‘মেলা কিছু করছি ভাই এই জীবনে। সে (স্বামী) আমাক সান্ত্বনা দিয়া দিয়া রাখছে। আর মহিলা ডিসি স্যার আমাক খুব ভালোবাসিছিল। আমাক তো বাড়ি করি দিছে। দোকানও করি দিবার চাইছে। তাই এলা বদলি হয়য়া গেইছে। আর আমরা তো দুইজনে অসুস্থ। সরকার যদি কোনো রকম করি খাওয়ার ব্যবস্থা করি দেয়। যত দিন বাঁচি আছি, আমাক তো করি খাওয়া লাগবে। যে সুখ-শান্তি আছে, তাই নিয়া থাকপার চাই।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কাঁঠাল বাড়ি ইউনিয়নের পরামেরটারি গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী বৃদ্ধ আবদারের স্ত্রী অরেচা বেগম। তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী।

শারীরিক প্রতিবন্ধী আবদারের সঙ্গে ১০ থেকে ১১ বছর আগে রংপুর জেলার আরেক শারীরিক প্রতিবন্ধী অরেচা বেগমের বিয়ে হয়। তারপর শুরু হয় তাদের সংসারজীবন। কিন্তু দরিদ্রতার কারণে পেশা হিসেবে বেচে নেন ভিক্ষাবৃত্তিকে। নিজেদের কোনো জায়গাজমি না থাকায় অন্যের বাড়িতে বসবাস করতেন এই দম্পতি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে কুড়িগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন খোঁজখবর নেন। তাদের ব্যবসা করার জন্য দোকান করে দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি।

পরে এই দম্পতিকে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে ডাকলে তারা সেখানে যান। তাদের মামা জেলা প্রশাসককে জানান, তাদের থাকার মতো কোনো বাড়ি নাই। দোকান করে দেওয়ার চেয়ে বাড়িটি করে দিলে তাদের জন্য ভালো হবে। পরে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে একটি বাড়ি করে দেওয়া হয়। তারপর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন ওই জেলা প্রশাসক। পরে জেলা প্রশাসক বদলি হয়ে গেলে তাদের কপালে আর দোকানটি জোটেনি। তাদের বাড়িটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আবদার অরেচা নীড়’।

শারীরিক প্রতিবন্ধী বৃদ্ধ আবদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি জন্মের পর থাকি এমন। বয়স হয়া গেইছে। চলতে পারি না। কী করি খাই এলা। কুড়িগ্রামের ডিসি বাড়িটা করি দিছে। খেয়া না খেয়া বাড়িত থাকপার তো পারি। আমি অসুস্থ, তাই এখন আর ভিক্ষাও করতে পারি না। একটা যদি দোকান করি দেইল হয়, তাহলে দোকান করি খাইমু।

অরেচা বেগম বলেন, এখন কোনো কাজ করতে পারি না। দুজনেই দুর্বল, অসুস্থ। এলা কী করি খাই? তাও চেষ্টা করি, যা পাই তা করি খাই। রান্নাবান্না করি। তাও দিন যাচ্ছে এটাই আমার বেশি। ছোয়ারও (ছেলেমেয়ে) মা হওয়ার ভাগ্য আমার হয় নাই। তাও আমি তাক নিয়া লড়াই করে খাচ্ছি।

কথা হয় স্থানীয় আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। আবদার সম্পর্কে তার মামা হন। তিনি বলেন, আবদার দীর্ঘদিন ধরে আমার বাড়িতে বসবাস করে আসছেন। ১০ থেকে ১১ বছর আগে মামার মতো শারীরিক প্রতিবন্ধী রংপুরের আরেক শারীরিক প্রতিবন্ধী অরেচা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তাদের একটি ঘর করে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া তারা যেন ভালোভাবে চলতে পারেন, একটি দোকানও করে দিতে চেয়েছিল জেলা প্রশাসন। কিন্তু হঠাৎ ডিসি বদলি হয়ে গেলে তাদের কপালে আর দোকান জুটল না।

এ বিষয়ে কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের ২ নম্বর (ইউপি) সদস্য মো. তাহের আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আবদার একজন অসহায় ব্যক্তি। তার নিজের কোনো জায়গাজমি নাই। তার মতোই আরেক শারীরিক প্রতিবন্ধীকে তিনি বিয়ে করেন। তারপর শুরু হয় তাদের সংসারজীবন। আমি আমার ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে প্রথমে একটি বয়স্ক ভাতা করে দিই। পরে তার স্ত্রীর প্রতিবন্ধী ভাতা করে দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, কুড়িগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদারকে একটি ঘর করে দিয়েছেন। তার আগে আমি সরকারিভাবে তাকে একটি ঘর করে দিই। সরকারি যেকোনো অনুদান এলে তাকে দেওয়ার চেষ্টা করি। তাতেও মনে হয় তাদের সংসারের অভাব যায় না। আবদার এখন অসুস্থ, হাঁটতে পারেন না। খুব কষ্ট করে চলছে তাদের দুঃখের সংসার।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিলুফা ইয়াসমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওই দম্পতি অনেক আগে একবার এসেছিলেন আমার কাছে। তারপর থেকে আর আসে নাই। তারা এখন কী অবস্থায় আছেন, জানা নেই। তারা কোনো সমস্যায় থাকলে তাদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এনএ