‘মৌমাছি বাড়ি’ নাম শুনে অবাক হচ্ছেন? বেলকনিসহ বাড়ির চারপাশে ২৬টি বড় বড় মৌমাছির চাক। তারা বাড়িটিকে ঘিরে রেখেছে। বছরের ৮ মাস তারা এ বাড়িতে অবস্থান করে। এলাকায় বাড়িটি এখন মৌমাছির বাড়ি হিসেবে পরিচিত। কেউ মৌমাছি দেখতে আবার কেউ ছবি তুলতে যায় বাড়িটিতে। পরিবারের সদস্যদের মতোই মানুষের সঙ্গে ৭ বছর ধরে বসবাস করছে এ সকল মৌমাছি।

সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার সখিপুর ইউনিয়নের কোড়া গ্রামের মৃত. শেখ মুনসুর আলীর ছেলে শেখ আবু সাঈদ। পেশায় তিনি চিংড়ি ঘের ব্যবসায়ী। বাড়িতে সন্তানের মতো লালন-পালন করছেন মৌমাছির কয়েক লাখ মৌমাছি। 

ঘের ব্যবসায়ী শেখ আবু সাঈদ বলেন, ৭ বছর আগে হঠাৎ বাড়ির বিভিন্ন স্থানে ৭-৮টি মৌমাছির চাক এসে হাজির হয়। এরপর থেকে প্রতি বছরই নির্দিষ্ট সময়ে মৌমাছির দলগুলো বাড়িতে চলে আসে। দ্বিতলাবিশিষ্ট বাড়ির বেলকনি, দেওয়ালসহ বিভিন্ন স্থানে চাক তৈরি করে। প্রতি বছরই মৌমাছির দলের আগমনের সংখ্যা বাড়ছে। এ বছর এসেছে ২৬টি মৌমাছির দল। সব কিছুর মালিক আল্লাহ। এটি আল্লাহ প্রদত্ত। কৃত্রিমভাবে কোনো কিছু করা হয় না। সুন্দর পরিবেশে আমাদের সঙ্গে বসবাস করছে।

এ রকম ২৬টি মৌমাছির চাক রয়েছে

 তিনি আর বলেন, মৌমাছির সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা মিশে গেছে। আমার স্ত্রী বেশির ভাগ সময় তাদের দেখাশুনা করে। তাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে কিনা দেখেন, আমিও দেখি। তাছাড়া আমার কলেজ পড়ুয়া মেয়েও দেখভাল করে। বছরের নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত মৌমাছির দলগুলো বাড়িতে থাকে।

এরপর একদিন হঠাৎ করে সব চলে যায়। তখন মনটা খুব খারাপ লাগে। অপেক্ষায় থাকি আবার কবে মৌমাছিগুলো ফিরে আসবে। ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে আবারও চলে আসে মৌমাছিগুলো। এভাবে চলছে সাত বছর ধরে। তাদের কোনো খাবার দেওয়া লাগে না। প্রাকৃতিকভাবে  খাবার খায় তারা।

শেখ আবু সাঈদের স্ত্রী রনজিলা বেগম বলেন, মৌমাছিগুলো খুব বেশি নোংরা করে না। থাকার ঘরের দুই হাত পাশেই থাকে মৌমাছির দল। প্রথম দিকে কামড়ানোর ভয় পেলেও এখন আর ভয় লাগে না। মৌমাছি আমাদের কাউকে আক্রমণ করে না, কামড়ায় না। অনেক মানুষ দেখতে আসে, ভালো লাগে।

মৌমাছির সঙ্গে আবু সাঈদের পরিবারের বসবাস

৮ মাসে দুইবার মৌমাছির চাক থেকে মধু সংগ্রহ করি। মধু ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করা মধু কিনে নিয়ে যায়। বছরে প্রায় ৫০ হাজার টাকার মধু বিক্রি হয়। এ ছাড়া আত্মীয়-স্বজনরা নেয়। এলাকার বিভিন্ন মানুষ তাদের প্রয়োজনে খাঁটি মধু সংগ্রহ করে আমাদের কাছ থেকে।

দুঃখ প্রকাশ করে রনজিলা বেগম বলেন, একবার এক প্রতিবেশী হিংসা করে বিষ স্প্রে করে দেয় মৌমাছির চাকে। অনেক মৌমাছি মারা যায়। সেদিন পরিবারের সবাই কেঁদেছিল। জীবিত থাকা মৌমাছিগুলো চলে যায়। তখন ভেবেছিলাম মৌমাছিগুলো হয়তো আর আসবে না। তবে আবার এসেছিল। আমাদের বাড়িতে আসে বলে অনেকেই হিংসা করে। মৌমাছির সঙ্গে কি জোর করা যায়। ওদের যেখানে ভালো লাগবে সেখানে আসবে।

দেবহাটা সরকারি কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বাড়ির মেয়ে ফাতেমা খাতুন জানায়, মৌমাছিগুলো আমাদের অথনৈতিকভাবেও সহযোগিতা করছে। এক সঙ্গে থাকি। আমাদের ওপর আক্রমণ করে না। তবে কেউ যদি আঘাত দেয় তখন আক্রমণ করে। 

দেবহাটা এলাকার চক মোহাম্মদ আলীপুর গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম জানান, আমি বিভিন্ন জায়গায় মৌমাছির চাক দেখেছি। তবে এতোগুলো চাক কোনো বাড়িতে কোথাও দেখিনি। বাড়িটি দেখলে মনে হবে যেন মৌমাছির বাড়ি। সবকিছুই মৌমাছির দখলে। এক বাড়িতে মানুষ আর মৌমাছির বসবাস।

দেবহাটার সখিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ ফারুক হোসেন রতন বলেন, প্রতি বছরই মৌমাছি ওই বাড়িতে এসে হাজির হয়। লাখ লাখ মৌমাছি। কোথা থেকে আসে আবার কোথায় চলে যায় কেউ বলতে পারে না। আমি ওদিকে গেলেই বাড়িটি ঘুরে আসি, মৌমাছিগুলো দেখে আসি।

এ বিষয়ে সাতক্ষীরা বিসিক শিল্প নগরীর কর্মকর্তা কৃষ্ণপদ মল্লিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এগুলো মেইলি সিরা প্রজাতির মৌমাছি। এ মৌমাছিগুলো প্রকৃতি ও পরিবেশ বোঝে। যেখানে নিরাপত্তা, বাঁচার পরিবেশ ও খাবারের ভালো সুব্যবস্থা পায় সেখানেই মূলত তারা বাসা বাধে। এগুলো সুন্দরবনের মৌমাছি। এ মৌমাছিগুলো বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের ছাদের নিচে বাসা বাধে ও সেখানে মধুর চাক তৈরি করে।

এক বছর যেখানে বাসা বাধে নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর চলে যাওয়ার সময় সেখানে কিছু আলামত রেখে যায়। পরের বছর সেখানেই ফিরে আসে। এতে তাদের বাসা তৈরি করতে সহজ হয়। সেকারণেই মূলত মৌমাছিগুলো ওই বাড়িতে আসছে ও বাসা বাধছে। সেখানে তারা নিজেদের নিরাপদ নিশ্চিত মনে করে পরিবারটির সঙ্গে মিশে গেছে। এটা প্রাকৃতিকভাবেই হয়েছে। এখানে কারও হাত নেই।

এসপি