কলিমউল্লাহর দুর্নীতি : ৩৫ জনের সাক্ষ্য নিল তদন্ত দল
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় তদন্ত শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তদন্তে টানা ১০ ঘণ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ৩৫ জনের সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়েছে ইউজিসির তদন্ত দল।
তদন্তে উপাচার্য হওয়ার পর কর্মস্থলে অনুপস্থিত, লিয়াজোঁ অফিসে দুর্নীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক প্রশাসনিক ও একাডেমিক পদে থাকা, আইন অমান্য করে বিভাগীয় প্রধান নিয়োগ, জনবল নিয়োগে ইউজিসির নির্দেশনা উপেক্ষা, নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ তার স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে এ তদন্ত করে ইউজিসি।
বিজ্ঞাপন
প্রথম দিকে ৪৫টি অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করার কথা থাকলেও সরেজমিনে তারা ১১১টি অভিযোগ নিয়েই তদন্ত করার বিষয়টি নিশ্চিত করে কমিটি। এরমধ্যে উপাচার্যের বিভিন্ন সময়ের একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দের নেতৃত্বে তিন সদস্যের দল রোববার (১৪ মার্চ) বেলা পৌনে বারোটার দিকে বেরোবি ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছান। কমিটির অন্য দুজন হলেন- ইউজিসির সিনিয়র সহকারী সচিব ও তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব জামাল উদ্দিন এবং সদস্য প্রফেসর ড. আবু তাহের।
বিজ্ঞাপন
দুপুর ১টায় তদন্ত কাজ শুরু করে রাত ১০টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে কমিটির সদস্যরা অবস্থান করেন। এ সময় তারা সিন্ডিকেট কক্ষে বসে অভিযোগকারী সাত শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু হেনা মোস্তাফা কামাল, ভিসির ব্যক্তিগত সহকারী আমিনুর রহমানসহ ৩৫ জনের সঙ্গে কথা বলেন। তদন্ত চলাকালে ক্যাম্পাসে উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন না।
উপাচার্যের দুর্নীতির চিত্র যাতে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত না হয়, এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ শাখার সভাপতি তুষার কিবরিয়ার নেতৃত্বে রাত নয়টার দিকে প্রশাসনিক ভবনে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। পরে ইউজিসির তদন্ত কমিটির সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
এদিকে কমিটির প্রধান বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, আমরা সাত শিক্ষক ও কয়েকজন কর্মকর্তার বিভিন্ন সময়ে দেওয়া ১১১টি অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে এসেছি। উপাচার্যের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর দালিলিক প্রমাণাদিসহ সাক্ষী ও অভিযোগকারীদের সঙ্গে কথা বলেছি। অভিযোগের সবগুলো বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে অবস্থান না করার বিষয়টি প্রধান অভিযোগ। এছাড়া বিভিন্নজনের দায়িত্ব ভিসি একাই পালন করেন, ইচ্ছামতো নিয়োগ দেন— এ রকম অনেক অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আছে। এসব বিষয়ে তদন্তের স্বার্থে অভিযোগকারীদের ছাড়াও আর যাদের সাক্ষ্য নেওয়া দরকার তাদের নেওয়া হচ্ছে।
কমিটির প্রধান বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, তদন্ত কমিটি অনেক আগেই কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে অভিযোগের দালিলিক প্রমাণ দুই পক্ষের কাছ থেকে নিয়েছে। ক্যাম্পাসে সরেজমিনে প্রত্যেক অভিযোগকারী ও সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ করার পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে তথ্যপ্রমাণের কাগজপত্র নেওয়া হয়েছে।
তদন্ত শেষে উপাচার্যসহ অন্যদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলে জানান তদন্ত দলের প্রধান ড. বিশ্বজিৎ চন্দ।
অভিযোগকারী শিক্ষক ও কর্মকর্তারা জানান, শুধু ভিসি নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ নয়, অনিয়ম-দুর্নীতিতে তার সঙ্গে জড়িত চক্রকেও তদন্তের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
অধিকার সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ড. মতিউর রহমান বলেন, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষামন্ত্রী বরাবর ৪৫টি অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল। এরপর ২০২০ এবং সবশেষ চলতি বছরের জানুয়ারিতে সব মিলিয়ে ১১১ অভিযোগ লিখিতভাবে দাখিল করা হয়। এসব অভিযোগের দালিলিক প্রমাণ তদন্ত টিমের কাছে উপস্থাপন করেছি।
বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন, উপাচার্যের বিরুদ্ধে আনা শতাধিক অভিযোগের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা অমান্য করে ক্যাম্পাসে ধারাবাহিক অনুপস্থিতি, ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া, ইউজিসির নির্দেশনা অমান্য করে জনবল নিয়োগ, শিক্ষক ও জনবল নিয়োগে অনিয়ম, নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি হয়েও অনুপস্থিত থাকা।
তিনি আরও বলেন, আমরা প্রত্যেক অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত ও প্রমাণ করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তদন্ত দলকে দিয়েছে। আশা করছি, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে উপাচার্যের সব অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ প্রমাণিত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ শাখার সভাপতি তুষার কিবরিয়া বলেন, আমরা চাই সুষ্ঠু তদন্ত হোক। যাতে কোনো অন্যায়কারী ছাড় না পায়। শুধু উপাচার্যই নয়, তার সহযোগীদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
এদিকে শনিবার (১৩মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর দুর্নীতির ৭৯০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন অধিকার সুরক্ষা পরিষদ নেতারা বলছেন, এটি প্রথম খণ্ড। উপাচার্যের দুর্নীতিগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে।
আনীত অভিযোগের বিষয়ে জানতে উপাচার্য প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
সম্প্রতি বেরোবির শেখ হাসিনা হল ও ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ভবন এবং স্বাধীনতা স্মৃতি স্মারক নির্মাণকাজে উপাচার্যসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসির আরেকটি তদন্ত কমিটি। এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্প ছিল। ক্রয়-প্রক্রিয়া লঙ্ঘনসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে ওই কমিটি।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএসআর