রাজশাহীতে বেড়েছে খেজুরের গুড় কেনাবেচা। সেই সঙ্গে বাড়ছে রস থেকে গুড় উৎপাদন। প্রতি বছর বাড়ছে খেজুরের গাছের সংখ্যাও। এমন অবস্থায় খেজুরের গুড় কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে জেলা-উপজেলাগুলোর অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে। রাজশাহীর ৯ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেজুরের গাছ রয়েছে পুঠিয়ায়। এরপর দুর্গাপুরে। এই দুই উপজেলায় গাছের সংখ্যা ও গুড় উপাদন বেশি বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলায় একটি গাছে বছরে ২০ কেজি খেজুরের রস হয়। তা থেকে ৮ কেজি খেজুরের গুড় হয়। এছাড়া ২০২২-২৩ মৌসুমের হিসেবে রাজশাহী জেলায় মোট খেজুরের গাছ রয়েছে ১১ লাখ ৮ হাজার ১৮টি। আবাদ হয়েছে ৫৪১ দশমিক ৩৭ হেক্টর জমিতে। এছাড়া মোট গুড়ের উৎপাদন ৮৮ লাখ ৬৪ হাজার ১৪৬ কেজি বা ৮ হাজার ৮৬৪ মেট্রিক টন। আর বিক্রি হবে ১৪১ কোটি ২০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। 

২০২১-২২ মৌসুমের হিসেবে রাজশাহী জেলায় মোট খেজুরের গাছ ছিল ১১ লাখ ৩২৩টি। আবাদ হয়েছে ৫৩৮ দশমিক ৩৭ হেক্টর জমিতে। এছাড়া মোট গুড় উৎপাদন হয়েছে ৮৮ লাখ ২ হাজার ৫৮৬ কেজি বা ৮ হাজার ৮০২ মেট্রিক টন। আর বিক্রি হয়েছে ৮৮ কোটি ২ লাখ টাকা। 

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, দেশজুড়ে যেমন রাজশাহীর আমের খ্যাতি আছে তেমনি এখানকার সুমিষ্ট খেজুর গুড় প্রসিদ্ধ। জেলার গাছিরা শীত মৌসুমে গাছ থেকে রস সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াজাত করে গুড় তৈরি করেন। উৎপাদনকৃত গুড়গুলো উপজেলার হাটগুলোতে কেনাবেচা হয়। সেখান থেকে পাইকাররা কিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাট-বাজারে বিক্রি করেন। সেই গুড় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রফতানি করা হয়। এতে জেলার পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘা উপজেলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে এখন চাঙাভাব বিরাজ করছে।

রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় খেজুর গাছের বাগান রয়েছে। সড়কে, পতিত জমি ও বাড়ির আঙিনায় খেজুর গাছ রয়েছে। শীতে এসব গাছ হয়ে ওঠে গাছিদের কর্মসংস্থানের উৎস। একজন গাছি প্রতিদিন ৪৫ থেকে ৫০টি খেজুর গাছের রস আহরণ করেন। তার আগে পরিচর্যা থেকে শুরু করে সবই গাছিকে করতে হয়। বিকেলে গাছে কোর (মাটির তৈরি হাড়ি) লাগিয়ে আসেন। আর সকালে রস ভর্তি কোর নামান গাছিরা। খেজুরের রস ও গুড় তৈরিকে কেন্দ্রে করে বছরের আড়াই থেকে তিন মাস ব্যস্ত থাকেন গাছিরা। প্রতি মৌসুমে খেজুর গাছের ওপর নির্ভর করে অনেকের জীবিকা।

কাটাখালীর হারিয়ান গ্রামের গাছি শমসের আলী। তিনি ২৬ থেকে ৩০ বছর ধরে খেজুরের গাছ লাগান। রস সংগ্রহ ছাড়াও তিনি গুড় তৈরি করেন। তার বেশির ভাগ খেজুরের গাছ এলাকাতেই। এছাড়া ১৫ থেকে ২০টি গাছ রয়েছে রাজশাহী চিনিকলের ইক্ষু ফার্মে।

গাছি শমসের আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার নিজের কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলো অন্য মানুষের গাছ। কেউ কেউ রস বিক্রি করেন। আবার কেউ রস ও গুড় খাওয়ার বিনিময়ে আমাকে গাছ দিয়ে রেখেছেন। আমার খেজুরের গুড় খাঁটি। কিনতে হলে এক সপ্তাহ আগে জানাতে হবে। না হলে দিতে পারবো না। 

তিনি জানান, প্রায় ১২০টি গাছের রস সংগ্রহ করেন। সে রসগুলো বাড়িতে জ্বাল করে প্রায় ২২ থেকে ২৫ কেজি গুড় তৈরি হয়। গুড় তৈরির জন্য জ্বালানি ও সামান্য কিছু কেমিকেলের খরচ বাদ দিলেও ভালো লাভ হয়। শুধু শীত মৌসুমে কাজ করলেও তার পুরো বছরের আয়-রোজগার হয়ে যায়। 

অন্যদিকে উপজেলাগুলোতে গুড় তৈরিতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও ভূমিকা থাকে। বেশির ভাগ বাড়িতে পুরুষ গাছ থেকে রস এনে দেওয়ার পরে অন্য কাজে চলে যান। এরপর রস জ্বাল করে তাক মতো নামান নারীরাই। তেমনি এক নারী সাইমা খাতুন (৩২)। 

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বামী ভ্যান চালান। ভোররাতে খেজুরের গাছ থেকে রস নামিয়ে বাড়িতে আনেন। এরপরে গোসল ও খাওয়া-দাওয়া করে কাজে বেড়িয়ে যান। তারপর রস ছাকনা দিয়ে ছাকা হয়। এরপর চুলার ওপরে কড়াইয়ে দেই। গুড় না হওয়া পর্যন্ত জ্বাল করি। গুড় হয়ে গেলে সেগুলো ছোট ছোট পাত্রে ঢেলে রাখি। শক্ত হলে সেগুলো আবার কাগজে মুড়িয়ে রেখে দেই বিক্রির জন্য।

 
পুঠিয়ার ঝলমলিয়া হাটে গুড় বিক্রেতা জয় বলেন, সপ্তাহের দুদিন এখানে হাট বসে। প্রতি হাটে প্রায় কোটি টাকার গুড় বেচাকেনা হয়। এই গুড় দেশের বিভিন্ন বড় বড় বাজারে পাইকাররা নিয়ে বিক্রি করেন। আমাদের রাজশাহীতে বিদেশে পাঠানোর মতো অর্ডার আসে না। তবে ঢাকার আড়ত থেকে গুড় কিনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভারত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা প্রবাসী বাঙালিদের কাছে খেজুর গুড় পাঠান। 

জানা গেছে, বাঘা ও আড়ানি পৌরসভা ছাড়াও বাজুবাঘা, গড়গড়ি, পাকুড়িয়া, মনিগ্রাম, বাউসা ও চকরাজাপুর, বানেশ্বর, পুঠিয়া, দুর্গাপুরের কানপাড়াহাট, মোহনপুরের ধোপাঘাটা হাটে হাটেও কম-বেশি গুড় বেচাকেনা হয়। এই হাটগুলোর ব্যবসায়ীরা পুঠিয়া ও দুর্গাপুরের হাটগুলো থেকে বেশি খেজুরের গুড় কেনাবেচা করেন।

কাটাখালী হাটের গুড় ব্যবসায়ী আশকের আলী ঢাকা পোস্টকে জানান, খেজুরের গুড় প্রতি কেজি ১৫০ টাকা। এছাড়া ভালো ও চিনিমুক্ত গুড় ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এখানে শুক্রবার ও সোমবার হাটের দিন। তিনি ছাড়াও আরও চারজন হাটে গুড় বিক্রি করেন। তারা পুঠিয়া, দুর্গাপরের বিভিন্ন এলাকা থেকে গুড় কিনে এই হাটে বিক্রি করেন। একেক জনের প্রতি হাটে দেড় থেকে দুই মণ গুড় বিক্রি হয়। 

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মেহদী হাসান ঢাকা পোস্টকে জানান, জেলায় প্রতি বছর খেজুরের গাছ ও রস থেকে গুড় উৎপাদন বাড়ছে। এ অঞ্চলের খেজুর গুড় খুবই সুস্বাদু। শীতের নানান খাবার তৈরিতে এর জুড়ি নেই। এজন্য রাজশাহীর গুড় দেশ-বিদেশে পাঠানো হয়। এবার গুড়ের ভালো দাম পাচ্ছেন গাছিরা। 

আরএআর