‘সো আর বাট’ কইতি সগলে অজ্ঞান
১৯৫২ সালে মায়ের ভাষা ঠিক রাখতি জীবনডা দিছিল সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত, শফিউরসহ আরও ম্যালাজন। সেই আন্দোলনে যোগ দিছিল আমাগে খুলনার ছাত্র-ছাত্রীরাও। পুলিশের অত্যাচার চলবে না, আমাগে ভাষা বাংলা হতি হবে, এই রহম স্লোগান দিতি নাগলো আর কাপতি নাগলো রাস্তা-পথঘাট। আমাগে ভাষা বাংলা চাই। এই আন্দোলনে পুরুষগের পাশে দাঁড়াইল মাইয়েরাও।
মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা পোস্টের বিশেষ আয়োজন ‘এসো প্রাণের ভাষায় কথা বলি’ নিয়ে কথা কইলেন ভাষাসৈনিক মাজেদা আলী, খুলনার বিশিষ্ট দুই শিক্ষাবিদ মো. জাফর ইমাম ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান। ৭১ বছর আগের কথাগুলো তুইলে ধরে তারা কলো- এহোনের যে ভাবসাব বাংলা ভাষার ঠিকমতোন ব্যবহারডা হতিছে না। এহন সেইগুলো ঠিক করে রাহার চেষ্টা করা হয়নি। ‘সো আর বাট’ কইতি সগলে অজ্ঞান।
বিজ্ঞাপন
ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ভাষাসৈনিক মাজেদা আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা তো কিছু জানতাম না, তখন তো রেডিও-টেলিভিশন ছিল না। টেলিফোনও সবার বাড়িতে ছিল না। বৃহস্পতিবার ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালে রেলওয়ে স্কুলে চাকরি করতাম। স্কুলটা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ছিল। স্কুল থেকে ফিরে আসছি। তখন দেখি কলেজ গেটের সামনে কয়েকটা লোক দাঁড়ানো। তাদেরকে তখনো ভালো করে চিনি না। তখন কিন্তু বাহিরে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলার নিয়ম ছিল না। সেখানে বিএল কলেজের ছাত্র এম নুরুল ইসলাম, মালেক আতাহার আর গাজী শহীদুল্লাহ ছিলেন। তারা বললেন- জানেন আজকে ঢাকায় কী হয়েছে? কয়েকজন মারা গেছে ভাষার জন্য। বললেন- আপনাদের তো কিছু করতে হবে। আমি বললাম কী করবো আমরা? তারা বললেন- মিছিল বের করেন, প্রতিবাদ জানান। তখন আমরাতো মিছিল কীভাবে করে বুঝি না। মেয়েরা তো এত অ্যাডভান্স হয়নি। তখন মালেকা আতাহার নুরুল ইসলাম দাদু ভাইয়ের বোন কলেজে পড়তো।
আমরা মিছিল করব কাদের নিয়ে এমন প্রশ্নে তারা বললেন- মেয়েদের স্কুল মেয়েদের নিয়ে করবেন। তখন সুলতানা হামিদ আলী আর করোনেশন স্কুলটি মেয়েদের জন্য ছিল। তারা বললেন- আপনাদের বলে দেব কী করতে হবে, আগে সব গুছান। পরের দিন শুক্রবার আমরা গোছাতে থাকলাম। আমার একটা বান্ধবী ছিল রোকিয়া, তাকে সাথে নিলাম। আমাদের স্কুলের আয়ার কাছে গেটের চাবি থাকতো। সে থাকত মূল গেটের সামনে। পর দিন ভোর বেলা আমরা বুদ্ধি করলাম গেট কী করে খোলা যাবে। ছুটির দিন যাদের যাদের বাড়ি চিনি তাদের বাড়ি গিয়ে বললাম স্কুল ড্রেস পড়ো না, বই নিও না, আমাদের সাথে মিছিল করতে হবে। সহপাঠীদের নিয়ে সকাল ৮টার ভেতরে চলে যাবা। মেয়েরা সকলে মিলে দেবলা মাসির বাসায় গিয়ে বললাম ‘মাসি তুমি কাল স্কুলে যাবা না। তোমার খুব জ্বর হয়েছে বাসায় শুয়ে থাকবে। আর দারোয়ান বচন মিয়া চাবি চাইলে বলবা চাবি খুঁজে পাচ্ছি না।
