড়, বৃষ্টি, রোদ আবার প্রচণ্ড শীত। দিন কিংবা রাত। কখনো দিনে একবার আবার কখনো না খেয়ে চলছে দিন। বসবাসের জন্য আছে একটি ভাঙা ঘর। সেই ঘরের সামনে দিনযাপন করছে এ পরিবারের মানসিক প্রতিবন্ধী ভাই-বোন জাহাঙ্গীর মিয়া ও আছিয়া খাতুন। কখনো ছড়া বলছে আছিয়া, কখনো চুপ করে বসে আছেন জাহাঙ্গীর।

মানসিক ভারসাম্যহীন আছিয়া খাতুন

দরিদ্র বাবার পক্ষে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। একসময় তার ‘পাগলামির’ মাত্রা বেড়ে যায়। কী আর করা। পায়ে শিকল পেঁচিয়ে তালা মেরে বেঁধে রাখেন গাছে বা ঘরের পালার সঙ্গে। এভাবেই চলছে তাদের দিন।

দিনমজুর ফজলু মিয়ার অভাবের সংসার। ছোট্ট একটি ভাঙা ঘরে একটি খাট ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। বাড়িতে ঢুকতেই দেখা যাবে গাছের সঙ্গে শিকল বেঁধে রাখা হয়েছে জাহাঙ্গীরকে। আর আছিয়া খাতুনকে শিকল দিয়ে ঘরের পালার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। মানুষ দেখলেই শিকল দেখিয়ে খুলে দেওয়ার ইশারা করে তারা।

জাহাঙ্গীর ও আছিয়া খাতুনের বাবা ফজলু মিয়া ঢাকা পোস্টকে জানান, ছেলে ও মেয়ে যদি নিজ ঘরের মালপত্র, খাবার ও অন্যের বাড়ির মালামাল নষ্ট করে বা যদি হারিয়ে যায়, তাই বাধ্য হয়ে শিকল দিয়ে তাদের বেঁধে রাখা হয়েছে। তিনি আরও জানান, শিকলে বাঁধা অবস্থায় তাদের মা তাদের খাইয়ে দেন। সন্ধ্যার পর ঘরে নিয়ে খাটের সঙ্গে বেঁধে রাখেন তাদের। অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই তারা আবোলতাবোল কথা বলে।

জাহাঙ্গীর ও আছিয়া খাতুনের বাবা ফজলু মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভাবের সংসারে ছেলে-মেয়ের চিকিৎসা করাইতে পারি নাই। মেয়েটা গার্মেন্টসে চাকরি করত। তার ভবিষ্যতের জন্য কিছু টাকা জমাও রাখত একজনের কাছে। পাঁচ বছরে বেশ টাকা জমা করে আছিয়া। হঠাৎ জমানো টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায় লোকটি। এরপর থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে সে।

তিনি বলেন, আমার একমাত্র ছেলে জাহাঙ্গীর পড়াশোনার পাশাপাশি শ্রমিকের কাজ করত। হঠাৎ মোবাইল ফোনে সম্পর্ক হয় এক মেয়ের সাথে। পরে প্রেম-ভালোবাসা হয়। মেয়েটি যেদিন তাকে ছেড়ে চলে গেল, তারপর থেকে সেও ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। হারাইয়া যাইতে পারে, এই ভয়ে তাদের শিকল দিয়া বাইন্দা রাখছি।

কটিয়াদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাকুর রহমান বলেন, আমি ঢাকা পোস্টের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারলাম। অর্থের অভাবে তাদের চিকিৎসা হচ্ছে না। তাই ভাই-বোন শিকলে বাঁধা অবস্থায় রয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। আমি ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করব।

এ বিষয়ে সমাজকর্মী রাজিব কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবেশী ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত তাদের চিকিৎসার জন্য। ভালো চিকিৎসায় হয়তো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে এ দুই ভাই-বোন।

কটিয়াদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. আকতারুন নেছা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি বিষয়টি জানতে পেরেছি। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে দেখব কীভাবে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়।

অর্থনৈতিক অনটন আর দুজন মানসিক প্রতিবন্ধী নিয়ে দিশেহারা পরিবারটি। হয়তো সামান্য চিকিৎসায় (ভাই-বোন) ফিরে পেতে পারে সুস্থ জীবন। সাহায্য পাঠাতে পারেন এই দুটি বিকাশ নম্বরে ০১৭১৬-৫৫০২২০ (সমাজকর্মী রাজীব) ও ০১৭২৩-৫৫৪৯৯৬ (সমাজকর্মী আল-আমীন মাস্টার) টাকা পাঠাতে পারেন।

এনএ