কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার চর বাঘমারা এলাকার গৃহবধূ আমেনা বেগম। ১২ বছরের দাম্পত্য জীবন তার। এই সময়ে তিন সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এর মধ্যে বেঁচে আছে দুই মেয়ে। জন্মের পরে মারা গেছে পুত্র সন্তান। এ বছর তিনি আবারও অন্তঃসত্ত্বা হন। কয়েক মাস পর আলট্রাসনোগ্রাম করে জানতে পারেন তার গর্ভে কন্যা শিশু।

এতেই অন্তঃসত্ত্বা আমেনা বেগমের ওপর নেমে আসে স্বামীর নির্যাতন। স্বামী আমিনুল ইসলামসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন হত্যার হুমকি দেয় তাকে। ফলে নিজের ও গর্ভের সন্তানের জীবন বাঁচাতে থানায় হাজির হয়েছেন আমেনা বেগম। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সকালে প্রসব বেদনা শুরু হতেই আমেনা বেগম ছুটে আসেন স্থানীয় একটি ক্লিনিকে। সেখানে এসেও স্বামী আমিনুল গর্ভে থাকা সন্তান ও স্ত্রীকে হত্যার হুমকি দেন। এ সময় পানি ভাঙতে শুরু করে প্রসূতির। চিকিৎসক তার অস্ত্রোপচারের (সিজার) প্রস্তুতি নেন। কিন্তু এই অবস্থায় গর্ভের সন্তান ও নিজের জীবন বাঁচাতে আমেনা বেগম রৌমারী থানায় ছুটে যান। 

রৌমারী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুপ কুমার সরকারকে আমেনা জানান, কন্যা সন্তান হওয়ায় তিনি তার পেটের সন্তান ও নিজের জীবনহানির শঙ্কা করছেন। নানা হুমকি দিচ্ছেন সন্তানের পিতা নিজেই। এরপর ওসি রুপ কুমারের হস্তক্ষেপে আমেনাকে ফের হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার স্বামীকে নেওয়া হয় থানায়। কাউন্সিলিংয়ের পাশাপাশি স্ত্রী ও সন্তানের কোনো ধরনের ক্ষতি হয় এমন কাজ করতে নিষেধ করা হয় তাকে।

উপজেলা সদরের নিরাময় হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌহিদুর রহমান বলেন, ওই নারী একাই প্রসব বেদনা নিয়ে হাসপাতালে আসেন। এরপর তার স্বামীসহ কয়েকজন স্বজন আসেন। কিন্তু মেয়ে সন্তান হওয়ার কথা আগেই জেনে যাওয়ায় তাদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তখন আমরা তাদের পারিবারিক বিষয় নিজেদের মেটাতে বলি। পাশাপাশি তাদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ডাকতে বলি। এরইমধ্যে সবার চোখ এড়িয়ে ওই নারী অসুস্থ অবস্থায় থানায় চলে যান। পরে পুলিশ এসে বিষয়টা সমাধান করে।

তিনি আরও বলেন, ওই নারী ভর্তি হওয়ার পরেই সিজারের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। পরবর্তীতে এসব কারণে এখানে আমরা রাখিনি। কারণ শুরুতে সিজার হলে এখানেই হতো। রোগীর পানি ভাঙছিল। কিন্তু তার  আশঙ্কা ছিল স্বামী ক্ষতি করতে পারে। থানা পুলিশসহ বিভিন্ন পক্ষকে বিষয়টি জানিয়ে সমাধান করতে ৯ ঘণ্টা দেরি হয়ে যায়। ফলে পেটে থাকা সন্তানের হার্টবিট কমে যাচ্ছিল। তাই আমরা অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই। যাতে এখানে ঝামেলা না হয়। তাই অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সর্বশেষ যতটা জানতে পেরেছি শেরপুরের একটি ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে তার সিজার হয়েছে। 

এ বিষয়ে রৌমারী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুপ কুমার সরকার বলেন, সোমবার বিকেলের দিকে হঠাৎ এক নারী আমার কাছে এসে বলেন, বারবার মেয়ে সন্তান হওয়ায় তার স্বামী তাকে ও তার সন্তানকে হত্যার চেষ্টা করছে। বিষয়টি আমলে নিয়ে ওই নারীর অভিযোগ শুনি। তখন জানতে পারি এই নারী নাকি হাসপাতাল থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে থানায় এসেছেন স্বামী ও তার পরিবারের হাত থেকে বাঁচতে। বিষয়টি অত্যন্ত মর্মান্তিক হওয়ায় থানা থেকে নারী পুলিশ দিয়ে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। স্বামীকে থানায় আনা হয়। পরবর্তীতে বারবার কন্যা সন্তান হওয়ার পেছনে মায়ের কোনো ভূমিকা নেই। এ ক্ষেত্রে বাবার শুক্রাণুর ক্রোমোজম দায়ী উল্লেখ করে এই সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন তথ্য দিয়ে তাকে কাউন্সিলিং করা হয়। এরপর তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে এ ধরনের কাজ না করার প্রতিশ্রুতি দেন।

আমেনার স্বামী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘শুরুতে বিষয়টি আমি বুঝিনি। ওসি স্যার বুঝানোর পর এখন বুঝছি। মাইয়া বাচ্চা হইছে আমি খুশি। আমি আর আমার স্ত্রীরে কিছু বলবো না।’

ভুক্তভোগী নারী আমেনা বেগম বলেন, আমি এখন সুস্থ আছি। মেয়ে বাচ্চা হয়েছে সোমবার রাত সাড়ে ১১টায়। আমি খুব খুশি।

জুয়েল রানা/আরএআর