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার সন্ধ্যায় আমাদের কাছে কিছু জিনিস দিয়ে গেলেন উনারা। কিছু গড়নের লাঠি, চাটাই, কাগজ আর কী লিখতে হবে তাই দিলেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই-সহ বিভিন্ন স্লোগান লিখতে হবে। রাতভর হোস্টেলে কাঠির মাথায় তুলা জড়িয়ে আলতা ও দোয়াত কালিতে ডুবিয়ে লেখা হলো। ময়দা কিনে এনে জাল দিয়ে সেগুলো চাটাইয়ে লাগানো হলো। লাঠির সঙ্গে সেগুলো বানলাম কিন্তু এতোগুলো জিনিস নিয়ে সকাল বেলা বের হবো কীভাবে। হোস্টেলের মেয়েদেরকে সব বোঝানো হলো। পেছনের দিকে ছোট্ট একটা দরজা ছিল। মেয়েদের ওই দরজা দিয়ে বের হতে বললাম। দেবলা মাসির কাছ থেকে চাবি ছিনিয়ে নিলাম।
তিনি আরও বলেন, আমরা সামনের দরজা দিয়ে বের হলাম। প্লাকার্ড হাতে নিয়ে আমরা যাচ্ছি। তখনকার সময়ে মিছিল করতো দুজন দুজন করে, রাস্তা জোড়া না। দুজন দুজন করে আমরা লাইন দিলাম। আমাদের সহযোগিতা করলো দন্ত চিকিৎসক অতুলেন্দ্রুনাথ দাসের বাড়ির স্কুল পড়ুয়া তিন মেয়ে খুকু, রত্না ও ঝঞ্ঝা। এরা বাড়ি থেকে চোঙা নিয়ে আসলো। মিছিলে যা বলা হবে সেটা তারা বলতে থাকলো আর অন্য মেয়েরা সেইভাবে চলতে লাগলো। আমরা সেখান থেকে পিকচার প্যালেস মোড় ঘুরে থানার মোড় হয়ে পার্ক ও পৌরসভার মোড় থেকে পোস্ট অফিসের রাস্তা ঘুরে আহসান আহমেদ রোডের মাথায় এসে মিটিং করলাম। রাস্তায় পুলিশ ছিল, কিন্তু তারা আমাদের কিছু বলেনি। ২৩ ফেব্রুয়ারি এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনে নারীদের প্রথম মিছিল।
এরপর জোহরের আজানের সময় চলে এলাম। আমরা ভাবলাম অনেক কিছু করেছি। পর দিন ভোর বেলায় কলেজের প্রিন্সিপাল অমূল্য ধন সিংহ স্কুলে চলে আসেন। আমাকে ডেকে পাঠান। আমারতো ভয়ে বুক কাঁপছিল। স্যার এতো সকালে আসলেন! তারপর সামনে গেছি, কিন্তু স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছি না। ভয় পাচ্ছি আর কি, এতো সকালে এসে স্যার আমাকে ডাকলেন কেন? স্যার আমাকে বললেন- ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তুমি যেটা করেছো, খুব ভালো কাজ করেছো। কিন্তু তুমি পুলিশের নজরে পড়ে গেছো। তুমি এখানে থাকবে না, কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকবে। গা ঢাকা তো বুঝি না। বললেন- তুমি কয়েকদিন এখানে থাকবে না, তোমার বাবার বাড়িতেও থাকবে না। অন্য কোথাও গোপনে থাকবে। কাউকে বলবে না তুমি কোথায় আছো।
স্যার বার বার বললেন ভয়ের কিছু নেই। আমি খুব চিন্তাই পড়ে গেলাম। আমি স্কুলে কাজ করতাম সেই স্কুলে একটি ছুটির দরখাস্ত দিলাম রিকশাওয়ালার কাছে। আমি তখন চলে গেলাম মুসলিম লীগের এক নেতার যশোরের বাড়িতে। তার স্ত্রী খাদিজা বেগম আমার পরিচিত। আর ওই বাড়ির নিচতলায় যশোরের আরেকজন ছিলেন কবি হাবিবুর রহমান সাহিত্যরত্ন। তিনি ছিলেন ডাক্তার মাহবুবুর রহমানের আব্বা, পরবর্তীকালে জেনেছি। করোনেশন স্কুলে চাকরি করতেন। উনি আমাকে দুদিন ডেকে নিয়েছিলেন। বই লিখতেন, চোখ নষ্ট, কষ্ট হয়। তাই বলতেন- তুমি একটু প্রুভ দেখে দিবা আমাকে বিকেলে বিকেলে। দুই-তিন দিন গেছি, প্রুভ দেখে দিয়ে আসছি। ওই থেকে চিনেছেন