চারদিকে ছোট ছোট টিলায় সবুজ গাছপালাসমৃদ্ধ শাল-গজারির বিখ্যাত জেলা গাজীপুর। টিলাবেষ্টিত শালবাগানই যুগের পর যুগ গাজীপুরের ভাওয়াল রাজা অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। কর্মজীবনের ব্যস্ততা ছেড়ে রাজধানীর কাছের বিনোদনের জায়গা হিসেবে প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে অনেকেই গাজীপুরকে বেছে নেন।

হাজারো উদ্ভিদ ও প্রাণী পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে শাল-গজারিগাছ। কিন্তু রহস্যময় আগুনে শাল-গজারিগাছ, চারা ও বনের নানা ধরনের প্রাণী, পোকামাকড় পুড়ছে। বন বিভাগ আগুন লাগার নির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনো বের করতে না পারলেও, হুমকিতে পড়েছে প্রাণীবৈচিত্র্যে ও শাল-গজারি বন।

জেলার সদর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর, রোদ্রপুর, বিকে বাড়ি, বিমানবাহিনীর গেট এলাকায়, ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের কিছু অংশ ও গজারিয়াপাড়া শ্রীপুর উপজেলার গোসিঙ্গা ইউনিয়নের দক্ষিণ গজারিয়াপাড়া, পটকা, ভেরামতলী, বেলতলী, মাওনা, শিমলাপাড়া, আক্তাপাড়াসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় বনে এ রহস্যময় আগুনের ঘটনা ঘটছে। এতে প্রকৃতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, প্রকৃতির নিয়ম মেনেই শালগাছের পাতা ঝরে পড়ার পর তার ভেতর থেকেই বসন্তকালে যখন উঁকি দেয় নতুন নতুন উদ্ভিদ, তখনই বন উজাড় করে তা দখলের উদ্দেশ্যেই রাতের আঁধারেই আগুন দেয় একটি চক্র। তাদের উদ্দেশ্য, বনের গাছপালা পুড়ে বন পরিষ্কার করে তা দখলে নেওয়া।

বন বিভাগ জানায়, প্রায় ৬৫ হাজার একর বনভূমি রয়েছে গাজীপুরে। জেলার মধ্যে ভাওয়াল, শ্রীপুর, কালিয়াকৈর, কাঁচিঘাটা, রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জ অফিসের মাধ্যমে এসব বনভূমি ব্যবস্থাপনা করা হয়। শিল্পায়ন, বন উপড়ে বনভূমি দখল করে বসতবাড়ি নির্মাণের কারণে গাজীপুরের বনাঞ্চল এমনিতেই হুমকির মধ্যে রয়েছে। স্বল্প জনবলে বন বিভাগের নজরদারির অভাবে বেপরোয়া এখন স্থানীয় বনদস্যুরা।

শীতের শেষে শালগাছের পাতা ঝরে যায়। বসন্তের শুরুতে প্রকৃতি জেগে ওঠার সময় বনে আগুনের যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধে বড় গাছগুলো কোনোমতে টিকে থাকলেও ছোট গজানো হাজারো উদ্ভিদ ও কাণ্ড থেকে গজানো শালগাছ পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জীববৈচিত্র্য ও নানা প্রাণ।

শ্রীপুরের দড়ি খোঁজেখানির গ্রামের আবু তাহের ঢাকা পোস্টকে জানান, বসন্তকালের শুরু থেকেই বনে আগুন দেওয়া হয়। যেন আমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করতেই এসব কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছি। অনেক সময় এলাকার লোকজন নিয়ে আমরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করি। তবে বনের আগুন নেভানো যায় না। কয়েক দিন জ্বলার পর তা নেভে।

আজুগীচালা গ্রামের মহিদুল আলম চঞ্চল খানের মতে, মূলত বনের জায়গা দখলের উদ্দেশ্যে আগুন দিয়ে বনের গাছ পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বনের জমি দখলে নিতে বনের গাছপালা কাটলে বিভিন্ন ধরনের আইনি জটিলতায় পড়তে হয়। কিন্তু আগুনে গাছ পুড়িয়ে বনের জায়গা দখল নিতে অনেক সুযোগ তৈরি হয়।

শ্রীপুরের গাড়ারন এলাকার বাসিন্দা জুবায়ের আহমেদ বলেন, আগুন পুড়ে সাবাড় হচ্ছে গাছপালা ও পোকামাকড়। এতে তৈরি হচ্ছে খাবারের সংকট। বন ছেড়ে পাখি ও প্রাণীগুলো লোকালয়ে আসছে। এ রকম চলতে থাকলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যাবে প্রাকৃতিক এ বনগুলো। তাই যেভাবেই হোক বন ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করতে হবে।

প্রকৃতিকে তার মতো করে বাঁচতে দিতে হবে। কিন্তু আমরা বনের ভেতর আগুন দিয়ে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। বনের ভেতর বসবাসরত হাজারো প্রাণীর বসবাসের স্থান ধ্বংস করে দিচ্ছি। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছি। এটা আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির একটা কারণ।

হাসান ইউসুফ খান, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) গাজীপুর

শালবনে আগুন দেওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে শাল-গজারিগাছ ধ্বংসের মাধ্যমে বনভূমি দখল করা, এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, শালগাছ কখনোই চারা থেকে হয় না। গাছের কাণ্ড ও মূল থেকেই এর জন্ম। আগুনের কারণে নতুন করে শালগাছ জন্মাতে পারে না। তাই যেভাবেই হোক, গাজীপুরের শালবাগান রক্ষা করতে হবে, আমাদের বেঁচে থাকার তাগিদেই।

গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আশরাফ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বনের ভেতর আগুনের কারণে বনের জীববৈচিত্র্য নষ্ট, কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে পরিবেশের ক্ষতি, মাটির উপরিভাগের কার্যক্ষমতা হারানোসহ পুরো ইকোসিস্টেমের ক্ষতি হচ্ছে। ইকোসিস্টেম রক্ষার্থে বনের আগুন দেওয়া প্রতিরোধ করতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইউছুপ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বনের ভেতর চলাচলকারী লোকজনদের অবহেলা ও ইচ্ছা করেই একটি অসাধু চক্র বনে আগুন দিয়ে থাকে। বিশাল এলাকার শালবন আমাদের স্বল্প জনবল দিয়ে তা রক্ষা করতে পারছি না। তাই স্থানীয়দের সচেতন করার পাশাপাশি আমরা বন রক্ষায় নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা চিন্তাভাবনা করছি।

শিহাব খান/এনএ