কিডনি (বৃক্ক) মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মানবশরীরে সাধারণত দুটি কিডনি থাকে। কিডনি শরীর থেকে অনাবশ্যক দ্রব্য বা পদার্থ মূত্র হিসেবে শরীর থেকে বের করে রক্তের পরিশোধন করে এবং শরীরে ক্ষার ও অম্লের ভারসাম্য বজায় রাখে। তবে শরীরের সবচেয়ে স্পর্শকাতর এই অঙ্গ কখনো একটি আবার কখনো কখনো দুটিই বিকল হয়ে যায় কারও কারও।

তেমন প্রয়োজন অনুভব করে নওগাঁ সদর হাসপাতালে আব্দুল জলিল হোমো ডায়ালাইসিস সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখানে কিডনি রোগীর সেবার মান উন্নত হওয়ায় জেলার ১১টি উপজেলা ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, নাটোর জেলা থেকেও কিডনি রোগীরা সেবা নিয়ে থাকেন।

সরেজমিনে জানা যায়, নওগাঁ সদর হাসপাতাল দুই শয্যার কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু করা হয়েছে। গত ২০১২ সালের আগস্ট। তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী প্রয়াত আব্দুল জলিল মার্কেন্টাইল ব্যাংক ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে দুই শয্যাবিশিষ্ট আব্দুল জলিল হোমো ডায়ালাইসিস সেন্টার উদ্বোধন করেন। পরের বছরই আরও তিনটি মেশিন পায় এই হোমো ডায়ালাইসিস সেন্টার।

হাসপাতাল পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আব্দুল জলিল হোমো ডায়ালাইসিস সেন্টারে কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ এ পর্যন্ত কিডনি রোগের চিকিৎসা নিয়েছেন, যার এক-চতুর্থাংশই ৬০ বছর বয়সী।

জানা যায়, একজন রোগী ডায়ালাইসিসের জন্য প্রথমে ২ হাজার ৯০০ টাকা খরচ হয়। এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে ১ হাজার ৯০০ টাকা করে খরচ হয়। চারটি ধাপ শেষ হলে আবার নতুন করে ২ হাজার ৯০০ টাকা দিয়ে ডায়ালাইসিস শুরু করতে হয়।

জেলার মান্দা উপজেলার গঙ্গারামপুর কাষোপাড়া গ্রামের রোগী সাইফুল ইসলাম (৬০) আব্দুল জলিল হোমো ডায়ালাইসিস সেন্টারে আট মাস ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার স্ত্রী মোছা. রুমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আল্লাহর রহমতে এখানকার চিকিৎসা নিয়ে রোগী অনেকটা ভালো আছেন। ডাক্তার-নার্সের সেবা অনেক ভালো। এই কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টারটি বেসরকারি হলেও অন্য বড় হাসপাতালের চেয়ে খরচ একটু কমই পড়ে।

কতবার দিতে হয়, খরচ কেমন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করলে রোগী ভালো থাকে। কিডনি দীর্ঘমেয়াদি রোগ হওয়ায় এর ব্যয়ভার অনেক বেশি। ধারদেনা করে চিকিৎসা করছেন। আজকাল অনেকেই আর ধার দিতে চাইছেন না। কিডনি ডায়ালাইসিসে প্রচুর খরচ, যা আমাদের নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বহন করা খুবই কষ্টকর।

জেলার ধামুইরহাট উপজেলার ইসবপুর ইউনিয়নের পঞ্চবর্গা গ্রামের আব্দুল খালেকের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকি (৬৬) এসেছেন চিকিৎসা নিতে। তার ছেলে মো. রেজুওয়ান হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, ২০০৯ সাল থেকে তার মা অসুস্থ। এই হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করতে একজন রোগীর প্রতি মাসে ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৪০ হাজার টাকা। অথচ অন্য বেসরকারি হাসপাতালে একই চিকিৎসা পেতে গুনতে হয় ন্যূনতম আড়াই লাখ টাকা। আবার ডায়ালাইসিসও করায় অনভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানরা। তাই সিরিয়াল বেশি হলেও এই হাসপাতালের সেবায় আমাদের আস্থা আছে।

ডায়ালাইসিস সেন্টারের সিনিয়র স্টাফ নার্স মেমি খাতুন ঢাকা পোস্টকে জানান, এখানে দুজন নার্স সেবা দিয়ে থাকি। জনবল বাড়ানো হলে সুবিধা হতো। করোনার লকডাউনের সময়ও ডায়ালাইসিস সেন্টার সেবা দিয়ে যাচ্ছি। যেখানে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিয়েছি।