তারা আমাকে। ওই বাড়ির গৃহিণীকে বললাম- খালাম্মা আমার হোস্টেলে থাকার খুব অসুবিধা হচ্ছে। আমি কি একটু আপনার এখানে থাকতে পারবো? বললেন- তুমি থাকবা কোথায়? আমারতো সে রকম ঘর নেই। আমি বললাম কোনো এক জায়গায় থাকলেই হবে। বললেন- কয়দিন থাকবা? আমি বললাম দুই-তিন দিন থাকবো। তিনি বললেন- আমার তিন মেয়ে এক ঘরে থাকে সেখানে যদি তুমি জায়গা করে নিতে পারো তাহলে থাকো। আমি সেখানে গিয়ে থাকতে লাগলাম। শরীর খারাপ বলে থাকতে লাগলাম, বের হতাম না।
মাজেদা আলী আক্ষেপ করে বলেন, আমরা সেদিন যে প্রত্যাশা নিয়ে কাজ করেছিলাম, ভাবতাম যে আস্তে আস্তে সব কিছু হবে। যার ধারাবাহিকতায় ৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ হলো, সবই হলো। কিন্তু আমি লক্ষ্য করছি আমরা বাংলা ভাষাটাকে ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত করতে পারলাম না। বাংলা ভাষা নিয়ে কোনো গবেষণা বা কিছু হলো না। আমরা উর্দু নিব না ভালো কথা, কিন্তু বাংলা ভাষাটাকে সঠিকভাবে চর্চা করবো, কাজে ব্যবহার করবো। এখন কথায় কথায় সব দেখি তিন ভাগের একভাগ ইংরেজিতে কথা বলে ‘সো আর বাট’ বলতেই সবাই অজ্ঞান। এমনকি বেতারেও আমি শুনি যে তারা সঠিক বাংলা ব্যবহারটা করেন না, টেলিভিশনেও তাই দেখি।
খুলনার এই নারী ভাষাসৈনিক বলেন, দুঃখ লাগে যে আমরা বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার করতে পারলাম না। ঢাকাতে শুনেছি যে সেগুনবাগিচায় মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হয়েছে। সেখানে যে কী কাজ কর্ম হয় বা কী হয় না হয় তাও আমি সঠিকভাবে জানি না। এখনো বহু বই আমরা বাংলায় করতে পারিনি। যে শব্দগুলো কঠিন সেগুলোতে আমরা ইংরেজি রেখে দিয়েওতো বাংলা করতে পারতাম। বিজ্ঞানের, মেডিকেলের, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যেগুলো সেগুলো বাংলা করার চেষ্টাতো থাকতে হবে। গবেষণার জন্য কাজে লাগিয়ে দিলে কত কাজে দিত, কিন্তু সেগুলো কেউ নজর ও আমলে আনেন না। এটাই আমার দুঃখ লাগে।
৮৬ বছর বয়সী এই ভাষাসৈনিক বলেন, সততার খুব অভাব হয়ে গেছে। এটা খুব খারাপ লাগে। সততা নেই। আর পড়াশোনাও সঠিকভাবে তারা করে না। ফাঁকি দেয়। বিশেষ করে এক যুগ ধরে দেশের খারাপ অবস্থা চলছে। যার যা খুশি সে তাই করছে। পড়াশোনার মান নেমে গেছে অনেক। শিক্ষকরা ভালো করে না শেখালে কেমন করে হবে। কারণ ভালো করে শিখতে পারেনি তারা। এখানে তাদের গলদ রয়ে গেছে। আমার মনে হয় যারা শিক্ষক হবেন, তাদেরকে ভালো করে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। উচ্চারণ যদি সঠিকভাবে করতে না পারে তাহলে পিটিআই, বিএড পাস করে কি হবে। ব্যর্থ সৈনিক হবে।
খুলনার শিক্ষাবিদ মো. জাফর ইমাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভাষা আন্দোলনের সময়ে আমি জিলা স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। রাষ্ট্রভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হলো। এই আন্দোলনে খুলনায় নেতৃত্বে ছিলেন বিএল কলেজের ছাত্ররা। বিএল কলেজ থেকে ছাত্ররা শাটল ট্রেনে করে খুলনায় চলে আসতো। স্কুলে এসে তারা ছাত্রদেরকে আহ্বান জানাতো যোগদানের জন্য। আমিও যোগদান করেছি। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এই স্লোগান দিয়েছি।
