টাকা দিলেই সনদ দেয় তারা
নকল সনদ তৈরি করা হয় সায়েম স্টুডিওতে
জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রয়োজন জ্ঞান ও শিক্ষার। আর পেশাগত জীবনের প্রতিটি ধাপে পৌঁছাতে দরকার সনদ বা সার্টিফিকেটের। এসব স্বীকৃতি অর্জন করতে হয় লেখাপড়ার মাধ্যমে। অধ্যবসায় আর শ্রমের মাধ্যমে এসব অর্জন আবার সবার দ্বারা হয় না। কিন্তু তার জীবিকা নির্বাহ করার জন্য চাকরিও দরকার। তাই চাকরি বাগিয়ে নিতে অনেকেই অনৈতিকভাবে ঝুঁকে পড়েন নকল সনদের দিকে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সাভারের আশুলিয়ায় বিভিন্ন ছবি তোলার স্টুডিও তৈরি করছে জাল সনদ।
সাভার ও আশুলিয়া উৎপাদনমুখী শিল্পাঞ্চল। তাই এখানে অসংখ্য শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। অনেকেই এ অঞ্চলকে উপযুক্ত কর্মসংস্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। তবে যোগ্যতার সনদ না থাকায় অনেকেরই হাতছাড়া হয় চাকরি। বর্তমানে পোশাক কারখানায় চাকরি নিতে হলেও প্রয়োজন হয় সনদের। আর চাকরিপ্রার্থীদের এই চাহিদার জোগান দিতে গিয়ে ছবি তোলার পাশাপাশি নকল সনদ সরবরাহ করছেন স্টুডিও, কম্পোজ ও ফটোকপির দোকান-মালিকরা।
বিজ্ঞাপন
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাভারের অন্ধ মার্কেট, আশুলিয়ার জামগড়া, বাইপাইল, জিরানী বাজার ও পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার বিভিন্ন স্টুডিওতে তৈরি হচ্ছে নকল সনদ।
প্রযুক্তির উত্থানে ক্যামেরা মোবাইলের ব্যবহার বেড়ে গেছে। তাই স্টুডিওতে ছবির ব্যবসায় পড়েছে ভাটা। এ জন্য ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে স্টুডিও-মালিকরা চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করছেন এসব নকল সনদ। শুধু শিক্ষাগত সনদই নয়, জন্মসনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, নাগরিকত্ব সনদসহ নকল সব আইডি কার্ড তৈরি করছে দেদার।
বিজ্ঞাপন
আশুলিয়ার একটি কারখানায় চাকরি নেবেন জোবায়ের নামের এক চাকরিহারা পোশাকশ্রমিক। কাজের দক্ষতা থাকলেও সনদের অভাবে হচ্ছে না তার চাকরি। প্রতিষ্ঠান চায় এইচএসসি পাসের সনদ। তাই খোঁজ করছেন নকল সনদ তৈরির আস্তানা। পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে খোঁজ পেলেন সনদ বানানোর কারিগরের। ৫৫০ টাকায় মিলে গেল তার সনদ।
জোবায়েরের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, আগে আমি কয়েকটি কারখানায় কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবে কাজ করেছি। সর্বশেষ চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর সার্টিফিকেটের অভাবে আর চাকরি হচ্ছিল না। পরে আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারি নকল সার্টিফিকেট ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা হলেই পাওয়া যায়। ঠিকানা নিয়ে দোকানে গেলে প্রথমে আমাকে ফিরিয়ে দেয়। পরে ওই বন্ধুর রেফারেন্সে ৫৫০ টাকা দিয়ে নকল সার্টিফিকেট বানিয়ে নিই। তবে এখনো চাকরি হয়নি।
কারখানায় সনদের ফটোকপি চাওয়ায় চাকরির জন্য নাসরিনেরও প্রয়োজন একটি নকল সনদ ও একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের। চাহিদা অনুযায়ী তিনিও পেয়ে যান এ দুটি। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, এত সহজে সার্টিফিকেট ও পরিচয়পত্র পাব, তা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। এখন আমি এসব দিয়ে চাকরি করছি। সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র বানাতে তার খরচ হয়েছিল ১ হাজার ৩০০ টাকা। তবে তিনি বিষয়টি গোপন রাখার অনুরোধ জানান।
এদিকে এসব সনদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের একটি হলো ‘সাইম ডিজিটাল স্টুডিও’। নবীনগর চন্দ্রা মহাসড়কের সাভারের ডিইপিজেডের বিপরীতে হাশেম প্লাজা নামক মার্কেটের নিচতলায় এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারী ইমরান জানান, ১৫ হাজার টাকায় তিনি ওই স্টুডিও ও ফটোকপির দোকানে চাকরি করেন। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার বিনিময়ে প্রায় পাঁচ থেকে ছয়টি সনদ সফটওয়্যারের মাধ্যমে তৈরি করেন। তিনি সুযোগ ও ব্যক্তি বুঝে হাজার টাকাও গোনেন।
