সিরাজগঞ্জে বেকার যুবক থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষই এখন ঝুঁকছেন ডেইরি ফার্ম বা গরুর খামারে। অধিক লাভের পাশাপাশি নির্ভরশীলতা তৈরি হচ্ছে প্রতিটি পরিবারের। অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পেছনে না ছুটে বা অন্য ব্যবসা ছেড়ে গড়ে তুলছেন নিজস্ব খামার, স্বপ্নপূরণে এগিয়ে যাচ্ছেন অনেক দূর। 

এছাড়া প্রতিটি ডেইরি ফার্মের খরচ সাধারণত উৎপাদিত দুধেই মিটে যায়। অন্যদিকে ফার্মে বড় হওয়া ষাঁড় ও বকনা বিক্রি করে বছরে কয়েক লাখ টাকা আয় হয়ে থাকে তার।

তেমনই এক উদ্যোক্তা মনোয়ার হোসেন। কলেজ শেষ করে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত পড়াশোনায় থিতু হননি। একপর্যায়ে শুরু করেন পোশাক (গার্মেন্টস) ব্যবসা। এই ব্যবসায় যখন ক্ষতি হতে থাকে, তখন চিন্তায় আসে ভিন্ন কিছু করার। সে মোতাবেক প্রায় এক বছর আগে মুন্না ডেইরি ফার্ম নামে একটি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এখন স্বপ্ন দেখছেন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার।

জেলার সব উপজেলায় গরুর খামার গড়ে উঠলেও সবচেয়ে বেশি গড়ে উঠেছে শাহজাদপুর উপজেলায়।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, জেলায় সর্বমোট ডেইরি ফার্ম আছে ২৪ হাজার ১৯৩টি। বছরে জেলায় দুধ উৎপাদিত হচ্ছে ৭ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে শুধু শাহজাদপুরেই ১ লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন। এ ছাড়া বছরে মাংস উৎপাদিত হচ্ছে ৩ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। তবে কোন উপজেলায় কতটি ডেইরি ফার্ম আছে, জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে হালনাগাদ তথ্য সেই নেই বলে জানান অফিস সহকারী রেবেকা খাতুন।

শাহজাদপুরের হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়নের শাহজাদপুর-জামিরতা সড়কের বেড়া কুচাটিয়া গ্রামের মো. সাকিম উদ্দিনের ছেলে মো. মনোয়ার হোসেন (৩৪)। তার বাবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তার পরিবারে বাবা-মা, ছেলেমেয়েসহ সদস্য সংখ্যা ছয়জন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মনোয়ার সবাইকে নিয়ে এখন ভালোভাবে দিনযাপন করছেন।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে মনোয়ার জানান, তার খামারে এখন আছে ৩০টি গরু। এর মধ্যে ১৬টি গাভি, বাকিগুলো বকনা ও ষাঁড় বাছুর। ১৬টি গাভি থেকে প্রতিদিন পাচ্ছেন প্রায় ২০০ লিটার দুধ। বকনা বাছুর দুই বছর পালন করে আড়াই লক্ষাধিক টাকা বিক্রি করা যায়। একটি বকনার পেছনে দুই বছরে খরচ হয় প্রায় এক লাখ টাকা। একটি ষাঁড় দেড় বছর পালন করতে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়। বিক্রি করা যায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

তিনি আরও জানান, ১৬টি গাভির পেছনে প্রতিদিন খরচ হচ্ছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। ৩০টা গরুর পেছনে সবকিছু মিলিয়ে খরচ হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। প্রতিদিন দুধ বিক্রি করে আয় হয় ১১ হাজার টাকার মতো। প্রতি কেজি দুধ বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৪২ টাকা দরে। সবমিলে মাসে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকার দুধ বিক্রি হয়।

মনোয়ারের খামারে আছে অস্ট্রেলিয়ান জাতের জার্সি, শাহিয়াল, ফ্রিজিয়ান হানড্রেড প্রজাতির গরু। খরচ প্রসঙ্গে তিনি জানান, এক বছরে তার মোট খরচ হয়েছে প্রায় ২৪ লাখ টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে বছরে অন্তত ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা লাভ হবে।

মনোয়ার বলেন, গার্মেন্টসের ব্যবসা ছেড়ে এখন গরুর খামারেই স্বপ্ন দেখছি। উদ্যোক্তা হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছি। পরিবার নিয়ে অনেক সুখেই আছি। পাঁচ পরিবারের কর্মসংস্থান হয়েছে আমার খামারে।

শাহজাদপুরের আরও দুজন ডেইরি ফার্মের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাত্র চার থেকে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ৫০-৬০টি গরু পালন করে তারা আয় করেছেন প্রায় ৪০ লাখ টাকা। পাশাপাশি তাদের খামারে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে এলাকার অসংখ্য মানুষের। এলাকায় দুধ ও দুগ্ধজাতীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সারাদেশের চাহিদা পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন খামারিরা।

সিরাজগঞ্জে কেউ শখের বসে আবার কেউ বাণিজ্যিকভাবে গরু পালন শুরু করলেও খামারকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন অনেকেই। তারা স্বপ্ন দেখেন, আগামী চার-পাঁচ বছরে সবার খামারে অন্তত শতাধিক গরু থাকবে, আয় বাড়বে কয়েক গুণ। পাশাপাশি অন্তত ৩০০ পরিবারের কর্মসংস্থান হবে।