বর্তমানে হাসপাতালটিতে পজিটিভ মেশিন জরুরি হয়ে পড়েছে। এ মেশিন থাকলে সেবার মান আরও বেড়ে যাবে বলে জানান ডায়ালাইসিস সেন্টারে দায়িত্বরত কর্মকর্তা হায়াত মাহমুদ। তিনি জানান, প্রয়োজনের তুলনায় ডায়ালাইসিস মেশিনের সংখ্যা কম। পাঁচটি মেশিনে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া যায় প্রতিদিন পাঁচজন রোগীকে। প্রতি মাসে ১৫০ জন রোগী সেবা পাচ্ছেন। সেবার মান ভালো হওয়ায় দিন দিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের সেন্টারে পজিটিভ মেশিন না থাকায় সেবা কম দিতে পারছি।

জেলার সদর উপজেলার পার নওগাঁ বাসস্ট্যান্ড এলাকার রোগী আব্দুল আজিজ চৌধুরী (৬৭) বলেন, প্রয়াত আব্দুল জলিল নওগাঁ সদর হাসপাতালে ডায়ালাইসিস মেশিন স্থাপন করে যে মহৎ কাজটি করে গেছেন, নওগাঁবাসী চিরদিন মনে রাখবেন। আজ সেই উপকার আমরা পাচ্ছি।

তিনি আরও জানান, চার বছর আগে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে যান। এরপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধরা পড়ে ক্রিয়েটিনাইন অনেক বেড়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নিয়েও কোনো উপকার হয়নি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার একটি কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। আগে সরকারি ও বেসরকারি একাধিক হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করিয়েছি। তবে এই কেন্দ্রে মূল্য কম ও সেবার মান ভালো।

এ বিষয়ে প্রয়াত আব্দুল জলিলের মেয়ে আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. মৌমিতা জলিল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবা নওগাঁবাসীর কথা চিন্তা করে মার্কেন্টাইল ব্যাংক ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে ৫ শয্যাবিশিষ্ট আব্দুল জলিল হোমো ডায়ালাইসিস মেশিন দিয়ে যান। বর্তমানে এখানে লোকবল কম। ‘হেপাটাইটিস বি পজিটিভ মেশিন’ না থাকায় রোগীদের সেবায় ঘাটতি রয়েছে। প্রতিদিন অনেক রোগী ডায়ালাইসিসের জন্য আসে, যাদের সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।

তিনি আরও বলেন, এখানে সবচেয়ে কম টাকায় কিডনি রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ছাড়া গরিব রোগীদের ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ছাড় রয়েছে। কিডনি অকেজো হওয়া একজন রোগীকে সপ্তাহে দুই বা তিনবার পর্যন্ত ডায়ালাইসিস করাতে হয়। আমার বাবা যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা আরও বেশি বড় পরিসরে এবং নতুন করে শয্যা বাড়ালে অনেক রোগী উপকৃত হবে বলেও জানান তিনি।

নওগাঁ সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ড. মো. তারেক হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, হেমো ডায়ালাইসিস মেশিনের মাধ্যমে করতে হয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর রক্ত শরীরের বাইরে স্থাপিত মেশিনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। মেশিন শুধু বর্জ্য পদার্থ রক্ত থেকে বের করে নেয়। ক্যাথেটারের মাধ্যমে শিরাপথের রক্ত মেশিনে যায়, পরিশোধন হয়ে অন্য ক্যাথেটারের মাধ্যমে আবার শরীরে আসে। সাধারণত সপ্তাহে তিন থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত হেমো ডায়ালাইসিস করতে হয়। প্রতি সেশনে কতটা সময় করতে হবে, তা নির্ভর করে রোগীর কিডনির অবস্থার ওপর। কিছু ক্ষেত্রে রোগীর হেমো ডায়ালাইসিস বাড়িতেও করা সম্ভব। যেমন: ডায়ালাইসিস করার সময় যদি রোগী সুস্থ থাকে বা অবস্থা পরিবর্তিত না হয়, যখন রোগীর অন্য কোনো অসুখ না থাকে।

তিনি আরও বলেন, হেমো ডায়ালাইসিস হাসপাতালে জনবল কম। এ মাসে গত সাপ্তাহিক জুম মিটিংয়ে ডায়ালাইসিস মেশিন বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে পাঁচটি বেডের সংখ্যা বাড়ানো হতে পারে। চিঠি আসার পর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে, বেডের সংখ্যা বাড়ানো হবে বা নতুন করে আরও ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু হতে পারে।

এনএ