ভাদাইলের রফিকুল ডিজিটাল স্টুডিওর মালিক আল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা গরিব ও অশিক্ষিত মানুষের উপকার করে থাকি। তারা চাকরি ছাড়া অসহায় জীবন যাপন করে। আমরা শুধু গরিব মানুষকে এ ধরনের সার্টিফিকেট বানিয়ে দিই। এটা যে অনেক বড় অপরাধ, এখন বুঝতে পেরেছি। আর কোনো দিন বানাব না।
আরও কয়েকটি এ রকম স্টুডিও, ফটোকপি ও কম্পোজের দোকান অনুসন্ধানে জানা যায়, পোশাক কারখানা, নিরাপত্তাপ্রহরী এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিপ্রত্যাশীরাই তাদের প্রধান টার্গেট। তারা অষ্টম শ্রেণি থেকে উচ্চতর ডিগ্রির নকল সনদ তৈরি করে সরবরাহ করে আসছেন। তবে কোনো ধরনের রেফারেন্স কিংবা পরিচিত কারও সুপারিশ ছাড়া দেওয়া হয় না এসব সনদ। প্রথম যে কেউ এমন নকল সনদ নিতে চাইলে যেন তারা কিছুই জানেন না। পরিচিত ব্যক্তি হলেই মিলে যায় সনদ।
সচেতন মহল বলছেন, এই সুযোগে নকল সনদ তৈরি করে কারখানায় চাকরি নিয়ে গা ঢাকা দেন অনেক দাগী অপরাধী। সুযোগ বুঝে তারা অপরাধ করে যান। কোনো সময় কর্মস্থলেই অপরাধ করেও পালিয়ে গেলে তাদের খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর হয়ে ওঠে। এতে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর ও অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা এসব নকল সনদ দিয়ে চাকরির আবেদন করছেন, তারা সবাই রুটিরুজি নিয়ে একধরনের চাপে থাকেন। তারা চাপে পড়েই এ ধরনের কাজ করে থাকেন। কিন্তু যারা এ ধরনের নকল সনদ প্রস্তুত করে বাণিজ্য করছেন, তারা রুটিরুজির চাপে আছেন এমনটা না। এভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য একটি চক্র সক্রিয়। এর কারণ হচ্ছে, মানুষ এখন ভোগবাদী হয়ে উঠেছে। ফলে কীভাবে উপার্জন করছে, এটা বিষয় না, কত উপার্জন করছে, এটাই এখন বিষয়। এ জন্য অশিক্ষিত কিংবা সনদের অভাবে চাকরি হচ্ছে না, তাদের দায়ী না করে, যারা এই প্রক্রিয়া চালু করেছেন, তাদের দায়ী করেন তিনি।
শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য এ রকম একটি গর্হিত কাজ তারা বেছে নিয়েছে। এতে তারা নৈতিক ও আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। যাদের সম্পৃক্ত করছে, তার এই সম্পৃক্ততা একটি অনৈতিক সম্পৃক্ততা। তাদের এই উপলব্ধি থাকা উচিত, যারা এভাবে সনদ নিয়ে চাকরি করছেন, তারা ধর্মীয় কিংবা নৈতিক দিক থেকে গোটা জীবন অগ্রহণযোগ্য ও অনৈতিক একটা পন্থায় তাদের উপার্জন হচ্ছে বলে জানান তিনি।
যারা এভাবে উপার্জন করছেন, তাদের বিষয়ে এই অধ্যাপক বলেন, কী পরিমাণ উপার্জন হচ্ছে, এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যা উপার্জন হচ্ছে, সেটা সৎভাবে নাকি অন্যায়ভাবে হচ্ছে কি না, সেই নৈতিক দায়বদ্ধতা উপার্জনকারীর ওপরই বর্তায়। ফলে গোটা জীবন এবং তার ওপর যারা নির্ভরশীল, তাদের সবাইকে এ রকম একটি পাপকাজে সম্পৃক্ত থাকতে হবে, তা কতটা সঠিক তাদের ভাবতে হবে। আর চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো একটু সতর্ক হলেই এসব নকল সনদ সরবরাহ বন্ধ হবে বলে মনে হয়।
সাভার রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহফুজ পুলক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ ধরনের নকল সনদ তৈরির অপরাধ যদি আমাদের আওতায় থাকে, তাহলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মমিন উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি উপজেলা প্রশাসনকে বলব। ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে যদি প্রমাণ পায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
প্রসঙ্গত, গত ১১ ডিসেম্বর সাভারের জাতীয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সংস্থা মার্কেটের দ্বিতীয় তলার কম্পিউটার পয়েন্ট অ্যান্ড ভ্যারাইটিজ স্টোরে অভিযান চালিয়ে নকল সনদ তৈরির অভিযোগে পাঁচটি নকল সনদসহ রিয়াদ হোসেন ওরফে মিঠু (৩২) নামের একজনকে গ্রেফতার করে র্যাব-৪।
এনএ