কোথা থেকে বের হচ্ছে পানি, উৎস জানে না কেউ
কৃত্রিম কোনো টিউবওয়েল নয়, খনন করা কুয়াও নয়। একটি সুড়ঙ্গ ও মাটির নিচ থেকে প্রাকৃতিকভাবেই নিরাপদ পানি বের হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ভূমির নিচের দিকে। তবে টিউওয়েলের পানির চেয়েও এই জলধারার পানি স্বচ্ছ। টিউবওয়েলের পানি সকালে পাত্রে রাখলে বিকেলে পাত্র লাল হয়ে যায়। জলধারার পানি এক বছর রাখলেও পাত্রের কোনো পরিবর্তন হয় না। লাল রং ধরে না। পানির স্বাদ-গন্ধও থাকে একই।
সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুরের পর্যটন এলাকা ট্যাকেরঘাটে এমন এক জলধারার অবস্থান। ভারতের মেঘালয়ের পাশে বাংলাদেশের সীমান্তের ছোট পাহাড়ের নিচে ছোট সুড়ঙ্গ দিয়ে বের হচ্ছে পানি। সুড়ঙ্গের পাশে স্বচ্ছ বালুরাশির ভেতর থেকেও পানি বের হয়ে জলধারা তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও আইইউসিএন বাংলাদেশের উদ্যোগে জলবায়ুসহিষ্ণু পর্যটনশিল্প উন্নয়নে দায়িত্বশীল পর্যটন ব্যবস্থাপনার প্রবর্তন প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৭ সালে ট্যাকেরঘাটের সীমান্তবর্তী এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজ হয়। প্রায় ১০০ কোটি টাকার প্রকল্পের ফলে এই এলাকার অনেক কিছুই নতুন করে সাজানো হয়েছে। তবে কোম্পানির পরিত্যক্ত জিনিসপত্র সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া হলেও এ জলাধারটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাই এলাকাবাসী পানির প্রবাহ আরও গতিশীল করতে সুড়ঙ্গের পাশে আরেকটা বিকল্প কংক্রিটের রিং স্থাপন করেছেন।
বিজ্ঞাপন
এলাকাবাসী বলছেন, যুগ যুগ ধরে তারা দেখে আসছেন সীমান্তের এই জায়গা থেকে পানি বের হয়ে আসছে। যখন টিউবওয়েল ছিল না, এখান থেকেই তারা পানি সংগ্রহ করে পান করেছেন। তবে এখন বাড়ি বাড়ি টিউবওয়েল হওয়ায় এই জলধারা থেকে পানি সংগ্রহের পরিমাণ কমেছে। বাড়ি থেকে এই জলধারা দূরে হওয়ায় পানি সংগ্রহ করা কষ্টকর।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা যায়, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে এই জলধারা অবস্থিত। পাহাড়ের সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে নিচে ঢালু জায়গায় জলধারার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানির উৎসমুখ ছোট একটি সুড়ঙ্গ থেকে। উঁচু পাহাড়ের ভেতর থেকে সমতল ভূমিতে মিলিত হয়েছে এই সুড়ঙ্গ। তবে পাহাড়ের ওপরে গিয়ে খুঁজেও এই সুড়ঙ্গের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। পর্যটকসহ এলাকার বাসিন্দারাও সংগ্রহ করছেন এই পানি। হাতের তালুতে নিয়ে পান করছেন। অনেকে বোতলে সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন।
জানা যায়, ১৯৬৬ সালে ট্যাকেরঘাটে বাংলাদেশের প্রথম চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয় ৩২৭ একর জায়গাজুড়ে। সে সময় চুনাপাথর খনি প্রকল্পের আওতাধীন শত শত কর্মচারী এই জলধারা থেকে পানি সংগ্রহ করে পান করেছেন। এই জলধারা থেকে পানি সরবরাহ করে কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসায় দেওয়া হতো। কোম্পানি লোকসানের জন্য প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে ১৯৯৬ সালে। ফলে সরবরাহও বন্ধ হয়ে গেছে।
বালিয়াঘাট গ্রামের বাসিন্দা বাবর আলী ঢাকা পোস্টকে জানান, অলৌকিক কিছু নয়। ট্যাকেরঘাটের ভূমির গঠন বালু মাটি দিয়ে। পুরো এলাকাটিই উঁচু। পানির স্তর বেশি নিচে নয়। ৪০ থেকে ৫০ ফুট পাইপ দিলেই নিরাপদ পানি পাওয়া যায়। পাহাড়ের এ জায়গাটির নিচে বালু। বালুর নিচ থেকেই বের হয়ে আসছে পানি।
ট্যাকেরঘাটের বাসিন্দা শামীম আহমেদ তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি এই জায়গা থেকে পানি বের হতে। মূলত পাহাড়ের ছোট সুড়ঙ্গ থেকে বের হয় পানি। আমি বাড়িতে ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করি এই পানি। এক বছর এই পানি বোতলে করে রেখেছি। কিন্তু এক বছর পরও বোতলের রং পরিবর্তন হয়নি। পানির স্বাদ, গন্ধও ঠিক ছিল।
বাজারে যে মিনারেল ওয়াটার রয়েছে, তার চেয়ে এই পানি অনেক ভালো উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশপাশের এলাকার অনেকেই ভ্যানগাড়িতে করে পানি নিয়ে যায় এখান থেকে। এ ছাড়া অনেক পর্যটক বোতলে করে পানি নিয়ে যান।
ট্যাকেরঘাটের আনসার ক্যাম্পের সদস্য রোমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ক্যাম্পের পেছনেই অবস্থিত এই জলধারা। আমাদের দৈনন্দিন সব কাজে এই পানি ব্যবহার করি। খুবই ভালো এই পানি। এতে কোনো আয়রন নেই, খারাপ কোনো পদার্থ নেই। বিশুদ্ধতার কারণে সবাই এই পানি ব্যবহার করছি। পান করার সময় মনে হয় মাম পানি পান করছি।
পরিবেশ গবেষক সেলিনা সুমি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সুড়ঙ্গের পানি খুবই ভালো। আমি আগেও গিয়েছি ট্যাকেরঘাটে। তিন বোতল পানি নিয়ে এসেছি। একটা বুনো ফুলের ফ্লেভার রয়েছে এই পানিতে। অক্টোবর মাসে ফ্লেভারটি বেশি পাওয়া যায়। নরমাল প্লাস্টিকের বোতলে রাখলেও খুব ভালো থাকে।
এই জলধারার উৎস কী, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাহাড়ের একটা ছড়া থেকে এই পানির উৎপত্তি। একেবারে পাহাড়ের মাঝখান থেকে বের হচ্ছে। দেখা যায় একটা সুড়ঙ্গ থেকে বের হচ্ছে। এই এলাকার মাটি ও পাথরের মান এই পানিকে একেবারে বিশুদ্ধ ফিলটার করে বের করছে।
এনএ