কামারখন্দ উপজেলার ঝাঐল ইউনিয়নের শাইলদাড় গ্রামের এস এম ফেরদৌস রহমান ঢাকায় ব্যবসা করেন। কিন্তু পাশাপাশি নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন ‘রহমান অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স’ নামের একটি ডেইরি ফার্ম। তার খামারে ১০টি গাভি, ৬টি বকনা ও ৪টি ষাঁড় রয়েছে।

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমি ভবিষ্যতে প্রায় ১৫ বিঘা জমির ওপর বড় আকারে ‘অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স’ করার চিন্তাভাবনা করেছি। সেখানে কয়েকশ গরু লালনপালন করব। পাশাপাশি অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানও হবে।

প্রশিক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে খামারিরা বলেন, শুরুতে প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়নি আমাদের। ছোটবেলা থেকেই বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি স্বপ্নপূরণে। কিন্তু এখন প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। কোনো বিষয়ে বুঝতে হলে উপজেলায় গিয়ে জেনে আসছি।

তবে তারা বলেন, একজন সফল খামারি হতে হলে আগে প্রশিক্ষণ ও সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তাছাড়া শুরুতে গরু কিনতে সতর্ক থাকতে হবে। অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ নিয়ে সঠিক জাত নির্বাচন করতে হবে। সঠিক পরিচর্যা ও খাবারের সঠিক সমন্বয় থাকতে হবে। প্রাণিসম্পদ অফিসের পরামর্শমতো লালনপদ্ধতি মানতে হবে। সঠিক জায়গা নির্বাচনও একটি বড় ব্যাপার। খোলামেলা সুন্দর জায়গা হলেই উত্তম।

তাছাড়া প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে তারা জানান, রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয় প্রতিনিয়ত। মৌসুমভেদে নিয়মিত টিকা দিতে হয়। পোকামাকড়ের ভয় ও নানা ভয় তো কাজ করেই।

দুধ বিক্রির বিষয়ে তারা বলেন, মিল্ক ভিটাসহ যেখানেই দর বেশি পাই, সেখানেই বিক্রি করি। এখন স্থানীয় একটি কারখানায় বিক্রি বেড়েছে। কারখানায় দামটা একটু বেশি পাওয়া যায়।

মিল্ক ভিটার ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ লাভলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিল্ক ভিটা বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে তৈরি একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান। যেটি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত। মিল্ক ভিটা শুধু দুধ বা দুগ্ধজাতীয় চাহিদাই পূরণ করছে না, এর পাশাপাশি সব খামারি বা ডেইরি ফার্মগুলোকে সার্বিক সহযোগিতাও দিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা তাদের ন্যূনতম ২ থেকে ৩ শতাংশ ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি নিজস্ব চিকিৎসক দ্বারা গরুর চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। বিনামূল্যে গোখাদ্যের ব্যবস্থা করছি। এছাড়া বন্যাকালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৩০০ একর জায়গা আমরা গরু রাখতে ও খামার করার জন্য দিয়েছি। 

দুধের দামের ব্যাপারে তিনি বলেন, এখানে দুধের ফ্যাটের ওপরে দাম নির্ধারণ করা হয়। কেউ পানি মিশিয়ে যদি দুধ বিক্রি করতে চায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তার দুধের দাম কেজিতে কম পড়বে। 

তিনি আরও বলেন, ররবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম পাবনা বীজ নামে একটি বীজ আনেন, যেখান থেকেই মূলত বৃহত্তর পাবনায় উন্নত জাতের গরু ও গাভির আগমন ঘটে। পরবর্তী সময়ে নিউজিল্যান্ড থেকে ষাঁড় আনা হয়।

সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আখতারুজ্জামান ভূইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সব ডেইরি ফার্মে ভ্যাকসিন থেকে শুরু করে সার্বিক  চিকিৎসা দিচ্ছি। এখন কোনো জটিল রোগ নেই।

মৃত্যুহার শূন্যতে নেমে এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় উঠান বৈঠক করে সচেতনতা তৈরি করছি। এছাড়া বন্যার সময় আমরা বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করে থাকি। গরু পালনে তিন ভাগের দুই ভাগই লাভ হয় বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেহেতু গরুর খামার ও ডেইরি ফার্মে বেশি প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না এবং সঠিকভাবে পরিচালনা করলে ক্ষতির আশঙ্কা নেই, তাই সহজেই বেশি লাভবান হওয়া যায়। তাছাড়া উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক ও সামাজিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন। বেকারত্বের অবসান ঘটিয়ে স্বপ্ন দেখছে অসংখ্য পরিবার। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করতে পারছেন।

তিনি আরও বলেন, আমরা ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি । অনেকে এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা নামক একটি প্রকল্প ইতোমধ্যেই এটা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা ৪ শতাংশ সুদে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এই সম্ভাবনাময় খাতটি ভবিষ্যতে আরও এগিয়ে যাবে।

এনএ