তিনি বলেন, আমি ও আমার বড় ভাই মঞ্জুরুল ইমাম একসঙ্গে পড়তাম জিলা স্কুলে। তখন আমরা এইটুকু বুঝতে পেরেছি যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা আমাদের প্রাণের দাবি। বাংলাভাষায় কথা বলবো, বাংলা ভাষায় পরিচয় দিব, রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ভাষার প্রয়োগ করবো। এটা আমাদের সকলের কামনা। খুলনার কিছু ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। নুরুল ইসলাম, কেএম হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তারা ঢাকা থেকে এসে আন্দোলনকে বেগবান করতেন। এম নুরুল ইসলাম দাদু ভাই আন্দোলন করেছেন। মেয়েদের মধ্যেও কিন্তু একটা জাগরণ ছিল। রাজ্জাক আলীর স্ত্রী মাজেদা আপা তখন গার্লস কলেজের ছাত্রী ছিলেন। আন্দোলনটা প্রবীণরা যতোটা গ্রহণ করেছিল, তার থেকে অনেক বেশি নবীনরাই গ্রহণ করেছিল, নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং ছাত্ররাই এই আন্দোলনের সাথে ছিলেন।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গোলাগুলি হরো, তখন খবরের কাগজ সাথে সাথে আসতো না, সেই সময় টেলিভিশনও ছিল না। রেডিওতে কিছুটা ছিল, সেটাও সরকার নিয়ন্ত্রিত। যার ফলে প্রকৃত খবর আমরা পাচ্ছিলাম না। এই টুকু শোনা যাচ্ছিল যে ঢাকার রাজপথ রক্তে লাল হয়ে গেছে। তখন একদিন দেখি যে একটি প্লেন খুলনার আকাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর পোস্টার ছাড়ছে। পোস্টার আকাশ থেকে ভেসে ভেসে নিচে আসলে আমাদের আগে পাওয়ার একটা ঝোঁক ছিল। তখন আমরা ওর পেছনে দৌড়াতাম, সংগ্রহ করে পড়তাম। ওখানে দাবি করা ছিল যে সেরকম মারাত্মক কিছু না, সরকারের প্রচার এটি আরকি। প্রকৃতপক্ষে জিনিসটাকে আমরা মারাত্মকভাবে কিছু না মনে করি সেরকম একটা প্রচার সরকারের পক্ষ থেকে ছিল। `
শিক্ষাবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৭১ বছর আগের কথা। পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পরে রাষ্ট্রভাষা কী হবে- এটা নিয়ে ঢাকায় তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দিলেন যে উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা। তাৎক্ষণিকভাবেই ঢাকা থেকে শুরু করে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। তখন খুলনায় মাত্র একটাই কলেজ ছিল, বিএল কলেজ। আমি ১৯৫২ সালে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। বিএল কলেজের ছাত্ররা বিভিন্ন স্কুলে চলে গেল। আমি তখন বিকে স্কুলের ছাত্র। বিএল কলেজের ছাত্ররা এসে প্রথমে শিক্ষকদের সাথে কথা বললেন। তারা বললেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা হতে হবে, মায়ের ভাষা, বুকের ভাষা। তখন শিক্ষকরাও বললেন- এটা আমাদের প্রাণের দাবি। শিক্ষকরাও সমর্থন দিলেন। ছাত্রদের বললেন- তোমরাও এসো। বড় ভাইয়েরা বক্তৃতা দিলেন- তোমাদেরকে প্রতিবাদ করতে হবে। আমরা তখন খুব উৎফুল্ল।
