বিদ্যালয় অনেক দিন বন্ধ হলেও ক্লাস, বন্ধুদের সঙ্গে বিদ্যালয়ের মাঠে খেলাধুলা ও শিক্ষকদের ঘাটতি বোঝেনি সে কখনো। কীভাবে এক বছরের বেশি সময় চলে গেল, সে টেরই পায়নি। সারা দিন গ্রামের সহপাঠীদের সঙ্গে খেলা করেই সময় পার হয়েছে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জয় সিদের।

করোনাকালীন সারাদেশের মতো তার বিদ্যালয়ও বন্ধ রয়েছে। এতে পড়াশোনার চাপ কম। আনন্দেই কাটছিল তার দিন। গত ১৭ মার্চ আধা ঘণ্টা সময় ঘটে যাওয়া বিভীষিকাময় অধ্যায় সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। একসঙ্গে হাজারো মানুষের কণ্ঠে চিৎকার, টিনের ঘরে ভাঙচুরের শব্দ এখনো তার কানে বাজে।

ঢাকা পোস্টকে জয় জানায়, সেদিন অন্যান্য দিনের মতোই বাড়ির উঠানে খেলা করছিল সে। হঠাৎ একসঙ্গে অনেক মানুষের চিৎকার শুনতে পায় সে। কিছু বুঝ ওঠার আগেই তাকে ও তার বোনদের নিয়ে তার মা হাওরের দিকে ছুটতে থাকেন। অকস্মাৎ হামলার কারণ বুঝতে না পারলেও, মানুষের হিংস্রতা দাগ কেটে গেছে তার মনে।

জয়ের মা মিনা রানী দাস বলেন, হাতে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দেখতে দেখতেই নদী পার হয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। তখন শুধু মনে হয়েছে, বাঁচতে হবে আমাকে, আমার সন্তানদের। তাই আমার ছোট মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে হাওরের ধানক্ষেতে গিয়ে লুকিয়েছি।

সরেজমিনে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে গেলে ভুক্তভোগীরা জানান ১৭ মার্চ হামলা ও লুটপাটের বীভৎস অভিজ্ঞতার কথা। গ্রামে এই সন্ত্রাসী হামলা ও লুটপাটের ঘটনার পর গ্রামে বসানো হয়েছে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বিভীষিকাময় স্মৃতি ভুলে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে। কিন্তু শিশু ও শিক্ষার্থীরা এখনো রয়েছে আতঙ্কে।

তাদের অভিভাবকরা জানান, ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে পারছে না। একা একা কোথাও বের হয় না। সব সময় আতঙ্কে থাকে। ঘুমের মাঝেও চিৎকার দিয়ে ওঠে তারা।

গিরিশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সনকা রানী দাস বলেন, সামনে আমার এসএসসি পরীক্ষা। সব সময় মনে হয় সেদিনের কথা। রাতে একটু একা হলেই মনে হয়, এই বুঝি আবারও হামলা হলো। পড়ালেখা করতে পারি না।

একই বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী শিশির বাবু দাস বলে, হামলার সময় আমার বোনের বাড়িতে সবাই গিয়েছিলাম। ফিরে দেখি সব বই-খাতা ছেঁড়া। এখন স্কুল খুললে আমরা কীভাবে যাব? রাস্তায় মানুষ দেখলেই ভয় করে।

নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী অমিত চন্দ্র দাস জানায় একই রকম আতঙ্কের কথা। সে বলে, হামলার সময় মায়ের সঙ্গে পাশের গ্রাম কোরারপাড়ায় ফুফুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তারা। এক দিন পর বাড়িতে এসেছে। দেখল বই-খাতা সবকিছু তছনছ করা। কেন এমন হামলা, এখনো আঁচ করতে পারছে না সে।

শিক্ষার্থী মণিকা দাস বলেন, দুর্বৃত্তরা আমার প্রবেশপত্র ছিঁড়ে ফেলেছে। সামনে আমার এইচএসসি পরীক্ষা। এ নিয়ে চিন্তায় রয়েছি। প্রবেশপত্র না হলে পরীক্ষা দেব কীভাবে?

অভিভাবক রীনা রানী দাস বলেন, আমার মেয়ের মেট্রিক পরীক্ষার ফরম ফিলাম সামনে। এখন আমার মেয়ে বলে, মা আমি যে এখন ঘুংগিয়ারগাঁও যাইতাম, এখন আমার খালি ডর (ভয়) লাগের। তবে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে মেয়েকে সাহস দিচ্ছেন জানালেন তিনি।

অভিভাবক শৈলেন দাস বলেন, আমার ছেলে-মেয়ে পাঁচজন। সবাই পড়াশোনা করে। সেদিন কিছু লোক এসে আমার বাড়িঘরে হামলা করে বাচ্চাদের সব বইপত্র ছিঁড়ে ফেলেছে। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে তারা স্কুলে যাবে, সে পরিবেশ নেই। আমরা ভয়ে আছি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাচ্চাদের আর বিদ্যালয়ে পাঠাব না।

হামলার সময় আমরা ধানক্ষেতে লাম্বা হইয়া শুয়ে রইছি। বাচ্চা বলে পানি খাইব, পরে ক্ষেত থেকে প্যাকের পানি খাওয়াইছি উল্লেখ করে রিপন রানী দাস বলেন, এখন তো সবকিছু স্বাভাবিক হয়েছে। তবো বাচ্চারা তো ভয় পায়। রাতে ঘুমায় না। ঠিকমতো খায়ও না। শুধু বলে, মা, আবার নি আইয়ে। তেই আমি কই, না আর আইত না। এখানে তো পুলিশ আছে। আর আইত না। এভাবেই সান্ত্বনা দিয়ে রাখি আমার ছেলেকে। তবু ঘুমায় না।

এ বিষয়ে হবিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষার্থীদের বইপত্রও ছিঁড়ে ফেলেছে। ভবিষৎ নিয়ে শিশুরাও আতঙ্কিত রয়েছে। প্রশাসন ত্রাণপত্র যা দিচ্ছে, তা পেয়ে আমরা সন্তুষ্ট রয়েছি। তাদের মানসিকভাবে সহযোগিতা প্রয়োজন।

নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গুরুপ্রসাদ দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বিদ্যালয়ে মোট ৯২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। সব শিক্ষার্থীই নোয়াগাঁও গ্রামের। গ্রামে ১৭ মার্চের হামলা ও লুটপাটের কারণে মানসিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষার্থীরা।

তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে গ্রামের বাসিন্দারা বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন। এতে তাদের কিছুটা হলেও ক্ষতি পূরণ হয়েছে। কিন্তু শিশুরা এত সব বোঝে না। কেন এ রকম ঘটনার জন্ম হলো, এটা তাদের কাছে এখনো দুঃস্বপ্নের মতো। বিদ্যালয় খুললে তারা শিক্ষার্থীদের মানসিক সাপোর্ট দিতে পারবেন বলে জানান।

শিক্ষাবিদ ন্যাথালিয়ন এডউইন ফেয়ার ক্রস ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ রকম ঘটনা আমরা আশা করি না। এ ব্যাপারে সবার আরও সচেতন থাকা ও শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা উচিত। এ ধরনের কোনো ঘটনা ভবিষতে যেন না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে প্রশাসনকে।

এনএ