আমার তখন ১০/ ১১ বছর বয়স। আমাদের নিয়ে তখন তারা রাস্তায় মিছিল করলেন। তখন কিন্তু একটা মিছিলে ডিসিপ্লিন ছিল। মিছিল হতো দুটো লাইনে। ছাত্ররা দুটো লাইনে দাঁড়াতো। এখনকার মতো জড়ো হয়ে যেত না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর আমরা প্রদক্ষিণ করতে লাগলাম। কয়েকদিন গেছি এ রকম। আর যেদিন গুলিতে ঢাকায় বরকত, সালাম, জব্বার শহীদ হয়ে গেল, তখনতো শোক। শোকের প্রতিবাদের একটি ভাষা কালো ব্যাজ। তারা আমাদের কালো ব্যাজ লাগিয়ে দিল। আমরা আনন্দের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য কালো ব্যাজ লাগাতাম। এখন যেমন কালো ব্যাজ বুকে লাগিয়ে দেওয়া হয়, তখন হাতে লাগিয়ে দেওয়া হতো।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মাজহারুল হান্নান বলেন, একদিনের কথা খুব মনে পড়ে শহীদ হাদিসপার্কের সামনে দিয়ে আমরা হেঁটে বাজারের দিকে যাচ্ছি। থানার মোড় হয়ে বড় ভাইয়েরা স্লোগান দিচ্ছে। বেশ কিছু পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, মিট মিট করে হাসছে। তাদেরও একটা মৌন সমর্থন ছিল। কারণ তারাও তো বাঙালি। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে এটা বলারতো অপেক্ষা রাখে না। তখনতো ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। কাউকে বলে দিতে হয়নি। ডাক দেওয়ার সাথে সাথে দেশের মানুষ একত্রিত হয়ে গিয়েছিল। পুলিশের দিকে তাকিয়ে আমরা হাত দেখিয়ে স্লোগান দিলাম- পুলিশের জুলুম চলবে না, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। পুলিশ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখলো। মিছিল করতে করতে আমরা সারা শহর প্রদক্ষিণ করলাম। বিএল কলেজের তৎকালীন নেতৃস্থানীয় যারা ছিলেন তারা আমাদের নিয়ে গেলেন। এরপরও কয়েকদিন সভা-সমাবেশ চলেছে। আমার ভালো লাগে যে আমরা স্লোগান দিয়ে রাষ্ট্রভাষার দাবি তুলতে পেরেছিলাম। এই অংশগ্রহণটা আজকে আমাকে খুব আনন্দ দেয় এবং উৎফুল্ল করে। আমাদের বিজয় হয়ে গেল।
তিনি বলেন, বিজয়ের পেছনের কারণ এই আন্দোলনে জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল। যে কোনো আন্দোলন, যে কোনো বিষয়ই যদি জনগণের দাবি না হয়, জনগণ যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে কোনো ব্যক্তি দিয়ে কিছু হয় না। এই বাংলাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সব কিছুতেই কিন্তু জনগণেরই কৃতিত্ব।
মাজহারুল হান্নান বলেন, আজকের দিনে যারা ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং আগামী প্রজন্ম ওই শিক্ষাকে সামনে রেখে প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত ও সত্যিকারে যেগুলো আমাদের জন্য হওয়া উচিত সেই লড়াইয়ে যেন তারা কোনো আপস না করে। এক্ষেত্রে যেন আমরা আমাদের দেশের অস্তিত্ব, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা স্বোচ্ছার থাকতে পারি। গণতন্ত্রকে যেন কেউ নস্যাৎ করতে না পারে, স্বাধীনতাকে যাতে নস্যাৎ করতে না পারে, দেশের মধ্যে দুর্নীতি যেন কেউ করতে না পারে- একুশের চেতনা কিন্তু আমাদের তাই শিখিয়েছে।
আরএআর